পাগল হয়েছ নাকি? এই সময় কেউ কাশ্মীর যায়? মারাত্মক বন্যা। এ ছাড়া জঙ্গি উপদ্রব তো সমানে লেগেই আছে, তার ওপর আবার সামনে কাশ্মীর বিধানসভার ইলেকশন। হিংসা-হানাহানি তো এ সময় খুব নর্মাল।’
‘দ্যাখ, প্লেনের টিকিটটা কাটা হয়েছিল গত অগস্ট মাসে, যখন সেপ্টেম্বরে বন্যা হবে, এটা অতি দক্ষ জ্যোতিষীও বলতে পারেনি। না গেলে গাদাখানেক টাকা নষ্ট। তার চেয়েও বড় কথা, গত তিন মাসে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে যত অস্ত্র, বিস্ফোরক আর জঙ্গি ধরা পড়েছে, গত ছ’মাসে গোটা কাশ্মীরে বাজেয়াপ্ত সন্ত্রাস-উপকরণ সম্ভবত তার থেকে বেশি নয়।’
‘যা ভাল বোঝো করো, ফোনটা রাখলাম।’
নভেম্বরের গোড়ায় কাশ্মীরের প্লেনে চেপে বসা ইস্তক মাথার মধ্যে সাবধানবাণীগুলো ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু জম্মু পেরনোর পর শ্রীনগরের পথে ঝকঝকে তুষারশৃঙ্গগুলোর অনবদ্য শোভা দেখে, সব টেনশন উধাও।
এ সময় কাশ্মীর যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম একটাই কারণে, লাল চিনার পাতার রং আর হলুদ পপলারের রং মিলেমিশে ওখানে রঙের এক আশ্চর্য বিস্ফোরণ হয়। সেই দৃশ্যের সাক্ষী থাকব।
তবে মনের আনন্দের রংটা যেন খানিক ফ্যাকাশে হয়ে গেল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে হোটেলে যাওয়ার পথে। শুনলাম, শ্রীনগরে আজ কারফিউ। রাস্তায় দোকানপাট তাই দেখছি সমস্ত বন্ধ, গাড়িঘোড়া-লোকজনও বেশ কম। বন্দুক নিয়ে ফৌজিরাও টহল দিচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বছর সাতেক আগের কথা। লাদাখ যাওয়ার আগে, অগস্ট মাসের এক দুপুরে নেমেছিলাম শ্রীনগর বিমানবন্দরে। সে দিনটাও ছিল কারফিউ। সঙ্গীরা হোটেলে পৌঁছেই বেরিয়ে পড়েছে ডাল লেক-এ শিকারা-বিহারে। অদ্ভুত এক বিরক্তিতে আমার একদমই বেরোতে ইচ্ছে করেনি। চার দিকে থমথমে পরিবেশ, বেয়নেট উঁচিয়ে ফৌজিরা দাঁড়িয়ে আছে, এই বুঝি জঙ্গি হানা হল, এর মধ্যে বেড়ানো হবে কী করে? তার ওপর হোটেলের নীচেই একটা দোকানে এসটিডি করতে গিয়ে দেখি, পুরো দোকান জুড়ে পাকিস্তানের পতাকা আর পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের ছবি আটকানো। পরদিনই ছিল ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ। ভারতের পতাকা বা কোনও খেলোয়াড়ের ছবির চিহ্নমাত্র নেই। মেজাজটা বিগড়ে গেল। শুনেছিলাম, কাশ্মীরে আসা ট্যুরিস্টকে নাকি কোনও কোনও স্থানীয় মানুষ জিজ্ঞেস করেছেন ‘আপ ইন্ডিয়া সে আয়ে হ্যায়?’ তার পরের দিনও কারফিউ। ভোর চারটে নাগাদ শুনশান শ্রীনগর ছেড়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল সোনামার্গ হয়ে লাদাখের পথে। বেলা বাড়লে গাড়ি আটকে পড়তে পারে, সেই আতঙ্কেই ড্রাইভারের এই সিদ্ধান্ত।
