নাম না-জানা একটা শহর। সেখানেই এক জাদুকরের অধীনে কাজ করে ছোট একটা ছেলে— আলাদিন। এক দিন ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ তার ভাগ্যটাই বদলে দিল। গল্পটা সবারই চেনা, ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’। কিন্তু এই গল্পের জন্মকাহিনিটা কি?
২৫ মার্চ, ১৭০৯। প্যারিসের একটা বাড়ি। সন্ধ্যা নেমেছে সবে, মনোরম আবহাওয়া। বড় টেবিলের ঠিক মধ্যিখানে ফরাসি সুরা কালভাডোসের একটা বোতল। নকশা-কাটা গ্লাসে তৃপ্ত চুমুক দিচ্ছেন দুজন— এক প্রাচ্যবিদ আর বাড়ির মালিক। বাড়ি না বলে প্রাচ্যের নানা সামগ্রীর সংগ্রহশালা বলাই ভাল। দুজনেই মগ্ন, কোনও কথা বলছেন না তেমন। কারণ, ঘরের এক কোণে বসে এক যুবক একটা গল্প বলছেন। আশ্চর্য সেই গল্পের চরিত্র দৈত্য, জিন আর আলাদিন। নিছক গল্প বলা নয়, অদ্ভুত এক মায়াজাল যেন বুনছেন যুবকটি। সেই গল্প শুনে সঙ্গের খাতায় নোট নিলেন শ্রোতাদের এক জন, প্রাচ্যবিদ আঁতোয়া গ্যাল্যাঁ। তা থেকেই পরে জন্ম নিল ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ গল্পের লিখিত রূপ।
লিখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন গ্যাল্যাঁ। প্রিয় বন্ধু, সংগ্রাহক পল লুকাচের বাড়িতে যাওয়ার আগে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। এর আগেই গ্যাল্যাঁর অনুবাদে প্রাচ্যের বিখ্যাত বই ‘আরব্য রজনী’র কয়েক খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বই-বাজারে জবরদস্ত বিকোচ্ছেও তা। আর ভাল বিক্রি হলে যা হয়, প্রকাশকের তাড়া— পাঠক আরও চাইছেন, আরও গল্প দিন! কিন্তু গ্যাল্যাঁ আর গল্প পাবেন কোথা থেকে? তাঁর সঙ্গে থাকা পুঁথিতে যে আর গল্প নেই!
সমস্যার সুরাহা হল লুকাচের বাড়িতে, ওই যুবকের গল্প শুনে। যুবকটির নাম হানা দিয়াব। আলেপ্পোর এক বস্ত্র-ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে দিয়াব ১৭০৮ সালে প্যারিসে আসেন, লুকাচের সঙ্গেই। যুবকের গল্প বলার কায়দা চমৎকার। মার্চের সেই সন্ধ্যায় আলাদিনের গল্প ছাড়াও আরও কয়েকটা গল্প দিয়াবের মুখে শোনেন গ্যাল্যাঁ আর লুকাচ। একটা গল্প এক গরিব কাঠুরিয়া, তাঁর ধনী ভাই, এক দল চোর আর এক দাসীকে নিয়ে। ‘আরব্য রজনী’ বইয়ে গল্পটা ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ নামে বিখ্যাত। গ্যাল্যাঁ সে দিন এই গল্পটারও নোট নিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সত্য এই, আলাদিন বা আলিবাবা ও চল্লিশ চোর— এই দু’টি জনপ্রিয় গল্পের উল্লেখ কোনও আরবি পুঁথিতে নেই। থাকবে কী করে, ও যে দিয়াবের গল্প! গবেষকদের ভাষায়, ‘অরফ্যান টেলস’।
এ ভাবেই দিয়াবের মুখে শোনা গল্পের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ভাষায় ‘আরব্য রজনী’র প্রথম সার্থক অনুবাদক হলেন আঁতোয়া গ্যাল্যাঁ। ১৭০৪-১৭১৭ সালের মধ্যে মোট বারো খণ্ডে অনুবাদের কাজটি সম্পূর্ণ করেন তিনি। গ্যাল্যাঁর সঙ্গে মোট বারো বার আড্ডায় দিয়াব ষোলোটি গল্প বলেন। তার মধ্যে দশটি গল্পকে গ্যাল্যাঁ স্থান দিলেন তাঁর অনূদিত ‘আরব্য রজনী’র দশম থেকে দ্বাদশ খণ্ডে। তাঁর অনুবাদে ‘আরব্য রজনী’র জলহাওয়ায় কোথাও কোথাও উঁকি দেয় তখনকার ফ্রান্সও। দিয়াবের কাছে শোনা ‘রাজকুমার আহমেদ ও পেরি-বানু’র গল্পে যে বিলাসবহুল প্রাসাদ আর বিপুল ঐশ্বর্যের বর্ণনা, তা মনে করায় ফরাসি শাসক লুই দ্য গ্রেট-এর আমলের বিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদকে। ঘটনাচক্রে দিয়াবও তার কয়েক দিন আগেই এই প্রাসাদ ঘুরে গিয়েছিলেন!
প্রশ্ন উঠতে পারে, দিয়াব যে এত ‘নতুন’ গল্প শোনালেন, তিনিই বা সেগুলো পেলেন কোত্থেকে! অনেক দিন পর্যন্ত মনে করা হত, তাঁর দেশ সিরিয়ায় গল্প বলার যে সুদীর্ঘ মৌখিক ঐতিহ্য, সেটাই বুঝি বা গল্পগুলোর উৎস। দিয়াব যে অঞ্চলের লোক, সেখানে প্রায় প্রতি ঘরেই তো থাকেন গল্পদিদিমা আর মাসি-পিসিরা। এই ধারণাটা হালে বদলেছে। ভ্যাটিকান সিটির গ্রন্থাগারে খোঁজ মিলেছে এক পাণ্ডুলিপির। সেটা দিয়াবেরই। চমৎকার লেখায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর আলেপ্পো থেকে প্যারিস যাত্রা, আর ‘মাস্টার’ লুকাচের সঙ্গে নানা অভিজ্ঞতা। এই ‘আত্মকথন’-এর সূত্রেও ‘আরব্য রজনী’কে দেখা যেতে পারে।
আলাদিনের গল্প যেমন শুরু হয় জাদুকর আর আলাদিনের সম্পর্কের সূত্রে। দেখা যাচ্ছে, ফরাসি অনুবাদক গ্যাল্যাঁর ‘আরব্য রজনী’র জাদুকর আর দিয়াবের লেখা পর্যটক লুকাচ সাহেবের চরিত্রের মধ্যে অবাক-করা মিল! শুধু তাই নয়, আলাদিন যে ভাবে জাদুকরের সঙ্গ নিয়েছিল, অনেকটা তেমনই ধারায়, ‘প্রশ্নহীন ভাবে’ দিয়াবও সঙ্গ নিয়েছিলেন লুকাচের। দিয়াবের পথ-কথায় জড়িয়ে থাকা লুকাচও কি তবে প্রভাব ফেলেছিলেন ‘আরব্য রজনী’তে?
বিষয়টা দেখা যেতে পারে কিছু চরিত্র, ছবি ও প্রতীকের দিক দিয়েও। হাজার ও এক রাত্রির কিস্সা ‘আরব্য রজনী’তে ঘুরে বেড়ায় ‘দানদান’ নামে এক সামুদ্রিক জীব— আবদুল্লা জেলের গল্পে। লুকাচ সাহেব তাঁর দ্বিতীয় ভ্রমণ বৃত্তান্তে প্রায় অমনই একটি দৈত্যের গপ্পো ফেঁদেছেন। তাঁর দাবি, তিনি নাকি বর্তমান ইজরায়েলের জাফা শহরে এক সমুদ্র-দৈত্যের গল্প শুনেছিলেন। দিয়াবও পরে গলাঁকে শুনিয়েছিলেন এমনই একটি গল্প, ‘সমরখন্দের সুলতান’। যদিও তাঁর ‘আরব্য রজনী’তে তা শেষমেশ অন্তর্ভুক্ত করেননি গ্যাল্যাঁ। কিন্তু সমুদ্র-দৈত্যের মতো চরিত্রটির উৎস যে শুধু লুকাচের লেখাই, দিয়াবের বলা গল্পগাথা নয়, তা-ই বা কে জানে!
