আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: গব্বর সিং

অব তেরা কেয়া হোগা, ইন্ডিয়া?

চম্বলের যে টিলাটার ওপর থেকে পুলিশ তাঁকে শেষ বার তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তার তলাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। মাথার চুল পাতলা হয়েছে। তাতে সাদার ছোপ। মোটাও হয়েছেন অনেকটা। একটু দূরে ঘোড়ার লাগামটা ধরে যে দাঁড়িয়ে, তাকে চেনা-চেনা লাগতে লাগতেই চিনে ফেললাম— সাম্‌ভা!

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

গব্বর সিং, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, ডরে, আতঙ্কে থরথরিয়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।

[চম্বলের যে টিলাটার ওপর থেকে পুলিশ তাঁকে শেষ বার তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তার তলাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। মাথার চুল পাতলা হয়েছে। তাতে সাদার ছোপ। মোটাও হয়েছেন অনেকটা। একটু দূরে ঘোড়ার লাগামটা ধরে যে দাঁড়িয়ে, তাকে চেনা-চেনা লাগতে লাগতেই চিনে ফেললাম— সাম্‌ভা!]

প্রতিবেদক: এই ১৫ অগস্টেই তো শোলে-র ৪০ বছর হল। তা হিসেব মতো আপনার বয়েসও তো তা হলে আশি-টাশি হচ্ছে, না কি?
গব্বর সিং: বহোত না-ইন্‌সাফি! ঠাকুরসাবের কাঁটা-মারা বুটের তলা থেকে পুলিশ যখন আমাকে রেসকিউ করে নিয়ে গেল, তখন আমার বয়েস ছিল ৩৭ বছর ৭ মাস ১১ দিন। তা হলে এখন আমার বয়স হচ্ছে ৭৭ বছর ৭ মাস ৮ দিন! ফালতু আশি-ফাশি বলছিস কেন!
প্রতি: এখনও আপনার নিজেকে নিয়ে ওই স্ট্যাটিসটিক্সের ঢাক বাজানোটা বন্ধ হল না! আপনার পিস্তলে ছ’টা গুলি, তিনটে লোক, আপনার মাথার ওপর ৫০ হাজার টাকার ইনাম...
গব্বর: আর ওইটা বল, ‘হিয়াঁসে পঁচাশ-পঁচাশ কোশ...’
প্রতি: আরে দূর মশাই, পঁচাশ কোশ কী বলছেন, পাঁচ কিলোমিটার দূরেও কোনও বাচ্চা এখন আর আপনাকে ভয় পায় না! তা ছাড়া, ওরা এখন অনেক রাত অবধি জেগে ভিডিয়ো গেমস-টেমস খেলে। ভয় দেখাতে গেলে আপনার দিকেই ‘সি.জে’ কিংবা ‘টার্মিনেটর’ লেলিয়ে দেবে! সি জে-কে চেনেন? কার্ল জনসন। আপনার মতো চার-পাঁচটা গব্বর পকেটে নিয়ে ঘোরে।
গব্বর: আরে যাঃ যাঃ! আমাকে বিলিতি গব্বর দেখাচ্ছে! এই ৪০ বছরে বলিউড দিয়ে কত জল গলে গেল! আরে এ সাম্‌ভা, এ ক’টা বছরে বলিউডে কত কিসিমের ভিলেন এল-গেল বল! ন্যাড়ামাথা, টিকিওয়ালা, ঘাড় ব্যাঁকা, চোখ ট্যারা। কারুর গলা গমগমে বাজখাঁই, কারুর খ্যানখেনে ভাঙা, কারুর আবার খসখসে ফাটা। কেউ ১৭০ ডেসিবেল-এ চ্যাঁচায়, কেউ এমন ফিসফিসিয়ে বিড়বিড়োয়, হাফ ডায়লগ শোনা-ই যায় না! নামেরও কত কায়দা— শাকাল, ডক্টর ড্যাং, মোগাম্বো! দুনিয়ায় কোথাও কেউ সাতজন্মে এ সব নাম শুনেছে? কারুর বাপ-মা অমন ধারা বিদঘুটে নাম রাখে? অথচ গব্বর নামটা ইউ.পি-বিহার-মধ্যপ্রদেশের ঘরে ঘরে পাবি। গব্বরের হেয়ারস্টাইল দেখ— ‘নর্মাল’। জামা-কাপড় ঠিকঠাক, মানে এক জন ডাকাত সর্দারের যেমন পোশাক-আশাক পরা উচিত, তেমনটা। তবু গব্বরের মতো ক্যারিশমা তোদের কোন ভিলেনের আছে রে? লোকে হিরোকে ফেলে ভিলেনের ডায়লগ মুখস্থ করছে, কেউ আগে কখনও দেখেছে? তোর ওই পুচকে নোটবইটায় লিখে নে— গব্বর সিং হচ্ছে ভিলেনদের ভিলেন। ওই ‘ইয়ে কি বাচ্চোঁ’ বলে একটা হাঁক পাড়লে না, তোর ওই দশটা মোগাম্বো-ফোগাম্বোর ও সব উদ্ভট কস্টিউম আবার কাচতে দিতে হবে।