তার পর বেশ কয়েক বার কাশ্মীরে এসেছি। এখন অন্য রকম ভাবে জিনিসটাকে দেখি। মনে হয়, কারফিউ জিনিসটা কাশ্মীরে (বিশেষত শ্রীনগরে) যেন দাঁত মাজা, জল খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক। গোলমাল হয়তো ঘটেনি, বা যেটা ঘটেছে, সেটাও নামমাত্র। বড় গোলমাল হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই কারফিউ ডেকে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য প্রধানত একটাই। দোকানপাট যদি বন্ধ থাকে, রাস্তায় লোকজন যদি কম থাকে, তবে হিংসাত্মক কোনও ঘটনা ঘটলেও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা অনেক কম হবে।
গত জুন মাসে, শ্রীনগরে পৌঁছে ডাল লেকের কাছেই একটা হোটেলে উঠেছি। সন্ধ্যাবেলায় চা-পকোড়া নিয়ে বেশ জমিয়ে বসেছি, এমন সময় শুনি ঝনঝন করে কাচ ভাঙার শব্দ। ব্যালকনিতে এসে দেখি, ন’-দশ বছরের গোটা চারেক বাচ্চা ছেলে একটা বড় বাড়ি লক্ষ করে দেদার পাথর ছুড়ছে আর সেই বাড়ির একের পর এক কাচ ভেঙে পড়ছে। বাচ্চাগুলো পিঠটান দিল। কয়েকজন ফৌজি তত ক্ষণে দৌড়ে এসেছে, কিন্তু ধরবে কাকে? হোটেল-মালিকের থেকে জানতে পারলাম, কিছু ক্ষণ আগে খবর এসেছে, গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি হানায় প্রাণ হারিয়েছেন প্যালেস্তাইনের বহু মুসলিম। সুতরাং, আজ সন্ধে থেকেই শ্রীনগর অঞ্চলে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। ভরপুর কারফিউয়ের মধ্যেই এই পাথর ছোড়ার ঘটনা।
বেশ কয়েকবার কাশ্মীরে এসে, সাধারণ মানুষ, কাশ্মীর পুলিশ ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের মূল টার্গেট হল এখানে মোতায়েন মিলিটারি, কাশ্মীর পুলিশ-সহ সামগ্রিক ভাবে গোটা রাষ্ট্রশক্তিই। ফৌজিদের ওপর ঘৃণার কথা তো সবাই জানে। স্থানীয় পুলিশের ওপরেও মানুষের রাগ কী পর্যায়ে, একটা ঘটনা বললেই বোঝা যাবে। এ বারে যে ছিল আমার গাড়ির ড্রাইভার, সেই ইরফানের এক বন্ধু কাশ্মীর পুলিশে কাজ করে। এক সুন্দরী কাশ্মীরি তরুণীর সঙ্গে অনেক দিন ধরেই পুলিশ-বন্ধুটির প্রেমপর্ব চলছিল, মেয়ের বাড়িকে বিন্দুবিসর্গ না জানিয়েই। বিয়ের প্রস্তাব যখন গেল ছেলের বাড়ির পক্ষ থেকে, তখন মেয়ের বাবা-ভাই সমেত পুরো পরিবার এতটাই খেপে গেল, মেয়েকে তো ঘরে আটকে রাখলই, ‘ঘৃণ্য’ পুলিশপাত্রকে হাতের কাছে পেলে খুনও করতে পারে, এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। তার পর প্রায় সিনেমার রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্যের মতোই গভীর রাতে ইলোপ। গোপনে রেজিস্ট্রিটা আগেই করা ছিল, তাই এর পরে কোর্ট ছেলেটির পক্ষেই রায় দেয়। পুলিশ-পরিবৃত অবস্থাতেই সামাজিক বিয়েটাও হয়।
মিলিটারিদের ওপর কাশ্মীরিদের রাগ-ঘৃণার কারণ অবশ্যই আছে। আফস্পা (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট)-র লাইসেন্স হাতে পেয়ে, ফৌজিরা অনেক সময়ই বিনা কারণে, বা ভুল করে সাধারণ মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে কাশ্মীরে। সেটা অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য। তবে, কাশ্মীরের সাম্প্রতিক বন্যায় মিলিটারিরা যে-ভাবে জীবন বিপন্ন করে অসংখ্য কাশ্মীরি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, সেটা কিন্তু দারুণ ভাবে বাহবা