শুধু কি দৈত্য? ‘আলিবাবা’-র গল্পে ‘চিচিং ফাঁক’ বলতেই হাট করে খুলে যায় যে গুহার দরজা, তার অস্তিত্ব নিয়েও নানান অনুমান। আলেপ্পোর থেকে খানিক দূরে লুকাচ সাহেব বেশ কয়েকটা দুর্গম গুহা দেখতে পেয়েছিলেন। গুহাগুলো নাকি ভয়ানক বিপজ্জনক সব ব্যাপারস্যাপারের আখড়া। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ছিল, লুকাচের দেখা ওই গুহাগুলো আসলে নাকি দুর্ধর্ষ সব ডাকাতদের আখড়া। আলিবাবার গল্পের চল্লিশ চোরের শেকড় সেই গুহার ডাকাতেই— হতেই পারে তা। আর একটা তথ্যও এই সম্ভাবনাকে জোরদার করে— ১৭০৭-এর ক্রিসমাসে লুকাচ নিজেও দস্যুদের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন! লুকাচের বাস্তব জীবনের এই সব অভিজ্ঞতা মনে রেখেই দিয়াব ফরাসি অনুবাদক গ্যাল্যাঁকে শুনিয়েছিলেন ‘হোগিয়া বাবা’র গল্প। সেই কাহিনিই ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ গল্পের উৎস, অনুমান গবেষকদের। তা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে, গল্পের ‘জিন’ কোথা থেকে হাজির হল? সম্ভবত দিয়াবের ছেলেবেলায় শোনা আলেপ্পোর সরাইখানার গল্পগুলো থেকে। তবে এই গল্পে আলিবাবার সহোদর কাসিমের লোভ ও সেই লোভের পরিণতিতে মৃত্যু, দাসী মর্জিনার উপস্থিত বুদ্ধি এবং সর্বোপরি গল্পটির আপ্তবাক্য হিসেবে ‘সততাই শ্রেষ্ঠ পথ’ গোছের নীতি-বাক্য— গ্যাল্যাঁর নিজস্ব সংযোজন। এই সংযোজনে ফরাসি রূপকথার ঐতিহ্যকেও মাথায় রেখেছিলেন গ্যাল্যাঁ। সেই ঐতিহ্যের সূত্রেই আলাদিনের মায়াবী ঘোড়াও সংযোজিত হয়েছে ‘আরব্য রজনী’র পাতায়।
দিয়াবের এই কথনের সূত্রে আরও একটি শহরে ঘোরাফেরা করে ‘আরব্য রজনী’র আখ্যান। ইস্তানবুল। সেখানে শহরের কফি-হাউসগুলিতে নিয়মিত গল্পের আসর জমান কথকেরা। তাঁরা এমনই জনপ্রিয় যে ‘গ্র্যান্ড বাজার’-এর বই-বিক্রেতারা তাঁদের হামেশাই ধার দেন নানান পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। এ রকম বেশ কিছু কফি হাউসের সান্ধ্য-আসরে যোগ দিয়েছিলেন গ্যাল্যাঁও। সেই সব অভিজ্ঞতাকে ‘আরব্য রজনী’র সুতোয় বেঁধেছিলেন তিনি। অন্তত একটি উদাহরণ দেওয়াই যায়। গোল করে ঘিরে বসেছেন স্থানীয় মানুষ আর বণিকেরা। রয়েছেন গ্যাল্যাঁও। সেখানেই কথকের কাছ থেকে শুনলেন কোগিয়া মুজাফ্ফরের গল্পটি। সেই সূত্রে শুরু হল পড়াশোনা। ‘আরব্য রজনী’র সিন্দাবাদ নাবিকের চতুর্থ সমুদ্র-যাত্রার পরতে পরতে দেখা গেল এই গল্পের ছায়া।
অর্থাৎ আরব, সিরিয়া, ফ্রান্স, বর্তমান ইজরায়েল, সব জায়গা আর দেশেরই প্রভাব একটু একটু করে ঢুকতে থাকল ‘আরব্য রজনী’তে।
