এক ওভারে চার ট্রাক প্লাস্টিক

পৃথিবীর প্রথম ১৪টি দূষিত শহরই ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর মাটিতে। আর ভারতীয় অলরাউন্ডার হার্দিক পাণ্ড্য এক ওভার বল করতে যে সময় নেন, তার মধ্যেই চার ট্রাক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দেয় মানুষ। তা হলে সারা বছরে কত? লিখছেন দীপেশ চক্রবর্তীপৃথিবীর প্রথম ১৪টি দূষিত শহরই ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর মাটিতে। আর ভারতীয় অলরাউন্ডার হার্দিক পাণ্ড্য এক ওভার বল করতে যে সময় নেন, তার মধ্যেই চার ট্রাক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দেয় মানুষ। তা হলে সারা বছরে কত?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

আগামী মঙ্গলবার বিশ্ব পরিবেশ দিবস। মানুষের পরিবেশ-চেতনা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ নানা আয়োজন করবে। এ বছরের মূল থিম: প্লাস্টিক। বিশেষত সমুদ্রে গিয়ে জমা হয় যে প্লাস্টিক, তা-ই। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে, ক্রিকেটে একটি ওভার বল করতে হার্দিক পাণ্ড্যর যতটা সময় লাগে, সেইটুকু সময়েই চার ট্রাক পরিমাণ প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলে দেয় মানুষ। ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা করার কারণও আছে। এ বছর দিনটির প্রধান উদ্গাতা ভারত সরকার। ২০১৬ সালে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। তা ছাড়া পরিবেশ-চেতনা যে তাঁর কাছে একটি জরুরি বিষয়, এ কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্প হাতে নিয়েই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।

Advertisement

কিন্তু কলকাতায় বসে বিশ্বপরিবেশ সচেতনতার কথা তুলতে একটু কুণ্ঠা হয়। লালন সাঁইয়ের গানের কলি মনে পড়ে, ‘...হাতের কাছে হয় না খবর, কী দেখতে যাও দিল্লী, লাহোর গো?’ আমাদের দারিদ্র, জনসংখ্যা, পরিবহণ ও বাসস্থানের অব্যবস্থা ইত্যাদি ভাবলে ‘পরিবেশ’ ব্যাপারটিকে হয়তো একটু বিলাসী চিন্তা মনে হবে। অথচ পরিবেশের কথা চিন্তা না করলে ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে আমরাই ভুগি। এক সময়ে আমাদের গ্রামীণ সমাজের ব্যবস্থায় পরিবেশ এত সমস্যার ছিল না। মনুষ্য সমাজে যা বর্জ্য পদার্থ বলে গণ্য হত, তার বেশির ভাগই পুনর্ব্যবহৃত হয়ে মাটির পৃথিবীতে ফিরে যেত। ইংরেজিতে যাকে ‘রিসাইক্লিং’ বলে। কিন্তু এখন শহর হয়েছে, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উন্নতি হয়ে মানুষের সংখ্যা ও গড় আয়ু, উভয়েরই বৃদ্ধি হয়েছে। স্বাধীনতার পর উপমহাদেশের জনসংখ্যা চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। সাম্প্রতিক কালে চোখে পড়ার মতো জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে শহরে। দিল্লি, বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের বাণিজ্যিক রমরমা বেড়েছে, কিন্তু দূষণও বেড়েছে। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত প্রথম পনেরোটি শহরের একটি তালিকায় চোদ্দোটিই দেখছি ভারতীয়!

অনেকে বলেন যে এই শতাব্দীর শেষে মানুষ একটি শহুরে প্রজাতি হয়ে বাঁচবে। আমাদের দেশের মানুষও কাতারে কাতারে শহরে এসে পড়ছেন। কিন্তু অভ্যেস কি অত সহজে বদলায়? এই ধরুন রাস্তায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া। এই অভ্যেস বদলাতে পুরুষ মানুষের একশো বছর লেগে গেল। ১৮৫০-এর দশকের গোড়ায় কলকাতায় ইংরেজ যখন ‘কমিট নো নুইসেন্স’ চালু করেছিলেন, কবি ঈশ্বর গুপ্ত তার প্রতিবাদ করে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ লিখেছিলেন: ‘নগরের মধ্যে কি উৎপাত শুরু হইল, এক মূত্রসূত্র লইয়া পুলিসের কর্ত্তারা কি ফ্যাঁসাৎ করিয়া তুলিলেন...।’ ‘ভৌতিক ব্যাপারের’ উপর রাজনিয়মের হস্তক্ষেপ একেবারেই পছন্দ হয়নি গুপ্তকবির। তিনি হয়তো আমাদের ছেলেবেলা দেখলে খুশিই হতেন। দেখতেন, সার সার ‘প্রতিবাদী’ মানুষ দেয়াল দেখলেই তার ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তাঁদের জ্বালায় উত্ত্যক্ত হয়ে অনেক দেয়ালের মালিকই অবশেষে দেয়ালে দেবদেবীর ছবি আঁকিয়ে রাখতেন— যদি মানুষের অভ্যেস বদলায়! এই রকম ‘প্রতিবাদ’ হয়তো কমেছে এখন কলকাতায়। অনেক সুলভ শৌচাগার হয়েছে শহরে, তার কিছু সুফল হয়েছে আশা করি।

Advertisement

বস্তুত পরিবেশ-চর্চা যে আমাদেরই জন্য, এই রকম উপলব্ধির ছাপ কমই দেখি কলকাতা শহরে। কলকাতা থেকে কল্যাণী যাওয়ার জন্য নতুন, সুন্দর, চওড়া হাইওয়ে তৈরি হয়েছে। কিন্তু গেলে দেখবেন, রাস্তার দু’পাশে ডাঁই করে রাখা প্লাস্টিকের স্তূপ। তার জায়গায় জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ধূমায়িত বর্জ্যের ভিতর থেকে বিষবাষ্প আকাশ-বাতাস দূষিত করছে, কিন্তু কারওই মাথাব্যথা নেই। বোঝা যায়, উন্নয়ন হচ্ছে, শহর বাড়ছে, নতুন প্রযুক্তি— যেমন প্লাস্টিক— আসছে, কিন্তু এই বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে তা নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই। মানুষের বর্জ্যের চেহারাও বদলাচ্ছে। আমাদের ছোটবেলায় বাড়ি বাড়ি পুরনো কাগজপত্র, লোহালক্কড়, কাচের বোতল বিক্রি করা হত। গরিব ফেরিওয়ালারা সে সব কিনে অন্যত্র বিক্রি করতেন। ময়লা ঘেঁটেও পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস উদ্ধার করে বিক্রি করতেন কেউ। কিন্তু নতুন প্রযুক্তিতে ‘ময়লা’র চেহারা অন্য রকম। মানুষ এখন এমন সব মিশ্র ধাতু ব্যবহার করে জিনিসপত্র তৈরি করে যে তা আর ‘কাবাড়িওয়ালা’দের সেই হাতে হাতে বা চোখে দেখে কাচের থেকে লোহা বা অ্যালুমিনিয়াম আলাদা করার মতো, আলাদা করা সম্ভব নয়। আধুনিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করে তুলতে এখন উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন। ফলে বড়লোক দেশে বর্জ্যবস্তু এক মস্ত ব্যবসা, তাই নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বহুজাতিক সংস্থাদের মুনাফালাভের আয়োজন। আমাদের গরিব দেশেও এই ব্যবসা আসছে। এর ফলে সাধারণ ‘ময়লা’-কর্মচারীদের জীবনে আজকের যে অনিশ্চয়তা, তার ছবি ক্যাথারিন বু তাঁর ‘বিহাইন্ড দ্য বিউটিফুল ফরএভার্স’ বইটিতে সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন।

কিন্তু বড়লোক কি গরিব দেশ, আধুনিক বর্জ্যের সমস্যাটি মূলত এক। তা হল, বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার না করতে পারলে যে উদ্বৃত্ত থেকে যায়, তা থেকেই মানুষের নানান সমস্যার শুরু। পৃথিবীর ভাঁড়ারের উপর এখন মানুষের অনেক চাহিদা। ১৮২৫ সালে মানুষ ছিল এক বিলিয়ন বা একশো কোটি। আজ তার সংখ্যা ৭.৫ বিলিয়ন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের গণনায় ২০৫০ সালে, অর্থাৎ আর ৩২ বছরে, এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৯.৩ বিলিয়ন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যা এখন থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এমন ভাবে বাড়বে যে তা হবে প্রতি পাঁচ দিন অন্তর দশ লক্ষ (এক মিলিয়ন) মানুষের এক একটি শহর গড়ার সমান। বর্তমানে ১৩০ কোটি মানুষকে হতদরিদ্র ভাবা হয়। এঁদের দারিদ্রমুক্ত করা মানুষের কর্তব্য। এ দিকে পৃথিবীতে গড়ে জনপ্রতি ভোগবিলাসের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। মানুষের চাহিদার চাপে জীববৈচিত্রের, পানীয় জলের সাধারণ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আবার সঙ্কট মেটানোর জন্যই প্রয়োজন আরও বিদ্যুৎ, অর্থাৎ জ্বালানি ও শক্তি। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিকীকরণ বা মানুষের জীবনের ক্রমবর্ধমান উন্নতির কথা তো আর ভাবা যায় না।

সবচেয়ে বড় সঙ্কট এখানেই। এত দিন মানুষ কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে সহজেই পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি বা এনার্জি তুলনামূলক ভাবে সস্তায় সংগ্রহ করেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্কটে এসে বোঝা যাচ্ছে যে এই ফসিল-জ্বালানি থেকে শক্তি আহরণ করার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফসিল-জ্বালানি ব্যবহার করলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস নির্গত হয়। আমাদের যতখানি জ্বালানি লাগে, তাতে এই সব গ্যাস যে পরিমাণে ও যত তাড়াতাড়ি নির্গত হয়, তার সবটা গাছপালা, মাটি বা সমুদ্র শুষে নিতে পারে না, একটা উদ্বৃত্ত পরিমাণ বাতাসে থেকেই যায়। থেকে যায় হাজার হাজার বছর ধরে। বলতে পারেন, এই হল ফসিল-জ্বালানির উদ্বৃত্ত বর্জ্য যার কোনও আশু পুনর্ব্যবহারের সুযোগ নেই। এই গ্যাস বাতাসে থেকে তাপ আটকে রেখে পৃথিবীর উপরিস্তরের তাপমাত্রা বাড়ায়। তাকেই আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা আমাদের গ্রহটির উষ্ণতা-বৃদ্ধি বলি। পৃথিবীর উষ্ণতা এই ভাবে বাড়লে সমুদ্র স্ফীত হয়ে ওঠে, জলের আম্লিক চরিত্র বদলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের সঙ্কট দেখা দেয়। তা ছাড়া সাইক্লোনের ভয়াবহতা ও সংখ্যা বাড়া, খরা-বন্যার আশঙ্কা, নতুন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বৃদ্ধি পাওয়া— এই সমস্ত কিছুর সম্ভাবনা প্রবলতর হয়ে ওঠে। মানুষের উন্নয়নের সাধনায় আজ পৃথিবী নামক গ্রহটির চরিত্রই বদলে গিয়েছে।

পৃথিবীব্যাপী জীবনের উপর মানুষের এই প্রতিপত্তি দেখে কিছু বিজ্ঞানী বলতে শুরু করেছেন যে মানুষ প্রজাতিটি আজ প্রবল ক্ষমতাশালী আগ্নেয়গিরির মতোই এক ভূতাত্ত্বিক শক্তি। তাঁরা বলছেন, আমাদের এই গ্রহটির প্রাচীন ইতিহাসে আজ এক নতুন যুগ এসেছে, তা মানুষের যুগ, বা অ্যানথ্রোপসিন। কেউ বলছেন, না, তা কেন নাম হবে? এর মূলে আছে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তাই নাম হোক ‘ক্যাপিটালোসিন’। আজ দুটো জিনিস ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে এসেছে— যাকে আমরা ‘পরিবেশ’ বলি, তাকে উপেক্ষা করে মানুষের সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না। আর দ্বিতীয়ত, পরিবেশ ও মানুষ দুটি আলাদা বস্তু নয়। পরিবেশেরই ফসল মানুষ, আবার মানুষের শরীরের মধ্যেই নানান জীবাণু ও ভাইরাসের রূপ নিয়ে পরিবেশ বর্তমান। বিভিন্ন প্রাণিজগৎ ও এই পৃথিবী নানান সূত্রে সম্বন্ধিত। বিশ্ব পরিবেশ দিবস যদি আমাদের এই সত্য স্মরণে রাখতে সাহায্য করে, এই উপলব্ধির আলোকে উন্নয়নের প্রশ্নটি ভাবায়, তা হলে তা-ই হবে তার সার্থকতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন