কা গে র ছা ব গে র ছা

অনেক বুড়ো দাদু ও একটা বুড়ো আঙুল

চির কালই আমার ঘুম ভাঙত দেরিতে। তার আগে যে বাড়িতে কত কী হয়ে যেত! এক দিন কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চৌকি থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি, বিশাল একটা কালবোশ মাছ মেঝে থেকে ছ’ইঞ্চি ওপরে উঠে ল্যাজ ঝাপটাচ্ছে। আগের দিন বাঁকুড়া বাজার থেকে মাছ কিনে, সারা দিন সারা রাত দুধভাতকলা খাওয়াতে খাওয়াতে রাতের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে মামাদাদু হাওড়ায় এসে পৌঁছেছেন সাতসকালে।

Advertisement

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী

চির কালই আমার ঘুম ভাঙত দেরিতে। তার আগে যে বাড়িতে কত কী হয়ে যেত! এক দিন কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চৌকি থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি, বিশাল একটা কালবোশ মাছ মেঝে থেকে ছ’ইঞ্চি ওপরে উঠে ল্যাজ ঝাপটাচ্ছে। আগের দিন বাঁকুড়া বাজার থেকে মাছ কিনে, সারা দিন সারা রাত দুধভাতকলা খাওয়াতে খাওয়াতে রাতের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে মামাদাদু হাওড়ায় এসে পৌঁছেছেন সাতসকালে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন আর তাঁর ভাগ্নী, মানে আমার মা, সেই জ্যান্ত মাছ দিয়ে স্বর্গীয় এক মাছের ঝোল রাঁধবেন, সেটাই তাঁর বাসনা। বাড়িতে তখন কে যে কখন কোন সময় কোনখান থেকে এসে ঢুকে পড়তেন, কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না। মেদিনীপুর থেকে আসতেন আর এক দাদু। এসেই বলতেন, ‘ছবি (মায়ের ডাকনাম), হারমোনিয়ামটা নামাইয়া দিয়া যা।’ হারমোনিয়াম বাজিয়ে দাদু পাড়া কাঁপিয়ে গান ধরতেন— আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো। আর এক দাদু ছিলেন বদ্ধ উন্মাদের চেয়ে একটু বেশি। এসেই সমস্ত জামাকাপড় মা’র দিকে ছুড়ে দিতেন: ‘ভাল করে কাইচ্যা, মাড় দিয়া, শুকাইয়া রাখবি।’ এক দিন বললেন, ‘আমার রুমাল কই?’ মা বললেন, ওইখানেই আছে। ‘না নাই, নাই, নাই’ বলে, ‘রুমাল, রুমাল’ করে ডাকতে ডাকতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন দাদু। সন্ধেবেলা ফিরে দেখি দাদুর ঘরের দরজা বন্ধ, ভেতরে দাদু যেন কাকে খুব শাসন করছেন। দরজাটা একটু ঠেলে ভেতরে উঁকি মেরে দেখি, দাদু রুমালের এক কোনা ধরে, অন্য হাত দিয়ে একের পর এক থাপ্পড় কষাচ্ছেন আর বলছেন, ‘আর হারাইবি হারামজাদা? আর হারাইবি? বলন নাই কওন নাই হারাইলেই হইল?’ জুতো পরার রেওয়াজ তখন খুব একটা ছিল না। এই দাদুর বাঁ-পায়ের চপ্পল পরে ওই দাদু চলে যাচ্ছেন তো আর এক দাদু অন্য কারও ডান-পায়ের চপ্পল পরে ট্রেনে উঠে প়ড়ছেন। বাকি চপ্পল আমরা লুকিয়ে রাখতাম, যাতে কেউ কোনও দিন কোথাও চলে যেতে না পারে, সবাই যেন আমাদের সঙ্গেই থেকে যায়।
অনেক রকমের দাদু ছিল আমাদের ছোটবেলায়। মায়ের পক্ষ, বাবার পক্ষ, পাড়ার পক্ষ আর কত পক্ষের দাদু! বাড়িতে একসঙ্গে দু’তিন জন দাদু তো হামেশাই থাকতেন। মাঝে মাঝেই এঁদের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যেত, কিন্তু প্রত্যেকেই ছিলেন মজার, আমুদে আর না-গম্ভীর থাকা মানুষ। এক দাদু বাবার সামনে সিগারেট খাবেন না বলে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যেতেন কোনও সিগারেটের দোকানে, তার পর একসঙ্গে তিন-চারটে সিগারেট খেয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসতেন। আমি স্কুল-ফেরত এক বার দেখে ফেলেছিলাম বলে আমাকে এক ঠোঙা আলুর চপ কিনে দিয়ে বলেছিলেন বাবাকে না বলতে।
বাবার যখন সাত বছর বয়স, তখন বাবার বাবা মারা যান। বাবার মেজকাকার নিজের ষোলোটি ছেলেমেয়ে। বাবা আর তার বোনকে নিয়ে মোট হল গিয়ে আঠারোটি বাচ্চাকাচ্চা। রেলের ছোটখাটো চাকরি দাদুর। মাস গেলে ষাট টাকা মাইনে, তার অর্ধেক চলে যায় পুরুলিয়া শহরে বাড়ি কেনার দেনা মেটাতে। বাড়িতে মাত্র এক পো দুধ আসত, আর সেটা নিজের হাতে খাওয়াতেন তারাকান্তকে, মানে আমার বাবাকে। ঠাকুমাকেও তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাঁর কী করে যেন মনে হয়েছিল, তারাকান্তর মাথায় বাকিদের তুলনায় ঘিলু বেশি, দুধ খাওয়ালে সেটা আরও বাড়বে এবং বড় হয়ে সে এক জন কেউকেটা হয়ে উঠবে। বাবা যখন কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিতে যাবেন, দাদু এসে চার আনা দিয়ে টায়ার কেটে তৈরি চপ্পল কিনে দিলেন। বাবার পায়ে সেই প্রথম জুতো। বাবার এই মেজকাকা, আমাদের দাদু, ছিলেন অসম্ভব সুপুরুষ, সুন্দর ও সদাহাস্যময়। আর ঠাকুমা ছিলেন কৃষ্ণ কালো, আঁধার কালো-র কাছাকাছি। ঠোঁট বন্ধ করতে পারতেন না বেচারি, কারণ সামনের কয়েকটা দাঁত সব সময় বাইরেই থাকত। কিন্তু এমন ব্যাপক প্রেমিক দম্পতি আমি আর দেখিনি! পুরুলিয়াতে ঠাকুমার খাটে বসে তাঁর মুখে গল্প শোনা ছিল আমাদের উপরি পাওনা। কিন্তু দাদু ঘরে ঢুকলেই ঠাকুমা আমাদের জোরজার করে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিতেন। তাঁদের শেষ দিন অবধি এমনই কেটেছে।

Advertisement

বাবারই বয়সি তাঁর এক খুড়তুতো কাকা ছিলেন। দুজনে ইয়ার-দোস্ত। দুজন দুজনকে চোখে হারাতেন। হঠাৎ সেই দাদুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। দিন গেল, মাস গেল, অনেক অনেক বছর চলে গেল, তিনি আর ফিরে এলেন না। আমি তখন কলেজে পড়ি, এক দিন বাড়ি ফিরে দেখি, গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসী বসে আছেন। মাথায় বিরাট জটা। বাবার নির্দেশে প্রণাম করলাম। রান্নাঘরে গিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? মা বললেন, ইনি সন্ন্যাসী-দাদু। বাবার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া কাকু। হরিদ্বার লছমনঝুলা হৃষিকেশ পিছনে ফেলে আরও অনেক দূরে কোথাও থাকেন, কিন্তু ঈশ্বরকে তাঁর পাওয়া হয়নি। চোখ বুজলেই তারাকান্তর মুখ ভেসে ওঠে। এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন বলে বাবার ঠিকানা খুঁজে বের করে শেষ পর্যন্ত বাড়ি এসে হাজির। সারা রাত বাবার কাছে শুয়ে থাকলেন। পর দিন সকালে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল ওঁকে হাওড়া স্টেশন থেকে দুন এক্সপ্রেসে তুলে দেওয়ার। বাসে করে হাওড়া যেতে যেতে অনেক কথা বলেছিলেন সন্ন্যাসী-দাদু। বলেছিলেন, ‘সব যায়, তবু মায়া বোধহয় যায় না। আর আমাকে ফিরে আসতে হবে না।’

আর ছিলেন ম্যাজিক-পাগল পেপে-দাদু। দিদিমার ভাই। সব কিছু নিয়ে ম্যাজিক করা ছিল তাঁর বাতিক। মা থালাভর্তি ভাত দিয়ে, ডাল-তরকারির বাটি আনতে গেছেন রান্নাঘরে। এসে দেখেন ভাত উধাও, থালা খাঁ-খাঁ করছে। মা বললেন, ভাত দিই নাই?’ ‘কই দিলি?’ মা আবার ভাত দিয়ে মাছের ঝোলের বাটি আনতে গেছেন, আবার ভাত উধাও। নাকের ফুটো থেকে ঝকঝকে রুপোর পয়সা বের করে আনতেন। মাথার চুলের ভেতর থেকে বের করে আনতেন লক্ষ্মীবিলাস তেলের ছোট শিশি। আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে আবার জুড়ে দেওয়ার খেলা, ম্যাজিক।

Advertisement

ফাঁকা থাকলেই বিকেলবেলা পার্কে চলে যাই। দেখতে পাই, এক এক বেঞ্চে এক এক দাদুর দল। এঁদের কারও মধ্যে তর্ক নেই, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না, কারও মুখেই কোনও মজা নেই। সবার চোখে মনখারাপ লেগে থাকে। এক দিন কাছে গিয়ে বললাম, ম্যাজিক দেখবেন? সবাই আমার দিকে তাকালেন। অদ্ভুত সেই তাকানো। এক জন বললেন, ‘আপনি ম্যাজিশিয়ান?’ আমি মাথা নাড়লাম। তার পর বুড়ো আঙুল কেটে ছুড়ে দিলাম আকাশে, আবার সোঁ করে নিয়ে এসে জুড়ে দিলাম হাতে। সবার চোখে বিস্ময়, মজা, আস্তে আস্তে সবার মুখ ভরে গেল হাসিতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement