বাল ঠাকরে, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।
প্রতিবেদক: উদ্ধবের ক্যাপ্টেন্সিতে আপনার সেনারা তো হেব্বি দৌড়চ্ছে! আজ একে কালিতে চোবাচ্ছে তো কাল ওকে! আপনার আমলে রাতের বেলায় চুপিচুপি ওয়াংখেড়ের পিচ খোঁড়া হয়েছিল। এখন দেখুন, দিনেদুপুরে বোর্ডের অফিসে ঢুকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বৈঠক ভন্ডুল করে দিচ্ছে! উন্নতি নয়?
বাল ঠাকরে: উন্নতি না ঘণ্টা! আরে ‘উন্নতি’ তো তখনই বলব, যখন আমার শিবসৈনিক ভাইয়েরা খোদ পাকিস্তানে ঢুকে ওদের মন্ত্রী-সান্ত্রি-আইএসআই ষড়যন্ত্রী, সব ক’টার মুখে-মাথায় কালির বালতি উপুড় করে আসতে পারবে! ওটাই টার্গেট, তবে তার আগে নেট প্র্যাকটিস হিসেবে এটুকু খারাপ না! কিন্তু আমাদের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে হবে। সপ্তাহে একটার বদলে চারটে করে পাবলিককে কালি মাখাতে হবে। যে-সব আঁতেলগুলো রাতারাতি হুজুগে মেতে পুরস্কার-ফুরস্কার কী সব ফেরাচ্ছে, মিডিয়ায় উলটোপালটা বাইট দিয়ে ফালতু কিচাইন করছে, ওগুলোকে ধরে ধরে চোবালেই হয়! স্কোরশিট-এ নম্বরও বাড়বে, মিডিয়ায় হুজ্জোতিও হবে! আর তার চেয়েও বড় কথা— বিজেপি নতুন করে আর একটু প্যাঁচে পড়বে!
প্রতি: সেটা কী রকম? কালি মাখাবেন আপনারা আর বদনাম হবে বিজেপি-র?
বাল ঠাকরে: তুই কী সরল রে! এই মগজ নিয়ে রিপোর্টারি করিস? আরে মারধর, ভাঙচুর, হামলা— শিবসেনা তো এ সব জন্ম থেকে করে আসছে। ওই ট্রেড ইউনিয়ন নেতাটা বহুত শয়তান, মালিকের সঙ্গে ফাইনাল ডিলটা কিছুতেই হতে দিচ্ছে না— ব্যাটাকে গলির মোড়ে পিটিয়ে পাট করে দে! কিংবা মরাঠি কাগজের অমুক সম্পাদকটা বড় টেঁটিয়া— ওর কাগজের অফিসে গিয়ে চেয়ার-টেবিল-টেলিপ্রিন্টার-ছাপাখানা ভেঙে বাবরি মসজিদ করে দে— পরের দিন থেকে সব সম্পাদকীয় তোর ফেভারে! আর এ-সবে শিবসেনার কখনও নাম খারাপ হয় না, বরং খাতিরদারি বাড়ে। কিন্তু বিজেপিকে একটা গণতন্ত্রের ঘোমটা টেনে চলতেই হয়। এই যে সুধীন্দ্র কুলকার্নিকে যারা কালি দিল, আমার উদ্ধব তাদের পিঠ চাপড়ে দিল, বিজেপির কারুর হিম্মত হত? বাবরি মসজিদের কেসটাই দ্যাখ না! যাদের চোখের সামনে সারা দিন গাঁইতি-শাবল চলল, তারাই রাতের বেলায় চোখে জল-ফল এনে, বড় দুঃখের দিন-ফিন বলে কী ন্যাকামোটাই করল! এই শম্মাই তো তখন বুক বাজিয়ে বলেছিল— যে-করসেবকরা বাবরি মসজিদ ধুলোয় গুঁড়োল, তাদের জন্য আমি গর্বিত। একে বলে ‘মর্দাংগি’! মনেও যা, মুখেও তাই! আরে বাবা, আমি যদি মনে করি, ভারত দেশটা হিন্দুদের ছিল, হিন্দুদের আছে, হিন্দুদেরই থাকবে— তা হলে খামকা মিটিঙে গিয়ে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য-ফৈক্য বলে বেকার নেহরুবাজি করতে যাব কেন? মোদীজির ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি, পার্লামেন্টে এতগুলো এম.পি থাকা সত্ত্বেও বিজেপি-কে এখনও কিনা ওই গণতান্ত্রিক হেঁচকিটা তুলতে হয়! নইলে জরুরি অবস্থা নিয়ে বাতেলা করার মুখ থাকবে না!
প্রতি: কিন্তু মোদীও তো ২০০২-এর গুজরাত গণহত্যার জন্য কখনও ক্ষমা চাননি! তা হলে?