কুড়িয়েছে গোটা কাশ্মীরে। সবে ভাবছিলাম, এ বারে বোধহয় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই ঘৃণা অদৃশ্য হবে, বা অন্তত কমে আসবে। আচমকা একটা ঘটনায় আবার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। এই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ঘটনাটা ঘটল। সে সময় প্রশাসনিক সূত্রে খবর ছিল, কিছু জঙ্গি শ্রীনগর ও তার আশেপাশে হামলার মতলব আঁটছে। নভেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে গোলমাল পাকানোটাই হয়তো উদ্দেশ্য। স্বাভাবিক ভাবেই সিকিয়োরিটি খুব টাইট। এক দিন দুটি কিশোর মোটরবাইক চেপে উল্কার বেগে চলেছে রাস্তা দিয়ে। পরপর দুটি চেকপোস্টে মিলিটারিরা তাদের থামতে বলল। সে নিষেধ তারা থোড়াই কেয়ার করে প্রচণ্ড স্পিডে বেরিয়ে গেল। এ বার মিলিটারির গুলির ঝাঁক নেমে এল তাদের ওপর, জঙ্গি সন্দেহে। রাগে, ক্ষোভে উত্তাল কাশ্মীর। শ্রীনগর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কারফিউ। মিলিটারি প্রশাসন থেকে ঘটনার পর ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করা হলেও, ক্ষতি যা হওয়ার, হয়েই গেল। ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, পঞ্চাশ বা তার বেশি বয়সি মানুষদের খানিকটা পাকিস্তানপ্রীতি এখনও থাকলেও, পঞ্চাশের কমবয়সিদের এখনকার দাবি কিন্তু ‘আজাদ কাশ্মীর’। না ভারত, না পাকিস্তান, কেউই তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে না। পাকিস্তান অধিকৃত ‘আজাদ কাশ্মীর’ অঞ্চলে আত্মীয়স্বজন আছে এখানকার বহু লোকেরই। সাপ্তাহিক বাসও চলাচল করে শ্রীনগর থেকে সেই দিকে। চূড়ান্ত আর্থিক অনটন আর খারাপ অবস্থার মধ্যে বসবাস করছে সেখানকার মানুষ, এমনটাই খবর। আর তাই পাকিস্তানের সঙ্গে যাওয়া নয়, এখানকার ‘আজাদ কাশ্মীর’ হবে সত্যিকারের স্বাধীন, সার্বভৌম এক রাষ্ট্র— এটাই এই মুহূর্তে কাশ্মীরের দাবি। একান্ত যদি সেটা না-ও হয়, তবে ‘আফস্পা’ তো প্রত্যাহার করতেই হবে।
একটা কথা এখানে বলা দরকার। জঙ্গিদের আশকারা বা শেল্টার দেওয়া— এগুলো অবশ্যই ছিল কাশ্মীরে। কিন্তু এখন স্থানীয় মানুষেরা অনেকটাই সরে এসেছেন সেই পথ থেকে। কিছু বিক্ষিপ্ত, ব্যতিক্রমী ঘটনা থাকলেও সাধারণ ভাবে অবস্থাটা এই রকমই। পর্যটকদের ওপর আক্রোশ আগেও কাশ্মীরে ছিল না, এখনও নেই। বরং তারা হাউসবোট, শিকারা, দোকান সাজিয়ে সাগ্রহে বসে থাকে কখন পর্যটকেরা আসবে।
ফেরার পথে, শ্রীনগর এয়ারপোর্টে সিকিয়োরিটি চেকিং-এর পর বসার লাউঞ্জে ঢুকে ঘুরছি এ দিক ও দিক। একটা বইয়ের দোকান চোখে পড়ল। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম— কাশ্মীরে সাইট-সিয়িং’এর ওপর ভাল বই কী কী আছে? কাশ্মীরি দোকানদার গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে বইটি বন্ধ করে আমার চাহিদামাফিক বই খোঁজার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমার নজর পড়ল তাঁর বইটির ওপর। লাল রঙে রাঙানো প্রচ্ছদে জ্বলজ্বল করছে— ‘আজাদ কাশ্মীর’।