একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

শ্যা মলা রং, বিএ পাশ, বয়স সাতাশ-আটাশ, মা-মরা— আমার সম্পর্কের এক দিদি। তার তখন বিয়ের তোড়জোড় চলছে। হঠাৎ মা বলল, কাল আমাদের বাড়িতে নাকি আমার সেই দিদিকে এক পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। কেন? কারণ ছেলের বাড়ি গরচায়, মান্যবরেরা উজিয়ে উত্তর কলকাতায় মেয়ে দেখতে যেতে পারবেন না। বড্ড দূর তো, পোষাবে না। তাই আমাদের হাজরা মোড়ের কাছের বাড়িতে মেয়েটা টুক করে দেখে নেওয়াটা তাদের সুবিধে।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

শ্যা মলা রং, বিএ পাশ, বয়স সাতাশ-আটাশ, মা-মরা— আমার সম্পর্কের এক দিদি। তার তখন বিয়ের তোড়জোড় চলছে। হঠাৎ মা বলল, কাল আমাদের বাড়িতে নাকি আমার সেই দিদিকে এক পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। কেন? কারণ ছেলের বাড়ি গরচায়, মান্যবরেরা উজিয়ে উত্তর কলকাতায় মেয়ে দেখতে যেতে পারবেন না। বড্ড দূর তো, পোষাবে না। তাই আমাদের হাজরা মোড়ের কাছের বাড়িতে মেয়েটা টুক করে দেখে নেওয়াটা তাদের সুবিধে। আলমারি থেকে মা ভাল বেডকভার বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

Advertisement

আমাদের বাড়ি তকতকে করার হিড়িক পড়ে গেল। মিষ্টি কী কী আনতে হবে, কত বড় সাইজের, তার ফিরিস্তি দেওয়া হল বাবাকে, এবং নোনতা আনার কথা যেন কোনও ভাবেই ভুলে না যায়, সে বিষয়ে সতর্কবাণী প্রায় সাইরেনের মতো বাজতে থাকল রাত্তির থেকেই। এমন সময় বেশ রাতের দিকে ফোন আমাদের বাড়ি, ‘ওরা আসবে না গো দেখতে।’ ‘কেন, কী হল?’ ‘ওদের একমাত্র ডিমান্ড ফর্সা মেয়ে।’ এ দিক থেকে মা রাগে ফেটে পড়ল, ‘ও আবার কী অসভ্যতা! ওদের তো বলেই দেওয়া হয়েছিল যে মেয়ে শ্যামলা। কী আনকালচার্ড!’ ফের আলমারিতে ঢুকে গেল ফুলতোলা বেডকভার।

এমনিতেই দিনটা বাঙালির পক্ষে খুব সুখকর ছিল না। সত্যজিৎ রায় মারা গিয়েছিলেন। গোটা পশ্চিমবঙ্গেই শোক বয়ে চলেছে। তার ওপর মেয়ে দেখতে আসবে কি আসবে না, তাই নিয়ে টানাপড়েন। পরের দিন আবার হঠাৎ সকাল সকাল আমাদের বাড়ি ফোন, ‘ওরা বলেছে দেখতে আসবে গো। হঠাৎ কী হল জানি না। বলল যে, আজ বিকেলেই দেখতে আসবে। আমরা যেন মেয়ে নিয়ে বিকেলের মধ্যে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাই।’ অগত্যা, মনখারাপের মধ্যেও বাবার বাজারের লিস্টি এবং মায়ের ফুলতোলা বেডকভার স্বমহিমায় ফিরে এল।

Advertisement

বিকেল হতে না হতেই দেখি মূর্তিমানেরা হাসি-হাসি মুখে উপস্থিত। পাত্র, পাত্রের দিদি, ছোট কাকা, আরও কে কে যেন এসেছিল। চা-মিষ্টির সঙ্গে দেখনহাসি চালাচালি করেই আমার সেই দিদিকে তাঁহাদের সামনে প্রস্তুত করিবার হুকুম হল। দিদি এল বটে, কিন্তু ওদের যেন দিদিকে দেখার মন নেই। একটা-দুটো মামুলি কথা বলার পরই হঠাৎ পাত্রের কাকা বলেই ফেললেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের বাড়ির সামনে দিয়েই তো সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যাবে, তাই না? কাগজে তো তাই লিখেছে।’

মনে হল কেউ বোম মারল। তার মানে, আমার দিদি নয়, সত্যজিৎ রায়কে দেখতে এসেছেন এই অসভ্য দলটি। এবং বললে বিশ্বাস যাওয়া কঠিন, আমার দিদি কাঁচা হলুদ শাড়ি পরে বসেই থাকল, তাকে পাশ কাটিয়ে কারও অনুমতি না নিয়ে সেই পাত্রপক্ষ আমাদের বারান্দায় গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, যত ক্ষণ না সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যাওয়া হল।

আমরা সবাই হতভম্ব। কিন্তু ওঁরা নিজেদের বুদ্ধির প্রশংসায় উজ্জ্বল। কেমন দাঁওটা মারলুম, ভগবান ঠিক সময় মেয়ে-দেখাটা জুটিয়ে দিয়েছেন— মুখের ভাবখানা ঠিক এমনিই। বার বার বলতে লাগল, ‘আপনাদের বারান্দা থেকে ভিউটা কিন্তু দারুণ। আচ্ছা, আপনারা সবাইকে দেখেছেন, না? মারা যাওয়ার পর সবাইকে নিশ্চয়ই এই রাস্তা দিয়েই নিয়ে যায়? আপনারা কিন্তু হেভি লাকি। কোথাও যেতে হয় না আপনাদের। এখান থেকে বেশ ফাঁকতালে দেখে নেন।’

ঠিক ক’টার সময় সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে, মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, সন্ধের বেশ পরে সেটা, তত ক্ষণ ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করল এবং এক বারও আমাদের সঙ্গে মেয়ে দেখার প্রসঙ্গে কোনও কথা বলল না, বা সেই সংক্রান্ত কোনও ভদ্রতা বিনিময়ও করল না।

মরদেহ আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়ামাত্র তুরন্ত চটি গলিয়ে, ‘আমরা জানাব, আমরা জানাব’ বলতে বলতে পাত্রপক্ষের দ্রুত পলায়ন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement