একটা গাড়ি একটা লোক একটা ফোন

আজ সন্ধেয় সে যখন সাইট ছেড়ে গাড়িতে উঠছে, ইভান লক তখনও একটা মস্ত নামজাদা নির্মাণ সংস্থার ভীষণ দক্ষ সাইট ম্যানেজার। কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজে তার জুড়ি নেই। বাড়িতেও বউ ক্যাথরিন আর দুই ছেলেকে নিয়ে তার রমরমা সুখের সংসার। এই তো আজ বাড়ি ফিরেই তার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে প্রিয় দলের ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কথা।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আজ সন্ধেয় সে যখন সাইট ছেড়ে গাড়িতে উঠছে, ইভান লক তখনও একটা মস্ত নামজাদা নির্মাণ সংস্থার ভীষণ দক্ষ সাইট ম্যানেজার। কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজে তার জুড়ি নেই। বাড়িতেও বউ ক্যাথরিন আর দুই ছেলেকে নিয়ে তার রমরমা সুখের সংসার। এই তো আজ বাড়ি ফিরেই তার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে প্রিয় দলের ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কথা। আর কাল সকালেই সাইটে ইউরোপের এযাবৎ সবচেয়ে বড় কংক্রিট ঢালাই কাজের সমস্তটা দেখভালের দায়িত্ব ইভানের। কোম্পানির শিকাগো হেড আপিসের কর্তারা বিপুল আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে এই প্রজেক্টটার দিকে তাকিয়ে আছে। ও দিকে ক্যাথরিনও সসেজ-হটডগ বানিয়ে, বিয়ারের ক্যান-ট্যান গুছিয়ে বসে আছে। ছেলেরাও তাদের ফুটবল টিমের জার্সি পরে, মুখে রংটং মেখে একেবারে তৈরি। কিন্তু এই মুহূর্তে ইভান ম্যাচ-ট্যাচ ছেড়ে, কালকের কয়েক মিলিয়ন ডলারের ঢালাই-প্রজেক্ট চুলোর দুয়ারে দিয়ে, গাড়ি চালিয়ে বার্মিংহাম থেকে লন্ডন যাচ্ছে!

Advertisement

ওখানে বেথান কিছু ক্ষণ আগেই প্রসব বেদনা নিয়ে একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যে বাচ্চাটা আসতে চলেছে, তার বাবা এই ইভান। তার জন্মের সময় ইভান তার পাশে থাকতে চায়। কারণ, ইভানের জন্মের সময় তার ভিতু বাবা, তাকে আর তার মা’কে ফেলে পালিয়েছিল!

এই সব কথাই আমরা অবশ্য জানতে পারি স্রেফ ফোনে কথাবার্তার মাধ্যমে। সিনেমায় সাধারণত যেমন হয়, তেমন দৃশ্যের পর দৃশ্যে, ঘটনার আকারে নয়। গোটা ফিল্ম জুড়ে, পরদায় আমরা দেখতে পাই স্রেফ একটি চরিত্রকেই— ইভান। আর লোকেশন বলতে একটা গাড়ির অন্দর বা ড্রাইভারের সিটটা, স্টিয়ারিং হুইল ও ড্যাশবোর্ডে লাগানো, স্পিকার অন করে রাখা মোবাইল ফোন— সেই সঙ্গে পাশের জানলা কিংবা সামনের উইন্ডস্ক্রিনে মাঝে মাঝেই ঝাপটা মেরে যাওয়া রাতের হাইওয়ে— ছুটন্ত গাড়ির আলোর ফুলকি, চাকার নীচে ছিটকে-পিছলে যাওয়া চকচকে কালো রাস্তা। বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে পৌঁছতে যতটা সময় লাগে, ছবির দৈর্ঘ্যও ততটুকুই। তবে পরদায় একা হলেও ছবিতে ইভান তো একা নয়! তার মোবাইলে একটার পর একটা ফোন আসে। সে-ও বার বার ফোন করে। এই ছবি তৈরির সময়, ফোন কলগুলো আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা হয়নি। শুটিং-এর সময় যখন-যখন ইভানের কাছে ফোন আসছে, তখন-তখনই ‘অভিনেতা’দের দিয়ে ফোন করানো হয়েছে! বা ইভান তাদের ফোন করেছে। এই ‘বাস্তব’-এর বশেই বোধহয়, দর্শক হিসেবে আমরা যেন ইভানের পাশের সিটটায় সেঁটে যাই, তার জীবনের ঝোড়ো ঘণ্টা দুয়েকের সঙ্গী হয়ে পড়ি।

Advertisement

ওই ফোন কলগুলোর সুতোতেই গাঁথা হয়ে থাকে তার চাকরি, সংসার আর সম্পর্কগুলোর হদিশ। আমরা জেনে যাই বেথান নামের ওই বছর ৪৩-এর মেয়েটি ইভানের প্রেমিকা নয়, এমনকী বান্ধবীও নয়। তার সঙ্গে সম্পর্কটা শুধুই এক রাত্তিরের ওয়াইনের নেশা, একাকিত্ব আর শরীরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তবু সে তার চাকরি, পরিবার বাজি রেখে লন্ডন ছুটছে, কারণ বেথানের বাচ্চাকে সে তার নিজের নাম দিতে চায়। তার ‘পলাতক’ বাবাকে এক কাল্পনিক লড়াইয়ে হারিয়ে ভূত করে দিতে চায়!

হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে বেথান যখন ফোনে বলে তার খুব হিসি পাচ্ছে, শীত করছে, কিন্তু ধারেকাছে কোনও নার্সকে দেখতে পাচ্ছে না, তখন ইভান তাকে খটখট করে বলে যায় কী কী করতে হবে, সেই গলাটায় বন্ধুর উদ্বেগটুকুও থাকে না, শুধুই ঠান্ডা, শুকনো কর্তব্য। বেথান যখন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, সেটা সে ফেরায়ও একই রকম নিরুত্তাপ, সান্ত্বনাহীন ভঙ্গিতে। বরং চাকরি চলে যাওয়ার খবর পেয়েও ইভান যখন তার সহকারী ডোনালকে কালকের ঢালাইয়ের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে পরামর্শ দেয়, সেখানে তার আগ্রহ ও আবেগ অনেক আন্তরিক। তবে চাকরি হারানোর চেয়েও, বউয়ের বিশ্বাস হারানোর ধাক্কাটা তার কাছে আরও অনেক বেশি। ক্যাথরিন এ সব শুেন তার সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখতে চায় না। প্রিয় দলের দারুণ জয়ের পরেও ছেলে সীন-এর গলাতেও সেই বিষণ্ণতা ছেয়ে থাকে। ও দিকে বেথানের প্রসবের শেষ মুহূর্তে কিছু জটিলতা। ইভানের গাড়ি এখনও হাইওয়েতে। এই সময়েই ছোট ছেলের ফোনটা আসে। সে চায়, বাবা বাড়ি ফিরে আসুক। রেকর্ড-করা খেলাটা তারা সবাই একসঙ্গে দেখবে— গোলগুলোর সময় এমন ভাবে লাফাবে, যেন এটা কোনও নতুন ‘লাইভ’ ম্যাচ! বেঁচে থাকার বিশল্যকরণীগুলো কি এ ভাবেই জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে? বেথান ফোনে তাদের নবজাতকের কান্না শোনায়। ইভান ভেজা চোখে বাইরে তাকায়। সফ্‌ট ফোকাস-এ রাতের লন্ডনের আলোগুলো কী কোমল, মায়াবী, অলৌকিক— ঠিক জীবনের মতোই!

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement