১৯৬৮ সালে দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত একটা ছবি খুব নাম কেড়েছিল। ছবিটির নাম ছিল ‘সংঘর্ষ’। সে ছবি আমার কাছে ঘড়া ভরা মোহর পাওয়ার অভিজ্ঞতা। আমি ছবিটির ডায়ালগ লিখেছিলাম। কিন্তু তার আগে এই ছবির মূল গল্প থেকে চিত্রনাট্য আর ডায়ালগ তৈরি করেছিলেন আব্রার আলভি। কিন্তু কোনও অসুবিধের জন্য, মাঝপথে আব্রার আলভি ছবির কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তখন সেই জায়গায় আমি বহাল হই।
আমার প্রথম কাজ ছিল মূল গল্পটি পড়ে ফেলা এবং তা থেকে ডায়ালগ লেখা। আলভি অনেকটা কাজ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন প্রথম এই কাজটি করতে শুরু করি, আমার মনে হয়েছিল গল্পটি একেবারে গুপ্তধন আবিষ্কার। এই লেখকের ফ্যান আমি অনেক দিন ধরেই, কারণ হিন্দিতে তখন ওঁর অনেক গল্পই অনূদিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই গল্প আমায় যেন বিমুগ্ধ করে দিল। উপন্যাসের নাম ‘লায়লী আসমানের আয়না’। এই গল্প থেকেই ‘সংঘর্ষ’ সিনেমা তৈরি। সেই আমার প্রথম মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে গভীর মোলাকাত। এমনই গভীর, ওঁর লেখা একটি ছোটগল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। স্বচক্ষে দেখা যদিও অনেক পরেই হয়েছে।
এর পর ‘রুদালী’ সিনেমার চিত্রনাট্য ও ডায়ালগ আমি লিখি। আমার কাছে যখন ‘রুদালী’র ডায়ালগ লেখার প্রস্তাব আসে, তখন সেই চিত্রনাট্যের অলরেডি দুটি ভার্শন হয়ে গেছে। আমি প্রথমেই গল্পটা পড়ে ফেলি। এবং আমার সাধ্যমত গল্পের কাছাকাছি চিত্রনাট্যকে নিয়ে আসি, যাতে সিনেমাটা লেখকের ভাবনার একটা রূপ পায়।
এর বহু দিন পর আমার সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর মুখোমুখি আলাপ দিল্লিতে, সাহিত্য অ্যাকাডেমির একটা মিটিং-এ। সেই মিটিং-এর আবার বিষয় ছিল অনুবাদ ও রূপান্তর। ওখানে আমি খুব সরাসরি বললাম যে, যাঁর গল্প অনূদিত বা রূপান্তরিত হচ্ছে, তাঁকে সম্ভব হলে এক বার অবশ্যই দেখিয়ে বা পড়িয়ে নেওয়া উচিত, তা না হলে গল্পের রস অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে যায়। অন্তত রূপান্তরের ক্ষেত্রে তো বটেই। আমি মহাশ্বেতা দেবীর ‘লায়লী আসমানের আয়না’ এবং ‘রুদালী’ গল্প থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করেছি, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি যাতে মূল গল্পের কাছাকাছি থাকা যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দুটো চরিত্রকে একটা চরিত্রে মিশিয়ে দিই কিংবা এক চরিত্রের ডায়ালগ অন্য চরিত্রকে মজবুত করার জন্য তার মুখে বলিয়ে দিই। এটা তো লেখকের অবশ্যই দেখে নেওয়া দরকার। ‘রাইট’ কিনলেই তো আর সব বদলানোর অধিকার জন্মায় না।
দিদি, মানে মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, ‘আরে আমি লায়লী আসমানের আয়না-র স্বত্ব দিয়েছিলাম তো অন্য কারণে। আমি দিলীপকুমারের বিরাট ফ্যান। তাই প্রোডিউসার যখন বলল যে দিলীপকুমার অভিনয় করবেন, আমি আর কিচ্ছু না ভেবে হ্যাঁ বলে দিলাম। আমার হিরো আমার লেখা সিনেমায় অভিনয় করবেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী-ই বা হতে পারে!’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম। এত পুরস্কার পাওয়া, এত সম্মাননীয় এক জন ভারতবিখ্যাত লেখক, তাঁরও কিনা এমনধারা ইচ্ছে। আমরা তো জানি, এঁরা আমাদের মতো সাধারণ নন, বলিউডি আলোকবৃত্তের আকর্ষণের বাইরে থাকেন। ভারী মজা লাগল।
আর ঠিক এর পরেই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তিটা ঘটল। মিটিং থেকে বেরিয়ে এসে দিদি বললেন, ‘গুলজার, তুমি তোমার মেয়ের জন্য যে ছোটদের গল্পগুলো লিখেছ, আমি সব পড়েছি। এমনকী আমি বহু বাচ্চাদের সেগুলো দিয়েওছি। এত সুন্দর লেখা, বাচ্চাদের মন এত ভাল করে বুঝতে পারা— এমন ক্ষমতা হাতে-গোনা লোকের থাকে। তুমি সেই বিরল মানুষদের এক জন।’ আমি তো আনন্দে আত্মহারা। উনি যে আমায় চেনেন এবং আমার রোজকার বলিউডি কাজের বাইরে আমার কাজের খবর রাখেন, সেটা জেনে আমি আপ্লুত। আমার মুখে সে দিন সত্যিই কথা সরেনি। আর সেই দিন থেকে উনি হয়ে গেলেন আমার দিলীপকুমার।
আশ্চর্য এনার্জি! সারা ক্ষণ কাজ করছেন। সারা ক্ষণ নানা কাজের কথা ভেবে চলেছেন। লিখছেন, আন্দোলন করছেন, আদিবাসীদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁদের উন্নতির কথা ভেবে নিজের গল্পের রাইট্স বিক্রি করে দিচ্ছেন সিনেমার জন্য। এমন রোবাস্ট মনের মহিলা আমি বড় একটা দেখিনি। একেবারে অন্য প্রজাতির। বীরাঙ্গনা বোধ হয় এঁদেরই বলে।
এর পরের দেখা ফ্রাঙ্কফার্ট বইমেলায়। ২০০৬-এর ওই বইমেলার ‘ফার্স্ট কান্ট্রি’ বা মূল অতিথি ছিল ভারত। আর মহাশ্বেতাদিদি ছিলেন চিফ গেস্ট। সে দিন উনি একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। নিজের দেশ সম্পর্কে, তার ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে অমন মন ছুঁয়ে যাওয়া বক্তৃতা আমি কখনও শুনিনি। চোখে জল এসে গিয়েছিল। সেই রাতে আর ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পরের দিন ব্রেকফাস্টের সময় দেখি একটা টেবিলে একা বসে খাচ্ছেন। আমি দিদির কাছে গিয়ে নীচে হাঁটু গেড়ে বসে মাথাটা ওঁর কোলের মধ্যে রাখলাম। উনি স্নেহে আমার কপালে একটা চুমু দিলেন। আমার দিলীপকুমারের কাছ থেকে এটা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।