ইংরেজরাই বা বাকি থাকে কেন! ফরাসি অনুবাদের হাত ধরে ‘আরব্য রজনী’ গিয়ে পড়ল ইংরেজ ‘ভদ্রমণ্ডলী’র মাঝে। এর আগেই অবশ্য ‘গ্রাব স্ট্রিট’-এ এই বইয়ের কিছু বাজার-চলতি রূপ দেখা গিয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে ‘আরব্য রজনী’ প্রকাশিত হল ১৮৩৮ সালে। দেখা গেল, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে রাজা উমরের গল্প। উমরের ছেলের যুদ্ধে যাওয়া, খ্রিস্টান রাজকন্যা আবরিজাকে প্রথম দর্শনেই ভাল লাগা, পরে আবরিজাকে উমরের খুন, তার প্রতিশোধে পাল্টা উমরকে খুন— এই সব ঘটনা-উপঘটনাতেই গল্পের যাতায়াত। সহজ ভাবে বললে, গল্পের আখ্যানভাগে যুক্ত হল মুসলমান ও খ্রিস্টানের দ্বন্দ্ব। এমনকি ‘যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেম’ গোছের ওয়াল্টার স্কটের ধাঁচাটিরও ছায়া দেখা গেল।
‘আরব্য রজনী’তে ইংরেজ সুর সংযোজনের ‘কৃতিত্ব’ পেশায় ইংরেজ কর্মচারী হেনরি টরেন্স-এর। অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী টরেন্স কর্মসূত্রে কিছু দিন কাটিয়েছিলেন ভারত তথা বাংলাতেই। প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। নিত্য যাতায়াত ছিল এশিয়াটিক সোসাইটিতেও। সঙ্গী সম্পাদক স্যর উইলিয়াম হে ম্যাকনাটেনকে নিয়ে অনুবাদে হাত দেন তিনি। অনুবাদ করতে গিয়ে যে পুঁথিটিকে অবলম্বন করেন, তার উৎস আবার মিশর। পরে তা টার্নার ম্যাকেন নামে অন্য এক ইংরেজের হাতে পড়ে। তাঁর সূত্রেই পুঁথিটি আসে কলকাতায়, এশিয়াটিক সোসাইটিতে। কিন্তু এত কিছুর পরেও নানা কারণে টরেন্স-এর অনুবাদটি অসমাপ্ত থেকে যায়।
মিশর থেকে আসা পুঁথি ব্যবহার করলেও মিশরের জলহাওয়া তেমন নেই টরেন্স-এর অনুবাদে। সেই ছাপ নিয়ে এলেন আর এক জন— এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেন। ইংরেজিতে ‘আরব্য রজনী’র স্বচ্ছন্দ অনুবাদের কৃতিত্ব তাঁরই। লেন বারবার পাড়ি দিতেন কায়রোয়। সেখানে তাঁর পরিচয়, আল-ফকির মনসুর নামে। তাঁর কায়রো-প্রীতির কারণ, ‘আরব্য রজনী’র টান। লেন-এর অনুবাদে নতুন কোনও গল্প না মিললেও, ইংরেজি ‘আরব্য রজনী’-তে মিশল মধ্যযুগ ও উনিশ শতকের কায়রোর ছায়া।
কায়রোয় লেন-এর পরিচয় হল ওসমান এফেন্দি নামে এক জনের সঙ্গে। পেশায় অনেকটা ‘গাইড’-এর মতো। ইউরোপের সঙ্গে কায়রোর অন্যতম যোগসূত্রও বটে। কায়রোয় থাকাকালীন ওসমানের সঙ্গে আলাপের সূত্রে লেন জানতে পারলেন শেখ আব্দুল আল-কাদির নামে এক জাদুকরের কথা। এক দিন জাদুকরকে ঘরে আমন্ত্রণও জানালেন লেন। এলেনও তিনি। লম্বা, পেটানো চেহারার মানুষ, ফর্সা গায়ের রং। মুখভর্তি কুচকুচে কালো দাড়ি, পরনে সবুজ জোব্বা। ওসমান ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, ইনিই জাদুকর কাদির। জিন-তত্ত্ব বিষয়ক অনেক কিছু করে দেখালেন কাদির। ধুনো, কী একটা বীজ আর এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা সামনে রেখে জাদু-মন্ত্র আউড়ে বললেন, ‘তারসুন, তারিউআন, চলে আয়, চলে আয়…’ জাদুকর আসলে ডাকছিলেন ওঁর পরিচিত দুই ‘জিন’ বন্ধুকে! লেন-এর অনুবাদে ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ গল্পের জাদুকরও এমনই দুর্বোধ্য মন্ত্র আওড়ায়।