Advertisement

প্রতি: প্রচুর তো র‌্যালা মারছেন! আপনি জানেন, যার নামে আপনার নাম, সেই আসলি গব্বর সিং কী চিজ ছিলেন? আপনি কি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ক্রোশ কাঁপাচ্ছেন, পঞ্চাশের দশকে গোটা ইউ.পি-রাজস্থান ওই ডাকু-নেতার ভয়ে কাঁপত। কোনও পুলিশের লোককে ওদের ডেরার ধারেকাছে ঘুরঘুর করতে দেখলেই পাকড়ে এনে নাক-কান কেটে ছেড়ে দিতেন— খ্যাঁচাৎ!

গব্বর: আর আমি কী করেছিলাম? ঘ্যাঁচাৎ! দু’হাতে দুটো তরোয়াল নিয়ে, দু’হাত বাঁধা ঠাকুর সাহেবের দু’কাঁধের ওপর রেখে— উফ্‌ফ্‌, ডায়লগটা বল— ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর— ভাবা যায়! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!

Advertisement

প্রতি: আরে আপনার গায়ের কাঁটা আপনার গায়েই রাখুন মশাই। কোন দুনিয়ায় থাকেন? ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ দেখেছেন? দেখলে এ সব বাত্তেলা মারতেন না। ওখানে একটা লোককে মেরে, শ’খানেক টুকরো করে, কুচিয়ে কেটে, বস্তায় ভরে একটা মাংসের আড়তে ফেলে এসেছিল! পুলিশ এসে এক কুচি কড়ে আঙুল ছাড়া কিচ্ছু পায়নি! ভায়োলেন্স দেখাচ্ছে!

গব্বর: ওরে বোকা, বালতি-বালতি আলতা ঢাললেই ভায়োলেন্স হয়— তোকে কে বলল? ওটা একটা আর্ট। এই তো কত ভিলেনকে দেখি, নায়িকার চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াচ্ছে, থাম্বায় বেঁধে সপাসপ চাবকাচ্ছে। আর আমি শুধু বসন্তীর হাতটা একটু মুচড়ে ধরে কানের কাছে হিসহিসিয়ে বলেছিলাম ‘এতটুকু বেগড়বাই করলে এই তুলতুলে-টুকটুকে চামড়া স্রেফ ছাড়িয়ে নেব’! বসন্তী তাতেই ঘেমে-নেয়ে-বিষম খেয়ে কী রকম অস্থির হয়ে উঠেছিল, তা তো নিজের চোখেই দেখেছিস। বিশ্বাস না হয় তো হেমাজি’কে জিজ্ঞেস করে আয়। আরে, গব্বর ইজ গব্বর! সব ভিলেন বার বার, গব্বর সিং এক বার!

