সাতষট্টি সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। ছাপা হওয়ার আগের ঘটনাগুলো স্বাভাবিক ছিল না। গল্প জমা দেওয়ার পরে কয়েক মাস কেটে গেলে জানতে পারলাম ওটা মনোনীত হয়েছে। তার দু’দিন বাদে খামে গল্প ফেরত এল। সঙ্গে ছাপানো চিঠি, যাতে ভবিষ্যতে আমি যেন সহযোগিতা করি। লেখালেখির বাসনা ওখানেই শেষ করে কলেজের চাকরি নিয়ে অসমে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু বন্ধু সুব্রত ভট্টাচার্য বলল, ‘এ তো অন্যায় কথা। প্রতিবাদ কর।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীচে একটা টেলিফোনের বুথ ছিল। পয়সা ফেলে আনন্দবাজারের অপারেটর ফোন ধরলে বললাম, বিমল করের সঙ্গে কথা বলব। বিমলদা ফোন তুলতে যা মনে আসে, তা-ই মুখে বললাম। তার মধ্যে একটা লাইন ছিল ‘লেখক হিসেবে আপনাকে সারা জীবন শ্রদ্ধা করব, মানুষ হিসেবে নয়।’ চুপচাপ শুনে গেলেন। আমার কথা শেষ হলে বললেন, ‘গল্পটি নিয়ে আগামী কাল দেখা করুন।’
তখন ভয়। অপমান করেছি বলে পুলিশে দেবেন না তো! সুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে ওঁর সামনে গেলাম। মাথা নিচু করে লিখছিলেন, আমার নামটা বলতেই মুখ তুলে বললেন, ‘গল্প ভুল করে ফেরত গেছে। প্রেসে পাঠাতে বলেছিলাম, পিওন ভুল করেছে।’
তখন আমার তেইশ বছর বয়স। ‘দেশ’ পত্রিকায় বিখ্যাত লেখকরা লিখছেন। মাকে চিঠি লিখে জানালাম। বাবা ‘দেশ’ রাখছেন তাঁর তরুণ বয়স থেকে। শুনে বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলে স্বপ্ন দেখছে না কি? তা দেখুক, সেটাকে সত্যি ভাবছে কেন?’
তেইশ বছরের যুবকের হাতে ‘দেশ’ এল, সে নিজের নাম পড়ল। গল্পের নাম ‘অন্তরাত্মা’। কিছু দিন পরে টাকা এল গল্পের জন্য। এক সন্ধেবেলায় কফি হাউসে তা উড়ে গেল বন্ধুদের কল্যাণে। তারা বলল, ‘আবার লেখ। কফি-পকৌড়া খাওয়া যাবে।’
তখন মাথায় শুধু গল্প ঘুরত। পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত লিখতাম না। অন্য কোনও কাগজে লেখা পাঠাতাম না। ‘দেশ’-এ বছরে তিনটে গল্প ছাপা হত। এক দিন সাহস করে ‘দেশ’-এর পাশের ঘরে রবিবাসরীয় আনন্দবাজারের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীর সামনে গিয়েছিলাম। তার আগে দূর থেকে দেখেছি, ভদ্রলোক মুখটাকে গম্ভীর করে বসে থাকতেন। মনে হত ইচ্ছে করেই ওটা করতেন। তিনি চোখ বন্ধ করে তাঁর চেয়ারে বসে আছেন। আমি দাঁড়িয়ে, শেষে বললাম, ‘গল্প এনেছি।’ ‘রেখে যান।’ শব্দ দুটো বলতে হয় বলেই বললেন। তদ্দিনে ‘দেশ’ পত্রিকায় অনেকগুলো গল্প লিখে ফেলেছি। ভাবলাম, সে কথা বললে উনি গুরুত্ব দেবেন। শোনামাত্র রমাপদবাবু বললেন, ‘তা হলে ওটা নিয়ে দেশ পত্রিকাতেই জমা দিন।’ চুপচাপ গল্পটি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম ওঁর ঘর থেকে।
বছর তিনেক বাদে, প্রায় বারোটি গল্প দেশে ছাপা হওয়ার পরে, এক বিকেলে আনন্দবাজারের করিডরে ওঁর মুখোমুখি হলাম। পাশ দিয়ে চলে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন। ঘুরে বললেন, ‘একটা গল্প দিয়ে যাবেন তো!’ বলেই নিজের গন্তব্যে চলে গেলেন।
সত্যি কথা বলছি, তখন আমরা দুজন সম্পাদককে খুব ভয় করতাম। এক জন সাগরময় ঘোষ, অন্য জন রমাপদ চৌধুরী। আমরা প্রশ্রয় পেতাম বিমল করের কাছে। বিমলদা স্বীকার করতেন না। বলতেন, ‘দূর! রমাপদ ও-রকম মানুষ নয়।’ বহু বছর পরে যখন ওঁকে রমাপদদা বলে ডেকেছি, তখন বুঝেছি বিমলদা একদম ঠিক বলেছিলেন।
’৬৭ থেকে ’৭৫, এই আট-নয় বছর ধরে ছোটগল্প লিখেছি একের পর এক। কেউ ভাল বলেছে, কেউ বলেনি। বিমলদা বলতেন, ‘এই যে তুই হাত পাকাচ্ছিস, এটা পরে কাজে লাগবে।’ সে সময় এটাই রীতি ছিল। সুনীলদা প্রচুর ফিচার, গল্প লিখেছেন উপন্যাস লেখার আগে। শীর্ষেন্দুদা ‘ঘুণপোকা’ লেখার আগে ছোটগল্পেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমিও ছোটগল্প নিয়ে বেশ ভাল ছিলাম। বছরে তিনটে ছোটগল্প লিখতে কতটা সময় দরকার হয়! আসলে পুরোপুরি লেখক হওয়ার বাসনা তখন মনে ছিল না। ’৭৫-এর জানুয়ারিতে ‘দেশ’ পত্রিকার দফতরে যেতেই বিমল কর বললেন, ‘সাগরদা তোর খোঁজ করছিলেন। দেখা করে আয়।’
সাগরময় ঘোষ আলাদা বসেন। যখন বের হন তখন আমাদের দিকে তাকান না। ওঁর কাছে যেতেন সমরেশ বসু, শিবরাম চক্রবর্তীর মতো খ্যাতনামারা। ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি তাকালেন। বললাম, ‘আমি সমরেশ, মজুমদার।’
‘ও। বসুন।’ সাগরময় ঘোষ বললেন। তার পর ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বার করে এগিয়ে দিলেন। কাগজটি হাতে নিয়ে দেখলাম, ওটা চিঠি। চিঠিতে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক আগামী শারদীয়া সংখ্যার জন্য একটি উপন্যাস প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনা শব্দটি আমাকে সংকুচিত করল। সাগরময় ঘোষ বললেন, ‘পয়লা জুন পাণ্ডুলিপি জমা দেবেন। নতুন কিছু লেখার চেষ্টা করুন।’
হঠাত্ মনে হল, আমি উপন্যাস লিখতে পারব না। আড়াই-তিন হাজার শব্দের গল্প লিখতে পারি, কিন্তু চিঠিতে পঞ্চাশ হাজার শব্দের উপন্যাস চাওয়া হয়েছে। আমার মুখ দেখে সাগরময় ঘোষ হাসলেন, ‘নতুন খেলোয়াড় টেস্ট টিমে সুযোগ পেয়ে যদি কিছু না করতে পারে, তা হলে তাকে আর দলে নেওয়া হয় না। সুনীল প্রথম সুযোগে ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেছিল, সেটা প্রায় পঁচাত্তর রানের সমান। শীর্ষেন্দু ষাট পেয়েছিল, কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছিল সে জাত-লিখিয়ে। বরেন সুযোগ পেয়ে ‘নিশীথফেরি’ লিখেছিল, যা কারও মনে দাগ কাটেনি। ফলে বরেন আর সুযোগ পায়নি। এ বার আপনি নিজের ভাগ্য নিজে ঠিক করুন।’
বেরিয়ে এসে বিমলদাকে চিঠিটা দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘অসম্ভব, আমার দ্বারা উপন্যাস লেখা হবে না। আমি ওঁকে বলতে পারিনি, আপনি বলে দিন।’
বিমলদা বিস্ফারিত চোখে আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘তুই কী রে!’
তখন আমার একটাই চিন্তা, কী লিখব! কোনও কিছুই মনে ধরছে না। যা ভাবছি, তা লিখলে তিন-চার হাজারের বেশি শব্দের দরকার হবে না। আমার তখন অসহায় অবস্থা।
তখন চৌরঙ্গি মার্কেটের তিন তলায় শিল্পী নিতাই দে-র স্টুডিয়োতে আড্ডা মারতে যেতেন বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অভ্র রায়রা। বিকেলে সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা হত। মাঝেমাঝে আমিও ঢুঁ মেরেছি। এক শনিবারের দুপুরে ধর্মতলা পাড়ায় এক জনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাকে না পেয়ে ভাবলাম, নিতাইদার স্টুডিয়োতে গিয়ে সময় কাটিয়ে আসি। ঢুকে দেখলাম নিতাইদা, বরেনদা বেরুবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওই সময় বরেনদার ওখানে থাকার কথা নয়। আমাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুই এখানে এই সময়?’
কারণটা বলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথাও যাচ্ছ?’
বরেনদা বললেন, ‘হ্যাঁ, তুই এখানে বসে থাক। আমরা বিকেলে ফিরব।’
নিতাইদা বললেন, ‘একা বসে থাকবে বেচারা, সঙ্গে চলুক।’
বরেনদার আপত্তি সত্ত্বেও নিতাইদা বললেন, ‘চল। পকেটে কত টাকা আছে?’
‘দশ টাকা।’ কিছু না বুঝে সঙ্গ নিলাম।
ট্যাক্সি থামল রেসকোর্সের তৃতীয় গেটে, আমি অবাক। কিন্তু বাধ্য হলাম পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে। গিজগিজ করছে লোক। হঠাত্ মনে হল আমি রেসকোর্স এসেছি এই খবর যদি বাবা-মা জানতে পারেন, তা হলে কী প্রতিক্রিয়া হবে। হঠাত্ কানে এল, ‘ও বরেন, বরেন!’ তাকিয়ে যাঁকে দেখলাম, তাঁকে আমি রেসকোর্সে দেখব ভাবতেই পারিনি। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে সরে গেলাম। বরেনদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে রেসের বই খুলে আলোচনা সেরে আমাকে বললেন, ‘সঙ্গে পুতুলের মতো না ঘুরে সামনের গ্যালারির ওপরে গিয়ে বোস। আমরা আসছি।’
গ্যালারিতে বসলাম। সামনে সবুজ রেসকোর্স। দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাত্ গুনগুনানি কানে এল। বুঝলাম আমার সামনের বেঞ্চিতে বসে যে প্রৌঢ় বই দেখছেন, তিনিই অন্যমনস্ক গলায় গাইছেন। শব্দ নয়, শুধু সুর। বরেনদারা ফিরে এলে বললাম, ‘এই ভদ্রলোক যদি গানের চর্চা করতেন, তা হলে নাম করতেন।’ বরেনদা প্রৌঢ়কে দেখে ঝুঁকে বললেন, ‘দাদা, এই ছেলেটি নতুন লিখছে। বলছে, আপনি গান গাইলে নাম করতে পারতেন।’ ‘তাই না কি? তা হলে চেষ্টা করি?’ বলতে বলতে তিনি মুখ ফিরিয়ে আমাকে দেখে হাসতেই আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করলাম। কী সর্বনাশ! আমি দেবব্রত বিশ্বাসের পেছনে বসায় ওঁকে চিনতে পারিনি!
