শুধু ‘চক দে ইন্ডিয়া’তেই নয়, মেয়েরা চুটিয়ে হকি খেলছে কোডাগু জেলার হকি উৎসবে।
সে রাতে কাবেরী আম্মা অনেক কথা বলেছিল— স্মৃতিকথা, লোককথা, তাদের গাঁয়ের অনেক অজানা কথা। বেশ কিছু বুঝিনি, বেশ কিছু ভুলিনি। দোভাষী রমেশ তাদের কুর্গি ভাষার কথোপকথন আধভাঙা হিন্দি, দুর্বোধ্য ইংরেজিতে শোনাতে শোনাতে যাচ্ছিল। ‘আইন হাউস’-এর দালানে নড়বড়ে আলোয় অশীতিপর কাবেরী আম্মার চোখ দুটো মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠছিল। তার সেই চোখ দুটোতে ছিল তাদের কুপ্পান্ডা পরিবারের ঐতিহ্যের অহংকার। এত কীসের অহংকার কাবেরী আম্মার?
এক দিকের জটলায় কুর্গি ভাষায় হইহই। কিছু চেনা শব্দ। টুকরো ইংরেজিতে। সেন্টার ফরোয়ার্ড, পেনাল্টি কর্নার, রাইট হাফ— বেশ খেলা-খেলা ভাব। তাই নিয়ে তর্ক, আলোচনা। সেখানে বাচ্চা, বুড়ো, বাড়ির মেয়েরা, বউয়েরা, কর্তারা, গিন্নিরা সমবেত ভাবে পরের দিনের ‘কুপ্পান্ডা কাপ’-এর ফাইনাল ম্যাচে সম্ভাব্য ফল কী, তাই নিয়ে তক্কাতক্কি জুড়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও— সেই রাতের বেলাতেও হকি-স্টিক ধরে বসে আছে, কেউ বা করছে শ্যাডো প্র্যাকটিস। হকি এদের মজ্জায় মজ্জায়।
এই হকি ফাইনাল যারা দেখেছে, অলিম্পিকের জৌলুসও যেন তাদের কাছে ঠুনকো। বিরাজপেট একে তো ছোট্ট শহর, তায় সকাল থেকে ভিভিআইপি, মন্ত্রীসান্ত্রিদের গাড়ির ঠেলায়, জুনিয়র কলেজ গ্রাউন্ডের বাইরে থেকে শহরের আশেপাশে তিন কিলোমিটার জুড়ে গাড়ি পার্কিংয়ের মিছিলে বেসামাল শহরের রাস্তাঘাট। চারিদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উঁচু উঁচু টিলা। পাহাড়ের কাছে গেলে দেখা যাবে বড় বড় গাছের ছায়ায় শুধু কফিগাছ। কর্নাটকের এই কোডাগু জেলার কুর্গি সম্প্রদায়ের প্রধান আয়ের উৎসই হল কফি। আর তাদের কইলাপলডু ও কাবেরী সংক্রমণ উৎসবের মতোই স্পেশাল উৎসব— এক মাসব্যাপী হকি উৎসব।
কাবেরী আম্মার নাঙ্গালা গ্রামে প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনের ছোট্ট অংশটায় প্রায় প্রতিটা পরিবার হকি খেলায় মগ্ন। ছোট-বড়-বুড়ো-বুড়ি, এখানে সবাই স্টিক ধরতে জানে। কুর্গিদের পরিবারগুলো বংশভিত্তিক। সবাই তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে, তবু হকি তাদের একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে। কোডাগু জেলার কুর্গিদের মধ্যে থেকেই অলিম্পিক খেলতে গেছেন গণেশ, গোবিন্দা, সোমাইয়া, সুব্বাইয়া, পুনাচ্চাদের মতো বিখ্যাত হকি-তারকারা। কিন্তু পরিবার ভার্সাস পরিবার হকি খেলার টুর্নামেন্ট পৃথিবীর আর কোথাও ঘটে কি না জানা নেই।
আইডিয়াটা এসেছিল ১৯৯৭ সালে স্টেট ব্যাংকের প্রাক্তন কর্মী পান্ডান্ডা কুট্টাপ্পার মাথায়। যেখানে প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি বংশ, প্রতিটি সদস্য হকিপাগল; সেখানে পরিবারে-পরিবারে হকি প্রতিযোগিতা আয়োজন করলে এই কুর্গি সম্প্রদায়কে এক সূত্রে গাঁথা যেতে পারে। এই পান্ডান্ডা বংশই এই প্রতিযোগিতার প্রথম স্পনসর।
প্রতি বছর কুর্গিদের এক একটা বংশ প্রতিযোগিতার হাল ধরে। এক মাস ধরে চলে হকি উৎসব। পরিবারের মহিলারাও অংশ নিতে পারে তাদের পরিবারের টিম-সদস্যা হিসেবে। কিন্তু তারা বাপের বাড়ির হয়ে খেলবে না শ্বশুরবাড়ির হয়ে, তা ঠিক করবে তারাই।
কাবেরী আম্মার অহংকার তার বংশকে নিয়ে। ফার্স্ট রাউন্ডেই হেরে গিয়েছে কুপ্পান্ডা পরিবার। কিন্তু তাতে কী? এ বারের হকি কাপ তাদের পরিবারের নামে। কুপ্পান্ডা হকি কাপ। ২৫৫টি পরিবার এ বারের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। ফাইনাল ম্যাচ পরের দিন— চেনডান্ডা পরিবারের সঙ্গে পালানগান্ডা পরিবারের। এত দিনের হকি-উৎসব শেষের আগের দিন কুপ্পান্ডা পরিবারের সবাই হাজির তাদের আইন-হাউসে। এখানে পূর্বপুরুষদের জন্য বরাদ্দ একটি ঘর রয়েছে— যেখানে হালকা প্রদীপ শিখা নিরন্তর জ্বলে। সেখানে সবাই মিলে প্রার্থনা সারল কুপ্পান্ডা পরিবার। পর দিন সব কিছু যেন ঠিকঠাক শেষ হয়। তাদের পরিবারের সুনাম জড়িয়ে আছে যে!
বীণা কুপ্পান্ডা এই পরিবারের ছোট কুলবধূ। কালিয়ান্ডা পরিবার থেকে বছর বারো আগে বিয়ে হয়ে সে এসেছে কুপ্পান্ডা পরিবারে। দর্শনশাস্ত্র নিয়ে বর্তমানে সে গবেষণায় ব্যস্ত। আর ব্যস্ত তার ন’বছরের ছেলে রবিকে হকির নানান কৌশল শেখাতে। আশেপাশের প্রতিবেশীরা দিব্যি জুটে যায় রবির সঙ্গে হকি খেলতে। বীণা এ বার এক বিচিত্র কাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রথম রাউন্ডে মুখোমুখি পড়ে যায় কুপ্পান্ডা পরিবার আর বীণার বাপের বাড়ি— অর্থাৎ, কালিয়ান্ডা পরিবার। দুই তরফেই বীণাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ প্রতিযোগিতার নিয়ম সাময়িক শিথিল করে, একটা অর্ধের কিছুটা খেলেছিল বাপের বাড়ির হয়ে, আর কিছুটা শ্বশুরবাড়ির হয়ে। গোল অবশ্য সে করতে পারেনি, কিন্তু দর্শকদের মনোরঞ্জন হয়েছে বিস্তর।
গ্যালারিগুলো তৈরি হয়েছে সুপুরি গাছের গুঁড়ি দিয়ে। বেশ বড় মাঠ। চারিদিকে গ্যালারি-ঘেরা, রঙিন-রঙিন দক্ষিণী স্টাইলের ফেস্টুনে মোড়া প্রেস বক্স আছে। ভিআইপি গ্যালারি আছে। অলিম্পিয়ান প্রাক্তনীদের জন্যও বরাদ্দ রয়েছে গ্যালারির একটি অংশ। সকাল দশটায় ম্যাচ। তার আগে থেকে দলে দলে কুর্গি সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ট্র্যাডিশনাল ড্রেসে আসতে শুরু করেছে। পুরুষদের কালো লম্বা জোব্বা আর মাথায় লাল পাগড়ি। মেয়েরা শাড়ি পরে পিছনে প্লিট দিয়ে, ঝুলন্ত অংশ মুড়িয়ে দিয়ে এক দিকে আটকে দেয়। রঙের মেলা। দেখতে দেখতে মাঠ ভরে গেল কানায় কানায়। প্রায় তিরিশ হাজার দর্শক। মাদিকেরি থেকে, মহীশূর থেকে, বেঙ্গালুরু থেকে কাতারে কাতারে লোক এসেছে।
প্যাভিলিয়নে দক্ষিণী স্টাইলে ড্রাম, বাঁশি আর নাচ। মাইক থেকে কুর্গি ভাষায় অনবরত কত কী ভেসে আসছে। তবু তারই মধ্যে লেসলি ক্লডিয়াস, অশোক কুমার, ধনরাজ পিল্লাইদের নাম যখন উচ্চারিত হচ্ছে, বুঝতে পারছি। কলকাতা থেকে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এক গ্রামে উচ্চারিত হচ্ছে ক্লডিয়াসের নাম! কলকাতাবাসী হিসেবে আমার কাছে তা বেশ গর্বের ব্যাপার।
হঠাৎ বড় বড় দক্ষিণী ট্রাম্পেট নিয়ে, ঢাক-ঢোল নিয়ে কুর্গিরা তাদের ট্রাডিশনাল ড্রেস পরে মাঠে হাজির। তাদের মাঝখানে তারকা-তারকা ভাব নিয়ে এক স্যুটেড-বুটেড ভদ্রলোকও। তিনি কি কোনও দক্ষিণী নায়ক? খোঁজখবর করে জানলাম, তা আদৌ নয়, তাঁর নাম বীর এবং তিনি এই প্রতিযোগিতার সেরা স্পনসর। ভিআইপি ডায়াসে তখন মান্যগণ্যদের ছড়াছড়ি। কোনও এক মন্ত্রী এসেছেন, এসেছেন গণেশ, সুব্বাইয়া এবং পুনাচ্চা— প্রাক্তন ভারতীয় হকি অলিম্পিয়ান। আর সামনে সাজানো রয়েছে অজস্র ছোট-বড় ট্রফি, তারই মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কুপ্পান্ডা হকি কাপ। কোডাগু জেলার সেরা আইকন। এ বারের টুর্নামেন্টের ফাইনালে ফেভারিট চেনডান্ডা দল পরাজিত হল পালানগান্ডা পরিবারের কাছে। সব উন্মাদনা যেন ছাপিয়ে গেল, যখন সুব্বাইয়ার হাত থেকে কাপ নিল পালানগান্ডা পরিবারের সদস্যরা।
১৭ অক্টোবর ফি-বছর কাবেরী নদীর উৎপত্তিস্থল তালকাবেরীর জল বাড়ে প্রায় চার ফুট। কোডাগু মানুষদের কাছে সেটা কাবেরী সংক্রমণ উৎসব। আর সেখান থেকেই শুরু হয় সারা বছরের প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি। এই হকি-উৎসব এখন গিনেস বুকের পাতায়। কিন্তু তার থেকেও বেশি কুর্গি সম্প্রদায়ের রক্তে, প্রতিটি রন্ধ্রে, নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে।
jaydip63@gmail.com