একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

পুজো পুজো রোদ উঠলেই পুজো বাবদ ইমোশনগুলো ‘সেলাম মেমসাহেব’ বলে মনে-মগজে লাইন দিতে শুরু করে। পুজোর ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য যেই না বাঁশ বাঁধা শুরু হত কিংবা স্কুলে ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠান হয়ে ছুটি পড়ে যেত, আর আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠত আলোকমঞ্জীর... আনন্দ আর দেখে কে! কিন্তু সমার্থকের সঙ্গে বিপরীতার্থকও যমজের মতো এসে উপস্থিত হয়। তাই কষ্টের লাইনও কিছু কম পড়ে না মনের ভেতর।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

পুজো পুজো রোদ উঠলেই পুজো বাবদ ইমোশনগুলো ‘সেলাম মেমসাহেব’ বলে মনে-মগজে লাইন দিতে শুরু করে। পুজোর ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য যেই না বাঁশ বাঁধা শুরু হত কিংবা স্কুলে ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠান হয়ে ছুটি পড়ে যেত, আর আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠত আলোকমঞ্জীর... আনন্দ আর দেখে কে! কিন্তু সমার্থকের সঙ্গে বিপরীতার্থকও যমজের মতো এসে উপস্থিত হয়। তাই কষ্টের লাইনও কিছু কম পড়ে না মনের ভেতর।

Advertisement

তখন আমার সাত কি আট। পুজো মার্কেটিং সেরে আমাদের এক আত্মীয়া ঝড়ের বেগে আমাদের বাড়িতে ঢুকেই আমায় ডেকে বললেন, ‘দেখি তো, তোর জামার মাপটা ঠিক হবে কি না!’ বুকের মধ্যে বাদ্যি। আঙুলের করে তখন দশ। দশ-দশটা জামা। মানে ষষ্ঠী থেকে সকাল-বিকেল পরলে দু’বেলা একটা করে নতুন জামা। এবং সে বছর এই জামাটা হবে কি না তা নিয়ে একটু টেনশনে ছিলাম। কারণ পুজোর আর মাত্র দিন পাঁচেক বাকি, এবং তখনও আমার জামাটা মা’র কাছে জমা হয়নি। কিন্তু হল তো! শেষমেশ সেই আত্মীয়া যে মনে রেখে জামাটা নিয়ে এলেন, তাতে পুরো দিল খুশ। এখনও মনে আছে, ঘন নীল রঙের ফ্রক, আর তার ওপর কমলা সুতো দিয়ে কাজ। কী যে অপূর্ব দেখতে! আমার দারুণ ভাল লাগল। এবং বিশ্বাস যাবেন না, যেই আমার পিঠে জামাটা মাপের জন্য ফেলা হল, পাড়ার পুজোর টুনি লাইট চেক তখনই সাকসেসফুল হল। নতুন জামা, আমার মন আর টুনি একসঙ্গে জ্বলে উঠল।

কিন্তু টুনি লাইটের চেন তো সত্যি সত্যি এক চান্সেই জ্বলে ওঠে না। দু’বার চিড়িক চিড়িক করেই নিভে গেল। সঙ্গে আমার মনও। জামাটা আমার গায়ে বেশ বড়। আত্মীয়া বলে উঠলেন, ‘এ বাবা, এ তো বেশ বড় রে! কী করি?’ বলেই, দিদিকে ডাকলেন। এবং দিদির গায়ে ফেলে দেখা গেল দিদির একদম পারফেক্ট ফিট। আত্মীয়া বললেন, ‘আচ্ছা, তা হলে এটা দিদির জন্যই থাক। তোমারটা আমি দু-এক দিনের মধ্যেই দিয়ে যাচ্ছি।’ খুব খুব কান্না পেল। দিদি পেয়েছে বলে নয়, আমায় অপেক্ষা করতে হবে ভেবে।

Advertisement

এর পর একটা একটা করে দিন যায়। আমি বার বার দরজায় তাকাই, বারান্দায় যাই, মা’কে জিজ্ঞেস করি, আমার জামার ব্যাপারে মা কিছু জানে কি না! কিন্তু মা তখন ব্যস্ত অন্য কাজে, তাই আমার আরও একটা নতুন জামা পাওয়ার আকুলিবিকুলির খবর রাখতে পারে না। পঞ্চমীর বিকেল অবধি ধৈর্য রাখলাম। তার পর আর না পেরে মা’কে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘ও মা, আমার আর নতুন জামা আসবে না?’ মা খুব ক্যাজুয়ালি বলল, ‘না না তা কেন, সপ্তমী থেকে তো পুজো শুরু, কালকেই নিশ্চয়ই দিয়ে যাবে।’

কিন্তু ষষ্ঠী গেল, সপ্তমী গেল, অষ্টমীও চলে গেল, আমার নতুন জামা আর এল না। খুব কাঁদলাম। মা-বাবা অনেক বোঝাল, এত্তগুলো তো জামা রয়েছে। কিন্তু আমি কিছুতেই সেই বিশ্বাসঘাতকতা ভুলতে পারলাম না। সেই রাত্তিরে বালিশে মুখ গুঁজে বড়দের খুব যা-তা বললাম। ওরা আমার মনটা একটুও বুঝল না? আমি যে কত আশা করে ছিলাম নীল জামার ছোট সাইজটা আমার জন্য আসছে, সেটার কি কোনও মূল্য নেই? ছোট বলে কি আমার কষ্ট হয় না? আমায় যে কথা দেওয়া হয়েছিল, তার কোনও দাম নেই? সে বছর ঠাকুর দেখলাম, মজা করলাম, সবই হল, কিন্তু নীল জামার জন্য চিনচিনে ব্যথাটা আর গেল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement