নীল নির্জন
আমি তো কবিতা লিখছি সেই ছেলেবেলা থেকেই। যখন বছর চারেক বয়স, এক দিন খুব হুটোপাটি করে বাড়ি ফিরে কাকিমাকে বলেছিলাম, ‘রাত হল ভাত দাও।’ কাকিমা শুনে বলেছিলেন, ‘তুই তো বেশ কবিদের মতো কথা বলিস’। আমার কথাটা ছিল খুব সাধারণ। একটামাত্র পংক্তি। অথচ এর মধ্যেই বেশ একটা অন্ত্যমিলের ব্যাপার ছিল। সেটা শুনেই হয়তো কাকিমার ও-কথা মনে হবে।
তার পর বয়সটা যখন আরও খানিক বাড়ল, রোজই চার-পাঁচটা করে কবিতা লিখে ফেলতাম। কবিতা হত না সেগুলো কিছুই। মনে হত যেন কবিতা। আর সেই সমস্ত কবিতা খামে আটকে সব কাগজে পাঠিয়ে দিতাম। তখন কাগজ বলতে ছিল ‘খেয়ালি’, ‘দুন্দুভি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতী’, তার পর বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা তো ছিলই, আর ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘নিরুত্তর’। পটনা থেকে বেরোত ‘প্রভাতী’। আমার পাঠানো কবিতাগুলো অবশ্য কেউ ছাপত না। কবিতার সঙ্গে লিখে দিতাম, ‘মনে না ধরিলে ফেরত পাঠাইবেন।’ সঙ্গে গুঁজে দিতাম একখানা ডাকটিকিট। বেশির ভাগ লেখাই ফেরত আসত না। ডাকটিকিটগুলোও।
তিরিশ বছর বয়সে আমার প্রথম বই বেরল। সেটা ১৯৫৪ সাল। বইখানা প্রকাশ করে সিগনেট প্রেস। তখন সিগনেট-এর কর্ণধার দিলীপ গুপ্ত। যেমন বিজ্ঞাপন জগতে, তেমনই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন এক জন মান্য ব্যক্তি। বাংলা প্রকাশনার ভোল তিনি পালটে দিয়েছিলেন। বইয়ের প্রোডাকশনে এতটুকু খুঁত তাঁর সহ্য হত না। নিখুঁত ছাপা, বাঁধাই।
আমার বইখানার একটা ইতিহাস আছে। আমার কবি-বন্ধুদের সঙ্গে এক দিন কলেজ স্কোয়ারের কাছে ‘ফেভারিট কেবিন’-এ বসে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় আমার বন্ধু অরুণকুমার সরকার, যে নিজেও কবি, আমাকে বলল যে, দিলীপ গুপ্ত মশাই আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে চান। আমি তো শুনে হতবাক। কারণ কবিতার বইয়ের বিক্রিবাটা তেমন তো নয়। তাই গল্প-উপন্যাসের প্রকাশক পাওয়া যেত। কিন্তু নামকরা কবিদেরও প্রকাশক বড় একটা জুটত না। নতুন কবিদের তাই নিজের পয়সাতেই বই বার করতে হত।
দিলীপ গুপ্ত মশাইকে সে দিক থেকেও এক জন ব্যতিক্রম বলা যায়। নামজাদা কবিদের পাশাপাশি আমাদের মতো সদ্য শিং গজানো কবিদেরও বই বার করতে তিনি এগিয়ে আসতেন। তরুণদের মধ্যে তিনি প্রথম নরেশ গুহ-র বই ‘দুরন্ত দুপুর’ বার করেন। কিন্তু এর পরই যে আমার ডাক পড়বে, ভাবিনি। তাই খবরটা প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। ভাবি যে, অরুণ আমার লেগপুলিং করছে। তা কিন্তু নয়। আমি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি, অরুণের হাত দিয়ে দিলীপবাবুকে পাঠিয়েও দিই এবং যথাসময়ে বই বেরিয়েও যায়। বইখানির প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বইতে আমার নাম কিন্তু নীরেন্দ্র চক্রবর্তী। কেন? দিলীপবাবুকে বললাম, ‘আমাকে অ-নাথ করলেন?’ দিলীপবাবু বললেন, ‘না হলে ব্যালান্সটা ঠিক হচ্ছিল না। ‘নাথ’ যোগ হলে ধরাতে পারতুম না। ছবিটা মার খেত।’
বইটা বেরিয়ে যাওয়ার পরে শুনি, দিলীপ গুপ্ত মশাই আসলে আমার বই চাননি। তিনি চেয়েছিলেন অরুণ সরকারের বই। কথাটা শুনে যখন অরুণকে চেপে ধরে বলি, ‘তুই এ কাজ করতে গেলি কেন?’ অরুণ তখন বলে, ‘কী ভাবছিস? তুই আমার চাইতে ভাল লিখিস বলে আমি এ কাজ করেছি? তা কিন্তু নয়। আসলে তোর বই বেরোনোর দরকার ছিল আমার চাইতে বেশি।’ এমন বন্ধু আর পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না!
‘নীল নির্জন’ মূলত রোম্যান্টিক কবিতার সংকলন। তবে বাস্তবের সঙ্গে যে তার একেবারেই যোগ নেই, তা নয়। এর মধ্যে একটি কবিতা আছে, ‘শিয়রে মৃত্যুর হাত’। বাবার মৃত্যুর খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এটি আমি লিখি। বাড়িতে একটা থমথমে ভাব, লোকে আস্তে কথা বলছে। আসলে, কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।
এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি ‘কলকাতার যিশু’।
অনেকটা একই ভাবে লেখা ‘বাতাসি’। বাসে দক্ষিণ কলকাতা থেকে ফিরছি, হঠাৎ পার্ক সার্কাস ময়দানের পশ্চিম দিকের রাস্তাটা থেকে এক জন লোক ‘বাতাসি, বাতাসি’ বলে চিৎকার করতে করতে উন্মত্তের মতো ছুটে বেরলো। তার মাথাভর্তি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। ভাবলাম, বাতাসি ওর কে হয়? মেয়ে? বউ? না প্রেমিকা? যে ভাবে পাগলের মতো ছুটে বেরলো, মনে হল যেন একটা খুনখারাপি কাণ্ড হয়ে যাবে। কী হবে? সে কি ওর গলা টিপে ধরবে? তবে, কবিতা যখন লিখলাম, তখন তাতে বাসের কথাটা লিখিনি। রেলগাড়ির কথা লিখেছি। কারণ, বাসে তো আমাদের সব চেনা দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু রেলগাড়ির ভেতরে সেই অচেনা রহস্যের ব্যাপারটা আছে, সে দিন যে রহস্যের সাক্ষী হয়েছিলাম আমি। তাই নিজের অজান্তেই আমার হাত দিয়ে বেরলো, ‘ধাবিত ট্রেনের থেকে...’
আবার আমার কবিতা কখনও কখনও মানসিক একটা ধাক্কা খেয়ে লেখা। যেমন, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’। বহু বছর আগের ঘটনা। আমার বাড়ির কাছে যশোর রোডের দিকে সদ্য তৈরি হচ্ছে একটা বাড়ি। দেখলাম সেই বাড়ির এক তলার বারান্দায় একটা পাগলি শুয়ে আছে। তার সদ্য এক সন্তান হয়েছে। আর তাকে ঘিরে দিব্যি জমে গিয়েছে জনতা। লোকে খুব মজা পেয়েছে। ঠাট্টা করছে, তামাশা করছে।
এমন সময় ওই বাড়ি থেকে এক ঠিকে কাজের লোক বেরিয়ে এসে বলল, ‘এত যে ঠাট্টা করছ বাবুরা, তোমাদের দেখে লজ্জা হয় না, যে তোমাদের এই শহরে একটা পাগলিরও নিষ্কৃতি নেই?’ এ কবিতা আমি তখন লিখে উঠতে পারিনি। লিখলাম প্রায় তিরিশ বছর বাদে। বাজারে গিয়েছি। মৌরলা মাছ বিক্রি হচ্ছে। দর করলাম। দাম শুনে এক জন মন্তব্য করলেন, ‘দাম যত বাড়ছে, তাতে তো আমরা পাগল হয়ে যাব।’ আর এক জন বললেন, ‘পাগল হলেই কি নিস্তার পাবেন? খেতে তো হবেই!’ এ কথা শুনেই সে দিনের ওই ঘটনার কথা মনে পড়ল। বাড়ি ফিরেই লিখলাম কবিতাটি।
যাই হোক, বই বেরনোর পর আজকাল তো খুব উদ্বোধন, কভার উন্মোচনের চর্চা দেখি। তখন ও-সব ছিল না। তবে, আমার বই বেরনোর পর ‘পেন’ (PEN)-এর উদ্যোগে চৌরঙ্গির একটা বাড়িতে উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয় এমন কবি সম্মেলন বাংলায় আর কখনও হবে বলে তো মনে হয় না।