তুনে শাড়ি মে উরস লিয়া চাবিয়াঁ ঘর কি’— এটা কোনও গানের লাইন? তুই আবার এটাকে কবিতা বলছিস? এ রকম খটখটে কথা গানের হয়? গুল্লু তুই ঠিকঠাক কিছু লিখতে পারিস না? আবার এই লাইনগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলছিস আমায় সুর দিতে?’ পঞ্চমের রিঅ্যাকশন। কিনারা সিনেমায় ‘এক হি খোয়াব’ গানের এই লাইন দুটো দেখে। আমায় আবার বলল, ‘শোন তুই বরং এই লাইনগুলো দিয়ে একটা সিন বানিয়ে নে আর আমায় অন্য লাইন দে।’ আমি নির্বিবাদী লোক। বললাম, ‘দ্যাখ পঞ্চম সেটা হতেই পারে, তবে কিনা তোর সঙ্গে যখন কাজ করি, তখন প্রথা ভাঙব বলেই করি তো। তাই...’ আর কিছু বলল না পঞ্চম। সুর করতে আরম্ভ করল। কিছু কথাও এল গানটার মধ্যে। নাটকীয়তা যাতে টানটান হয়ে ওঠে। গানটা তৈরি হওয়ার পর ও ভুপিকে-- মানে গায়ক ভুপিন্দর সিংহ, সে আবার পঞ্চমের সঙ্গে গিটার বাজাত-- তাকে বলল, ‘ভুপি, গিটার নে, রেকর্ডিং রুমে যা, হেডফোনে গানটা শোন, আর তোর যেখানে যেখানে যে নোট লাগলে গানটা কমপ্লিট হবে বলে মনে হয়, সেই নোটগুলো বাজা। ফ্রি হ্যান্ড দিলাম।’ ভুপি তখন ভানুদার (মানে ভানু গুপ্তা, যিনি বহু কাল পঞ্চমের সঙ্গে কাজ করেছেন, আর ভুপির কাছে প্রায় গুরুর মতো ছিলেন) গিটার নিয়ে বাজাতে ঢুকল। এই ইমপ্রোভাইজেশনে গানটা একটা দারুণ মাত্রা পেল। কেবল একটা জায়গায় গিটারে কিঁইইচ করে স্ক্রিচিং সাউন্ড চলে এল। পঞ্চম আরও এক বার টেক নিতে চাইছিল। কিন্তু আমি বারণ করলাম। তখন পঞ্চম আমায় চ্যালেঞ্জ দিল, ‘দেখি তুই কী করে এটাকে ম্যানেজ করিস।’
সিনেমায় গানটার একটা দৃশ্যে হেমাজি আর ধর্মেন্দ্র ক্যারম খেলছিল। এক বার স্ট্রাইকার সেট করার আগে ধর্মেন্দ্র স্ট্রাইকারে একটা চুমু খেয়ে নেয়। ওই চুমু খাওয়ার সময়টায় গিটারের সাউন্ডটাকে ব্যবহার করি। পঞ্চম বলল, ‘আরে, তু নে তো কামাল কর দিয়া গুল্লু।’ দু’বার টেক না হওয়ার খেদটা মিটল। আসলে পঞ্চমের এই খুঁতখুঁতে স্বভাব কিংবা শব্দের ভেতরে ঢুকে তাকে নিজের ভেতরে গেঁথে ফেলার একটা নেশা ছিল। ও যখন সাউন্ড বা সুর বুঝবে তখন আত্মা দিয়ে বুঝবে। আবার যখন ওর জিনিয়াস স্ট্রিক আসবে তখন এক সেকেন্ডে একটা ব্লাস্ট হবে।
আইডিয়ার ঠেলায় সোডার বোতল অবধি রেহাই পায়নি। খুশবু সিনেমায় ‘ও মাঝি রে’ গানটা তৈরি হবে। পঞ্চমকে আমি বলে চলেছি দৃশ্যগুলো কেমন হবে। পঞ্চম জিজ্ঞেস করত, ‘আচ্ছা, এটা কেমন নদী? আচ্ছা এটা কেমন ধরনের গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে? সেখানে রোজকার জীবন কেমন? নদীতে অন্য নৌকা দেখা যাচ্ছে কি?’ আমি বললাম, ‘তুই সুরটা যেমন ইচ্ছে দে না, আমি শুট করে নেব।’ ও বলত, ‘না গুল্লু, তা হলে গানের ডেপ্থ আসে না।’ ও সিনটার মুডটা বুঝতে চাইত। কথা বলতে বলতে ও আমায় হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা, গ্রামে পানচাক্কি থাকে না, তার একটা সাউন্ড করলে কেমন হয়?’ আগেকার গ্রামে জলের ফোর্স দিয়ে পেষাই-কল চালানো হত, সেটাকে বলত পানচাক্কি। সেই পানচাক্কির ডিটেল এক জন সুরকারের মাথায় এ ভাবে আসতে পারে! বললাম, থাকতেই পারে। বলল, ‘দেখবি, একটা অলস রোজকার মানডেন জীবন বোঝাতে একটা ঘ্যানঘেনে মোনোটোনাস শব্দ খুব সাহায্য করে।’ কথা শেষ করেই বাসুদাকে-- যিনি ডাবল বেস বাজাতেন-- বলল, ‘বাসু, দো বোতল সোডা মাঙ্গা।’ বাসুদা খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কেন, এখনই কি...’, ‘না রে, সোডা দিয়ে তোর মুখ ধোয়াব। লে কে আ না ইয়ার’। ক্যান্টিন থেকে সোডার বোতল এল। এ বার পঞ্চম বলল, বালতি নিয়ে এসো। এ বার দুটো বোতল থেকে একটু করে সোডা ঢেলে দেয়, তার পর ফুঁ দিয়ে বাজায়। আবার কিছুটা সোডা ফেলে, আবার বাজায়। কিন্তু দু’বোতলে সোডার লেভেল আলাদা। দুটোর কম্বিনেশনে একটা ‘থুপ থুক, থুপ থুক’ মোনোটোনাস আওয়াজ তৈরি হল। সেটাই এই গানটায় আছে।
আর একটা দারুণ গানের কথা বলবই, ‘ধন্নো কি আঁখো মে চাঁদ কা চুম্মা’। আমি এটুকুই বলেছিলাম, ‘পঞ্চম, এই গানটার এমন সুর কর, যেন ট্রেন চলার নস্টালজিয়াটা বার বার মনের মধ্যে ফিরে আসে।’ গানটার সুর হওয়ার পর আমায় পঞ্চম শোনাল। আমি একটাই শর্ত দিলাম, ‘গানটা তোকে গাইতে হবে, না হলে এই গানটা হবে না।’ পঞ্চম একটু গাঁইগুঁই করছিল, আমি পাত্তাও দিলাম না। গানটা যখন তৈরি হবে তখন ও বলল, ‘গুল্লু, এই গানটায় একটাই ইন্সট্রুমেন্ট বাজবে।’ তখন পঞ্চম একটা নতুন ডাবল-নেক গিটার আনিয়েছে। সেটা থেকে একটা অদ্ভুত সুর বেরোচ্ছে। সেটাই পঞ্চম ওই গানটায় ব্যবহার করবে। আমি বলে উঠলাম, ‘কিন্তু এই শব্দটা শুনে তো ট্রেন যাচ্ছে মনে হচ্ছে না।’ পঞ্চম নাছোড়। বলল, ‘চল একটা কাজ করি। এটাকে তুই আগেই সিনেমায় ইনট্রোডিউস করে দে, যেখানে ট্রেন যাচ্ছে। যাতে এটা যত বার সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে, তত বার মনে হবে ট্রেনটা যেন চলে যাচ্ছে কোথাও।’ তখন আমি এই মিউজিকটাকে সিনেমার টাইটেলে ব্যবহার করলাম। সেটায় ট্রেন যাচ্ছে। গানটা গাইল পঞ্চম। ওই যে ‘ধন্নো কি আঁখো মে’ লাইন দুটো শেষ করে ‘চাঁদ কা চুম্মা’ বলে একটা টেনে দেয়, ওটাই ট্রেনের শব্দ হয়ে ফিরে আসে সুরের মধ্যে, মনের মধ্যে ট্রেনের আওয়াজ হয়ে মিশে যায়। পঞ্চম, দ্য জিনিয়াস।
এই গানটা রামমোহন বলে এক জন ক্যারেক্টার আর্টিস্ট-এর লিপে ছিল সিনেমায়। সিনেমা দেখার পর শাম্মি কপূর এসে আমার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘তুমি আমায় এক বার বললে না গানটায় লিপ দিতে?’ আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘গানটা একটা ট্রেনের মধ্যে, আর চরিত্রটাও বড় কিছু নয়।’ শাম্মিজি আমায় প্রায় উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধুর ধুর, রাখো তোমার ট্রেন আর চরিত্র। গানটা পঞ্চম গেয়েছে। আমি যে কোনও জায়গায়, যে কোনও অবস্থায় পঞ্চমের গানে লিপ দিতে পারি।’ শাম্মিজি এই রকম বড় ফ্যান ছিলেন পঞ্চমের।
পঞ্চমের এই জিনিয়াসামির কথা যত মনে পড়ে তত যেন মনের ভেতরটা আলো হয়ে যায়। আর ভাবি আমি কত বড় জিনিয়াসের সঙ্গে কাজ করেছি। অথচ যখন কাজ করেছি, তখন বুঝিনি যে ও কত বড় জিনিয়াস। আসলে কেউ যখন একটা গতির সঙ্গে ছোটে তখন সে কি আর বুঝতে পারে গতিটা কত। পরে যখন বাইরে থেকে দেখে তখন বোঝে। যেমন প্লেন বা স্পেস শাট্ল, তেমনই। এখন যখন পঞ্চম নিজেকেই দূর থেকে দেখতে বাধ্য করেছে, তখন বুঝতে পারি। কেমন যেন মনে হয়, আরও একটু সময় যদি ওর সঙ্গে কাটিয়ে নিতাম! তবে কোনও দিন কি আমার কোটা ওর সঙ্গে পূর্ণ হত?