শুধু মিশরীয় সুর সংযোজনই নয়, লেন-এর অনুবাদের সৌজন্যে ‘আরব্য রজনী’র গায়ে লেপ্টে গেল ‘বড়দের বই’ তকমাও। তেমনই এক গল্পে, অনেক দিন পর ঘরে ফিরেছে ভাই শাহজামান। তাকে দেখে বাদশাহ শাহরিয়ার আত্মহারা। কিন্তু ভাইয়ের মন যেন উচাটন। তাকে বিশেষ না ঘাঁটিয়ে দাদা চলে গেল শিকারে। এমন সময়ে ভাই দেখলেন, দাদার খাস বেগম বাগানে ঢুকল সঙ্গী পরিচারক-পরিচারিকাদের নিয়ে। সকলেই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র! শুরু হল ‘খেলা’। বেগম আর ক্রীতদাস মাসুদের রতিক্রীড়া দেখে শাহজামান যেন খানিক ফুরফুরে। কারণ, তার বেগমও যে একই কাণ্ড ঘটিয়েছে! যদিও সে চরম প্রতিশোধও নিয়েছে। পরপুরুষের সঙ্গে যৌনতা, যৌন ঈর্ষার নানান কাহিনির বর্ণনায় বেশ রগরগে এই অনুবাদ। তাই লেন-এর প্রকাশক চার্লস নাইট কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, এই বই ‘পরিণতবয়স্ক ও মনস্কদের জন্য’।
‘পরিণত’ আরব্য রজনী নির্মাণে লেন-এর লেখায় আর এক জনের প্রভাব অপরিসীম। তিনি শেখ আহমেদ, কায়রোর এক বই-বিক্রেতা। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা এবং নারী সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি লেন-এর ‘আরব্য রজনী’র গার্হস্থ্য পরিবেশে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। তবে কায়রোর নারীদের কথা ভেবে লেন গল্পে কিছু কাঁচিও চালিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ‘কুলি ও বাগদাদের তিন নারী’ গল্পটির কথা। এখানে সচেতন ভাবেই বেশ কিছু যৌন দৃশ্য কাটছাঁট করেছিলেন লেন। তবে ‘আরব্য রজনী’ যাতে ‘অ্যাডাল্ট’ তকমা না হারায়, বোধহয় সে জন্যই বইয়ের ফুটনোটকে যথাসম্ভব যৌনগন্ধী করে তুলেছিলেন একই সঙ্গে। আগের ফরাসি অনুবাদের কিছু নারী চরিত্র— যেমন আলিবাবার গল্পে ‘মর্জিনা’ দাসী— বাদ দিলেন লেন। রাখলেন অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার ভারসাম্য। যেমন, আবু আল-হাসান ও তাঁর দাসী তাওয়াদ্দুদ-এর গল্পটি। গল্পে এই দাসী অসম্ভব বিদুষী, বাগদাদে খালিফা হারুন-অল-রশিদের দরবারে প্রায় সব বিশেষজ্ঞকে এক প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু ‘আরব্য রজনী’র স্বাভাবিক মেজাজের সঙ্গে নারীর এই বৌদ্ধিক উৎকর্ষ কে জানে কেন যুক্তিগ্রাহ্য ঠেকেনি সাহেবের কাছে। অগত্যা বাদ।
‘আরব্য রজনী’র অনুবাদের কাজ যেন একটা নেশায় পরিণত হল ইংরেজদের কাছে। আরও দুজন অনুবাদক, ইংরেজ অফিসার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন আর কবি জন পেন একসূত্রে বাঁধা পড়লেন খানিকটা কাকতালীয় ভাবেই। ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের কিছু দিন পর বার্টন কাজের সূত্রে গেলেন সিন্ধ প্রদেশে। তার পর প্রাচ্যকে দেখার বাসনায় ছুটে বেড়ালেন পারস্যে। নাম নিলেন মির্জা আবদুল্লা। কখনও ছদ্মবেশ ধরলেন আফগান শেখ আবদুল্লা নামে। এমনকি, ছদ্মবেশে ১৮৫৩ সালে মক্কা-মদিনাও যান তিনি। ইংল্যান্ডে প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ হিসেবে মর্যাদা পেতে তো এই যথেষ্ট। কিন্তু বার্টনের মনে তখন অন্য বাসনা— ‘আরব্য রজনী’র অনুবাদ করতে হবে।
এই সূত্রেই যোগাযোগ জন পেন-এর সঙ্গে। পেন তত দিনে ‘আরব্য রজনী’র অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। সেখানে যৌন দৃশ্য বড়ই কাব্যিক। শাহজামান তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে অন্য এক পুরুষের সঙ্গমদৃশ্য দেখছেন। এই দৃশ্যটিকে লেন বলেছেন, ‘রানি ও দাস ঘুমোচ্ছিলেন।’ হেনরি টরেন্স-এর অনুবাদে তা, দুজন ‘আলিঙ্গনাবদ্ধ’। আর পেন লিখলেন, ‘কালো দাসের বিছানায়, তাঁর বাহুতেই নিদ্রিত রানি।’ এই কাব্যিক ছোঁয়া ও আরবের ভাষা-সমাজ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে পেন-এর অনুবাদের বিরূপ সমালোচনা হল ইংল্যান্ডে। ‘বন্ধু’ বার্টনের সাহায্য চাইলেন পেন। সেই সাহায্যের বিনিময়েই খুব সম্ভবত পরের খণ্ডে বার্টনের নাম ব্যবহার ও তাঁকে বইয়ের অংশীদারিত্বের ভাগ দেওয়ার প্রস্তাবও দিলেন। সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি বার্টন। কারণ তাঁরও উদ্দেশ্য আরব্য রজনীর অনুবাদ। বার্টন তাঁর ‘আরব্য রজনী’কে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে নিজের দেখা প্রাচ্যকে তুলে আনলেন, অ-ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেন নিপুণ ভাবে। ফল্গুধারার মতো বয়ে চলছিল যে ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাকেও অস্বীকার করলেন।
বার্টনের একটি কৃতিত্ব, ‘আরব্য রজনী’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘হারুন-অল-রশিদ’-কে অত্যন্ত সচেতন ভাবে নির্মাণ করেছেন তিনি। এই কাজে আবার লখনউ থেকে প্রকাশিত জনাথন স্কট-এর সটীক ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস এন্টারটেনমেন্টস’ বইটি তাঁর বিশেষ কাজে দিয়েছিল। ‘আরব্য রজনী’র অনুবাদে ‘ভারতীয় সুর’-এর সংযোজনও তাই তাঁরই কাজ। যদিও তার আগে থেকেই এই গল্পগুলির ভারতীয় উৎস সম্পর্কে একটি মত প্রচলিত ছিল। এ ভাবেই নানান অনুবাদকের হাতে, নানা দেশের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে ‘আরব্য রজনী’।
ঋণ: মার্ভেলাস থিভস: সিক্রেট অথর্স অব দি অ্যারাবিয়ান নাইটস: পাওলো লেমোস হোর্তা; দ্য আরাবিয়ান নাইটস ইন হিস্টোরিকাল কনটেক্সট: বিটউইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট: সারি মাকদিসি, ফেলিসিটি নুসবম