বাল ঠাকরে: চায়নি ভাল করেছে! কিন্তু এটা কি বলতে পেরেছে, গোধরার পর ওদের সবক শেখানো জরুরি ছিল, তাই দাঙ্গা করেছি, বেশ করেছি? পারেনি। বরং হলফনামা দিয়ে বলেছে— হুজুর, ধর্মাবতার, আমার কোনও দোষ নেই! ’৯৩-এ মুম্বইয়ে হাজার-বারোশো মুসলমানকে কচুকাটা করে এই বালাসাহেব কিন্তু কলার তুলেছিল! শোন, আধখ্যাঁচড়া কোনও কাজই করবি না। ভায়োলেন্স করবি তো দিল লাগিয়ে করবি। যাকে খতম করতে হবে, তাকে হাফ-মরা ছেড়ে আসলে হবে না। একটা কথা বলি। ওই যে সব বেশি পাকা ইতিহাসবিদরা বলছে না, ভারতের ইতিহাস আসলে সহিষ্ণুতার ইতিহাস, ওগুলো পুরো ঢপ। এখানে কেউ কাউকে কক্ষনও সহ্য করেনি। আর্যরা অনার্যদের করেনি। ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের করেনি। শৈবরা বৈষ্ণবদের করেনি। হিন্দুরা মুসলমানদের করেনি। সুন্নিরা শিয়াদের করেনি। দক্ষিণের ইডলি-দোসাওয়ালারা উত্তরের হিন্দিওয়ালাদের করেনি। কেনই বা করবে? যার গায়ে তাকত আছে, আর বসবার জায়গায় ক্ষমতার তাকিয়া, সে ছোটলোকের চোখরাঙানি সইবে? আবার ধর ভিন-মুলুকের লোক তোর মহল্লায় এসে তোরই রুজি-রুটিতে ভাগ বসাচ্ছে! তুই ‘আহা রে গরিব মানুষ’ বলে সহ্য করবি? কে জানে তোরা বাঙালিরা কী ভাবিস, শিবসেনা কোনও দিন ওই সব ন্যাকাপনা বরদাস্ত করেনি। ষাট-সত্তরের দশকে দক্ষিণীগুলোকে মুম্বইছাড়া করেছিলাম। আশি-নব্বইয়ে ইউপিওয়ালা আর বিহারিগুলোর জিনা হারাম করেছি। এমনকী বিগ বি-কে অবধি ‘ছোড়া গঙ্গা কিনারেওয়ালা’ বানিয়ে ইলাহাবাদে প্যাক করে ফেরত পাঠাচ্ছিলাম! নেহাত ক্ষমা-টমা চেয়ে বেঁচে গেল। এধার ওধার থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে আমার ‘মরাঠি মাণুস’-এর রোজগারে খাবলা মারবে, আর আমি সেটা সহ্য করব? কভি নহি!
প্রতি: হ্যাঁ, পুরনো কাসুন্দি। শিবসেনার ডান্ডা-রাজনীতির পয়লা ইনিংস। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে আপনাদের এত চিড়বিড়ানি কেন? পাকিস্তানিরা তো আর মহারাষ্ট্রে এসে মরাঠিদের চাকরি-বাকরি কেড়ে নিচ্ছে না?
বাল ঠাকরে: তার চেয়েও ভয়ানক কিছু করছে! ওরা আমাদের ঘরের ধারে, ঘাড়ের ওপর ৬৮ বছর ধরে বেঁচেবর্তে রয়েছে। আমাদের সঙ্গে টুকটাক ক্রিকেট-হকি খেলছে। মাঝে মাঝে জিতেও যাচ্ছে। ওদের শিল্পীরা আমাদের গজল-কাওয়ালি শোনাতে আসছে। ওদের নায়ক-নায়িকারা বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে পরদায় জড়াজড়ি করছে। এটা অসহ্য। এর চেয়ে ওরা যদি সম্বচ্ছর একটা করে যুদ্ধ করত আর ফি হপ্তা টেররিস্ট পাঠিয়ে হুল্লাট করত, ঠিক ছিল। কিন্তু ওদের ওই শান্তশিষ্ট পড়শি সেজে থাকা ভাবটা দেখলেই মাথায় খুন চড়ে যায়! তার পরেও এ দেশে যারা ওদের নিয়ে আদিখ্যেতা করতে চায়, আমরা একই মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন বলে কেঁদে ভাসায়, তাদের মুখে-মাথায় আলকাতরা ঢালা ছাড়া উপায় আছে?
প্রতি: কিন্তু আপনাদের এই ‘পাকিস্তানি’ অস্তরটা তো বিজেপি এখন হাইজ্যাক করে নিচ্ছে? বিহারের আম-ভোটার থেকে শাহরুখ খান— যাকে পারছে পাকিস্তানে পাঠাচ্ছে।
বাল ঠাকরে: শোন, আজকের ভারতে জাতীয়তাবাদী হতে গেলে পাকিস্তানকে খিস্তি করতেই হবে। তবে বিজেপি-র ব্যাপারটা পুরো গুলিয়ে গেছে। ওরা পাকিস্তানকে গালও পাড়বে, আবার ‘সহিষ্ণুতা’ দেখিয়ে গুলাম আলির জলসায় পাহারাও বসাবে। আমি চাই ভারতের রাজনৈতিক ডিকশনারি থেকে এই ‘সহিষ্ণুতা’ শব্দটাই ঘুচে যাক। আমার গুরু ও আইডল হিটলার যে ভাবে ভাবতেন, পশ্চিম এশিয়ায় ‘আইএস’ যে ভাবে ভাবছে, সেই ভাবে ভাবা প্র্যাকটিস কর। যা কিছু অপছন্দ, যেটা তোর ইচ্ছের খাপে খাপ যায় না, সেটাকেই ‘অসহ্য’ মনে কর। ধর্মনিরপেক্ষতা? বড্ড হ্যাপা! কথা বলার স্বাধীনতা? মারো গুলি! এমনি করেই দেখবি ওএলএক্স-এর সব মাল বেচে দেওয়া ঘরের মতোই সার্বভৌম ভারতের সহিষ্ণুতার ভাঁড়ার কেমন ফাঁকা ফাঁকা, পরিষ্কার দেখাচ্ছে।
sanajkol@gmail.com