প্রতি: ‘বাজিগর’ দেখেছেন? ওখানে হিরো তার প্রেমিকাকে সাততলার ছাদ থেকে আলসে টপকে ফেলে দিল— কুল্‌! জমানা বদলে গেছে গুরু! এখন নায়িকারা হেলেনের মতো ‘আইটেম’ নাচেন, আর হিরোরাই ভায়োলেন্সের অ্যায়সা ক্যারদানি দেখান, গব্বর সে সব ভাবতেও ভয় পাবেন।

গব্বর: এটা ঠিক বলেছিস, ভিলেনদের আর সেই স্টেটাস নেই। আগে হিরো হিরোর মতো থাকত, ভিলেন ভিলেনের মতো। বদলা-ফদলা, হিসেব-ফিসেব সব চুকে-বুকে গেলে পুলিশ আসত সবার শেষে। ডাকু, স্মাগলার— এরাই ছিল বলিউডের ক্লাসিকাল ভিলেন। তার পর কী যে সব হয়ে গেল! নিষ্কম্মা পুলিশ হল খুনে গুন্ডা-বদমাইশ। ফিতে-কাটা আর পতাকা-তোলা নেতা-মন্ত্রীরা দেশ-বেচে-দেওয়া, ঘুষখোর আর রেপিস্ট! ও দিকে আশি-নব্বইয়ের পর থেকে তো সবাই হয় আইএসআই-এর এজেন্ট, নইলে কাশ্মীরি টেররিস্ট! আরে, ভিলেন ডাকাতি করবে, অ্যাটাচি কেসে সোনার বিস্কুট এ-ধার ও-ধার করবে, মোনা ডার্লিং-এর সঙ্গে ফস্টিনস্টি করবে, কিংবা হেলেন-বিন্দুদের ডান্স দেখবে। তার অত খাটনি পোষায় নাকি? জঙ্গি হওয়ার ট্রেনিং নাও, আরডিএক্স আনাও, সিরিয়াল ব্লাস্ট করাও! যত্ত সব! ভিলেন তো শুধু হিরোর শত্রু! বলিউড তাকে গোটা দেশের শত্রু বানিয়ে দিল। আর ‘ডি কোম্পানি’র মাফিয়া ডন হল ছবির নায়ক। মানে হয়?

প্রতি: কী মুশকিল! পরিবর্তিত পরিস্থিতির ছাপ পড়বে না সিনেমায়? আপনি জানেন, সিনেমার সমাজতাত্ত্বিকরা ‘শোলে’কেও জরুরি অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে-টিলিয়ে কত কী ব্যাখ্যা দেন! সেখানে গব্বর হচ্ছেন সন্ত্রাসের মুখ, আর জয়-বীরু-ঠাকুরসাহেবরা হলেন প্রতিরোধের মহাজোট।

গব্বর: আচ্ছা, ব্যাপারটা উলটো দিক থেকে ভাবছিস না কেন বল তো! গব্বর আর তার কমরেডদের ঘরদোর-চালচুলো কিচ্ছু নেই। বিদ্রোহী-বাগিদের মতোই তারা বনে-বাদাড়ে, গুহায় থাকে, আর ঠাকুরসাব হলেন সরকার-পুলিশ-এস্টাবলিশমেন্টের এজেন্ট। জয়-বীরু তাদের পেটোয়া ভাড়াটে মস্তান। সঞ্জয় গাঁধীর যুব কংগ্রেসে অমন ঠ্যাঙাড়ে লুম্পেন-বাহিনীর কীর্তিকলাপ পাবলিক দেখেনি নাকি!

প্রতি: ওরেব্বাস! গব্বরকে তো আপনি চে গেভারা বানিয়ে দিলেন! খবরটা রামুজিকে দিতে হচ্ছে। তা হলে ‘রামগোপাল ভার্মা কি আগ’-এর পার্ট টু-টাও উনি বানিয়ে ফেলবেন!

গব্বর: খবরদার, ওই লোকটার নাম করবি না! আর ওই জয়! শোলে-তে সিপ্পিরা তোকে জোর করে শহিদ বানাল বলে, তুই রামগোপালের শোলে-তে গব্বর সেজে অমন শোধ নিলি! হ্যাঁ রে নিউ গব্বর, ওল্ড গব্বরকে নিয়ে অমন মশকরা করা যায়?

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement