চৈত্রমাসেই পুজো পান গরিয়া দেবতা

তার পরই জুম চাষ শুরু করে ত্রিপুরার জনজাতি। রাজনৈতিক পালাবদল তুচ্ছ। তার পরই জুম চাষ শুরু করে ত্রিপুরার জনজাতি। রাজনৈতিক পালাবদল তুচ্ছ।

Advertisement

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০৩
Share:

আরাধনা: ঘরোয়া গরিয়া পুজোর ছবি। ছবি সৌজন্য: কমল মিত্র

ফাল্গুন পন্দর চৈতর দাগ রিঅ— ফাল্গুনের পর চৈত্র আসবে। তখনই নেমে আসবেন গরিয়া। তিনি মঙ্গল, আনন্দের প্রতীক, আবার সম্পদেরও দেবতা। তাঁর পুজো করে জুম চাষ শুরু করবে ত্রিপুরার জনজাতি মানুষেরা। জামাতিয়া, ত্রিপ্রা আর নোয়াতিয়াদের কাছে ইনি গরিয়া, কলই ও রিয়াংদের কাছে গরাই, কলাই। হালাম সম্প্রদায়ের কাছে তিনিই সুকুন্দরাই ও মুকুন্দরাই। বৈশাখ-শুরুতে সাত দিনের পরব, প্রস্তুতি শুরু চৈত্রেই।

Advertisement

‘শ্রীরাজমালা’ গ্রন্থে আছে গরিয়া পরব প্রচলনের কাহিনি। ত্রিপুরার পূর্বপ্রান্তে একটা সাদা হাতি দেখা গিয়েছে, সংবাদ পেলেন মহারাজ ধন্যমাণিক্য। আদেশ দিলেন তাকে ধরে আনতে। কিন্তু থানাংসী নগরের কুকিরাজ হাতিকে আটকে রাখলেন। সেনাপতি রাইকাচাগ আট মাস যুদ্ধ করে কুকিরাজকে পরাজিত করলেন। সেনাপতি শুধু হাতিই নয়, কুকিদের কুলদেবতার সোনার মূর্তিও নিয়ে এসেছিলেন। সেই দেবতাই গরিয়া। কী ভাবে তাঁর পুজো করতে হবে, জানা ছিল না। তাই থানাংসী থেকে ধরে আনা হল পুরোহিত আর পূজারী—‘কৈরফাং’ আর ‘অচাই’কে।

চৈত্র মাসে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে পরের পুজো শুরু হয় গোমতী, বুড়িমা ও মনু নদীতে। মূল পুজোর দু’টো পর্যায়, চিয়াগূণাং আর চিয়াকূরই। গরিয়া দেবতার সোনার মুখমণ্ডলের সঙ্গে বাঁশ দিয়ে হাত-পা যোগ করে তাঁকে পোশাক পরানো হয়। বড় পুজো হয় অমরপুরের তেঁতে এবং মহারাণীর হাতিছড়ায়।

Advertisement

বাড়ির পূজাপদ্ধতি ভিন্ন। উঠোনে সাত হাত লম্বা খুঁতহীন মুলিবাঁশ পুঁতে দিতে হবে, মাথায় থাকবে পাতা। সেখানে হাতে-কাটা সুতোয় ফুল, তুলো দিয়ে তৈরি লম্বা মালা পরানো হয়। লাল-সাদা সুতোয় হাতে বোনা ‘রিছা’ ঝুলিয়ে তাতে ধান ও মুদ্রা বেঁধে দেওয়া হয়। মালাটি হাতির শুঁড়ের প্রতীক, রিছাটি দেবতার পাগড়ি। বাঁশের গোড়ায় কয়েকটা লাঠি গেঁথে তার সামনে কলাপাতায় বিন্নি ধানের খই, ডিম, মদ পুজো দেওয়া হয়। পুজো শেষ হলে বলি-দেওয়া মোরগের অন্ত্র পরীক্ষা করে ‘অচাই’ জানিয়ে দেন পুজোর ফলাফল। বিকেলে দেবতা বিসর্জনের আগে গরিয়া ধোয়ানোকে বলে ‘অ্যাংকুছুরুঅ’। বাড়ির সদস্যদের নামে দেবতার কাছে ডিম উৎসর্গ করা হয়। সন্ধেয় নাচগান, পান-ভোজন। জামাতিয়ারা সাত দিন গ্রামে-গ্রামে দেব-প্রদক্ষিণ করিয়ে নাচগান করেন। বিসর্জনের পর হয় ধানের দেবী মাইলুমা, তুলোর দেবী খুলুমার পূজা।

প্রাচীন ত্রিপুরায় ১০৮ রকমের নাচ প্রচলিত ছিল যার মধ্যে গরিয়াকে কেন্দ্র করেই ৩২ রকমের নাচ। গরিয়া নৃত্যকে বলে ‘খেরেবাই মোছামুং’, নাচিয়ে-দলের নাম ‘সেংজারক’। নাচে জুম পোড়া, বোনা, বাছাই, তোলা, হাতির চলন, পাখির ওড়া ফুটে ওঠে। গরিয়াকে সন্তুষ্ট করে সবাই বলে, এ বার ধান বুনব।

১৯৮৯-এ চুরি হয়ে যায় স্বর্ণগরিয়া। এখন যে দেবতা পূজা পান তিনি ‘সরকারি’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন