একটা চকরাবকরা জামা আর জিন্স পরে যে লোকটি আমার ঘরে ঢুকে একটা দুর্দান্ত সারপ্রাইজ দিলেন, তিনি রবিশংকর। হ্যাঁ, যাঁর সংগীতের সঙ্গে আমরা কালচারালি বড় হয়েছি। রবিশংকর যে কত বড়, তিনি যে ভারতের নাম পৃথিবীর মানচিত্রে...ইত্যাদি, সে সব ক্লিশে আর লিখব না। কেবল একটু গর্ব করে নিই। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জন্মদিন উপলক্ষে মুম্বইয়ের তখন বম্বে ভারতীয় বিদ্যাভবনে রবিশংকর আর আলি আকবর খাঁ যুগলবন্দি বাজিয়েছিলেন। আর সেই ঐতিহাসিক কনসার্ট, যা পরে রেকর্ড হিসেবে বেরোয় এবং দুনিয়া জুড়ে হইহই ফেলে, সেটা আমি টিকিট কেটে দেখতে গিয়েছিলাম। সারা রাত শুনেছিলাম।
ওঁকে কাছাকাছি থেকে চিনি, তখনও খুব কাছ থেকে নয়, আইপিটিএ-র সময় থেকে। ‘ধরতি কে লাল’ বলে একটা সিনেমার সুর দিয়েছিলেন। আর ওঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন আইপিটিএ-র সমস্ত সদস্য। পরের গল্পটা আমার ‘মীরা’ সিনেমাটা নিয়ে। সিনেমাটার তখন গোড়ার কাজ চলছে, সেট লাগবে লাগবে। এমন সময় লতাদিদি বললেন, ‘আমি এই সিনেমায় গাইব না।’ ‘সে কী! কেন?’ ‘হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সঙ্গে একটা নন-ফিল্মি অ্যালবাম করছি, এখন অন্য গান গাইব না।’ ও দিকে সিনেমার সুরকার লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল দেখি প্রায়শই গাঁইগুঁই করে গানের ব্যাপারটাকে দেরি করাচ্ছেন। এক প্রাতঃকালে জানতে পারলাম, লতাজি মীরার গলায় গান গাইবেন না বলে ওঁরা সুর দেবেন না। ওকে, তথাস্তু। তখন আমার সেট তৈরি হয়ে গিয়েছে। দিন কয়েক বাদে শুটিং। পঞ্চম আমার বন্ধু। ফলে ও জানতই এ বার এটা ওর ঘাড়ে আসতে চলেছে। ফোন করে বলল, ‘গুল্লু, তুই আমার বন্ধু, কিন্তু লতাদিদি গাইছে না, আমার সুরে আশা গাইলে কনট্রোভার্সি বাড়বে।’ আতান্তরে পড়লাম। প্রেমজি, মানে প্রযোজককে খুলে বললাম সব কথা। বললেন, ‘কোনও ব্যাপার নয়, আমরা না হয় আর এক বার সেট লাগাব। কিন্তু মীরা হওয়া চাই।’
সবাই মিলে খুব খানিক মাথা খাটিয়ে একটা নাম ভেবে পেলাম, যিনি ইন্ডাস্ট্রির মানুষ নন আর সব কনট্রোভার্সির ঊর্ধ্বে। পণ্ডিত রবিশংকর। কিন্তু তাঁকে বলবে কে এ কথা? আমাদের প্রোডাকশনে তখন হেমন্ত চৌধুরী ছিলেন, যিনি কমলাকে চিনতেন। কমলা ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকরের প্রাক্তন স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর বোন। ভারতে রবিশংকরের কনসার্ট সংক্রান্ত সব কিছু তখন উনিই দেখাশোনা করতেন। তিনি বললেন, উনি তো নিউ ইয়র্কে। তোমরা চাইলে ফোন করতে পারো। ফোন করলাম। ও পাশ থেকে একটা মোলায়েম গলায় উত্তর, ‘যদি স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়, তা হলেই করব। আর হ্যাঁ, লতাজিকে নিয়ে কনট্রোভার্সিটা কী? আমি কিন্তু কোনও ঝামেলায় জড়াব না। তুমি স্ক্রিপ্টটা পাঠিয়ে দাও।’ বললাম, ‘আমি যদি নিজে গিয়ে আপনাকে স্ক্রিপ্টটা শোনাই?’ ‘তুমি নিউ ইয়র্ক আসবে?’ ‘হ্যা।ঁ’ কিছু ক্ষণ চুপ। ‘আচ্ছা এসো।’ সেই আমার প্রথম আমেরিকা যাওয়া। পৌঁছে হোটেলে গেলাম। বিকেল নাগাদ, ঘরে বেল। এবং আমার হতবাক, হতভম্ব হওয়ার মুহূর্ত, চকরাবকরা শার্ট আর জিন্স-এ দাঁড়িয়ে রয়েছেন মধ্যবয়স্ক নক্ষত্র।
উনি যে নিজে দেখা করতে আসবেন, কল্পনার অতীত ছিল। কথা হল, পরের দিন বাড়িতে গিয়ে স্ক্রিপ্ট শোনাব। কিন্তু তার আগে লতাজির সঙ্গে উনি কথা বলতে চান। লতাদিদি তখন মিউজিক্যাল ট্রিপ-এ ওয়াশিংটনে। ফোন করলাম। উনি বললেন, ‘যদি রবিশংকর আমায় ফোন করেন, নিশ্চয়ই কথা বলব।’ আমার এ বার বুক ধুকপুক। কী করে পণ্ডিতজিকে বলি, আপনি ফোন করে জেনে নিন? খুব সাহস-টাহস করে, বললাম। রবিদা বললেন, ‘বেশ তো, আমি লতাজিকে ফোন করে নেব।’ সত্যিকারের সাধনা হয়তো মানুষকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।
সামনে তখন ওঁর বেশ কয়েকটা কনসার্ট ছিল বিভিন্ন জায়গায়। উনি বললেন, ফাঁকে ফাঁকে উনি কিছু সুর তৈরি করে রাখবেন, আর কিছু সুর সেপ্টেম্বরে দেশে এসে দেবেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘দাদা, আমি সেপ্টেম্বরে গান রেকর্ডিং করতে চাই।’ বললেন, ‘তা কী করে সম্ভব? আমি সুর করলেও, তোমায় তো আমার সঙ্গে বসতে হবে!’ বললাম, ‘আমি যদি এই কনসার্টগুলোয় আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাই, আর ফাঁকে ফাঁকে সুরের ব্যাপারটা তৈরি হতে থাকে?’ আমার দিকে তাকালেন, প্রথমে একটা স্মিত হাসি, তার পর একটা অট্টহাস্য। যা বললেন, তার মানেটা দাঁড়ায়, ‘ছোকরা, তুমি তো বড় নাছোড় হে!’
লন্ডন গেলাম পণ্ডিতজির সঙ্গে। কাজ হল কিছু। ফিরে এলাম। ফের গেলাম আমস্টারডাম। সেখানে একটা গির্জার মধ্যে অনুষ্ঠান হচ্ছিল: ডাস্ক টু ডন। বেশ কয়েক জন প্রথিতযশা শিল্পী বাজালেন। মাঝরাতের কিছু আগে পণ্ডিতজি বসলেন বাজাতে। তখন অনুভব করলাম, একটা রাত কী করে তৈরি হয়। একটু একটু করে কালো থেকে গাঢ় নীল থেকে আরও গভীর কোনও বর্ণহীন রাত। মোহিত ছিলাম। এক সময় দেখলাম, চ্যাপেলের ছাদের কাছের অনেক উঁচু প্যানেল দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ছে। সেতারে তখন ভৈরবী। সে ভোরও তৈরি করছেন পণ্ডিতজি। চ্যাপেলে বাজছে ভৈরবী, ‘লাস্ট সাপার’-এর আবছা ছবি দেওয়ালে। হঠাৎ একটা ঝাঁকড়াচুলের টগবগে যুবকের কথা মনে পড়ে গেল। মন্টেরে বা উডস্টক-এ যে লোকটা প্রতিভার ঝংকারে প্রায় পুরো পাশ্চাত্যকেই মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিল, না হলে জর্জ হ্যারিসন শিষ্য হয়ে যায়! অনায়াসে সেই যুবক ওদের উপহার দিয়েছিল নতুন ভোর বা বিকেল বা অলৌকিক রাত্রি। এই কাজ আর কে করতে পারে! ভাবছিলাম, ঈশ্বর খানিকটা নিশ্চয়ই এ রকমই দেখতে।