রেস আরম্ভ হল। আধ ঘণ্টা পর পর রেস হচ্ছে। যে ঘোড়া জিতছে, তার সমর্থকরা সমুদ্রগর্জনের মতো চিত্কার করছে। একটি রেসে যে ঘোড়াটি সবাইকে পেছনে ফেলে দৌড়চ্ছিল, জয় যার অবধারিত, উইনিং পোস্টের কাছে এসে সে ছিটকে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। তার জকি মাটিতে পড়েও তাকে তুলতে পারল না। যার জেতার কোনও সম্ভাবনা ছিল না, সেই ঘোড়া জিতে গেল। দর্শকরা স্তব্ধ। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটিকে ত্রিপলে ঘিরে ফেলা হল। ডাক্তার পরীক্ষা করে অনুমতি দিলে তাকে গুলি করে মেরে দূরে সরিয়ে ফেলল রেসকোর্সের কর্মচারীরা। জানলাম, রেসের ঘোড়া অক্ষম হলে মেরে ফেলাই নিয়ম। রাজার খেলায় নায়ককে রাজার মতনই চলে যেতে হয়।
হঠাত্ মনে হল, এই যে আমরা, মানুষেরা ক্রমাগত ছুটছি। ছুটছি জেতার জন্য। একটু হাল ছাড়লেই অন্যরা আমাদের ডিঙিয়ে যাবে। কিন্তু পঙ্গু হয়ে গেলে আমাদের মেরে ফেলা শারীরিক ভাবে হয় না, কিন্তু বেঁচে থাকি অর্ধমৃত হয়ে। রেসের ঘোড়ার সঙ্গে এইটেই তফাত। দৌড়ও, শুধু দৌড়ে যাও, পঙ্গু হলেই তুমি শেষ।
উপন্যাস মাথায় এসে গেল। সাত দিনে লিখে ফেললাম সেটা। এই সাত দিন রেসের বিস্তারিত ব্যাপার জেনে নিয়েছিলাম। পয়লা জুনের অনেক আগেই সাগরময় ঘোষের হাতে দিয়ে এলাম পাণ্ডুলিপি, ‘দৌড়’।
কম্পোজ করে জ্যোতিষদা আমাকে প্রুফ দেখতে দিলেন। সেই কাজটাও হয়ে গেল। হঠাত্ সাগরদার চিঠি পেলাম, ‘সমরেশ। জরুরী। দেখা কর। সাগরদা।’ ছুটলাম।
সাগরদা বসতে বললেন। তার পর চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলেন। শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন, ‘ধরো, তুমি দেশ পত্রিকার সম্পাদক এবং আমি নতুন লেখক। তুমি আমাকে উপন্যাস লিখতে বলেছ এবং আমি সেটা লিখে জমা দিয়েছি। হঠাত্ শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস তোমার হাতে এল। সেটা ছাপলে কাগজের সম্মান তো বাড়বেই, বিক্রি হবে প্রচুর। কিন্তু ওই উপন্যাসকে জায়গা দিতে হলে বাকিদের এক জনের উপন্যাস ছাপা চলবে না। তুমি কি বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের কোনও উপন্যাস বাদ দেবে, না নতুন লেখককে সরিয়ে রাখবে?’
আমার চোখে তখন অন্ধকার। টালা টু টালিগঞ্জ, পরিচিতরা জেনে গেছে শারদীয়া ‘দেশ’-এ উপন্যাস লিখছি। কোনও রকমে বললাম, ‘নতুনকে বাদ দেব।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। এসো।’
কী যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছি। ‘দেশ’-এর পুজোর বিজ্ঞাপনে আমার নাম নেই। এমনকী গল্পও চাওয়া হয়নি জায়গার অভাবে। তখন বড় লেখকদের লেখা ছাপা হওয়ার পর জায়গা থাকলে আমাদের গল্প ছাপা হত। বাড়ি আর অফিস করতাম। কোথাও যেতাম না, ঠাট্টা শুনতে হবে, এই ভয়ে।
ডিসেম্বরের প্রথমে ‘দেশ’-এর বিনোদন সংখ্যার বিজ্ঞাপন বের হল। তাতে লেখা হল, একমাত্র উপন্যাস সমরেশ মজুমদারের ‘দৌড়’। এই প্রথম রঙিন ইলাস্ট্রেশন।
হয়তো আর কোনও উপন্যাস ছিল না বলে পাঠক ‘দৌড়’ পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘দৌড়’ বই হয়ে বেরিয়েছিল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে, ’৭৬ সালে। সাগরদাকে বইটি দিতেই তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘পাঠকদের বিচারে তুমি ষাট পেয়ে গেছ। এখন থেকে তোমার দৌড় শুরু হল। দৌড়ে যাও।’
উনচল্লিশ বছর ধরে দৌড়ে চলেছি। তফাত এই শুধু আমার সামনে কোনও উইনিং পোস্ট নেই।