প্রভু দাসী প্রজাপতি

ইভলিন তার সাইকেলটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো মস্ত বাড়িটার দরজায় এসে দাঁড়ায় আর খানিকটা জড়সড় হয়েই কলিংবেলটা বাজায়। তার পর সিন্থিয়া যখন দরজা খুলেই কড়া গলায় ধমক দেয়— আজও দেরি, আর একটু পরেই ইভলিনকে ন্যাতা-বালতি নিয়ে ঘর মুছতে দেখা যায়, তখন মনে হবে, এ পরিচারিকা।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ইভলিন তার সাইকেলটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো মস্ত বাড়িটার দরজায় এসে দাঁড়ায় আর খানিকটা জড়সড় হয়েই কলিংবেলটা বাজায়। তার পর সিন্থিয়া যখন দরজা খুলেই কড়া গলায় ধমক দেয়— আজও দেরি, আর একটু পরেই ইভলিনকে ন্যাতা-বালতি নিয়ে ঘর মুছতে দেখা যায়, তখন মনে হবে, এ পরিচারিকা। কিন্তু তার পরে, সিন্থিয়া যখন ইভলিনকে দিয়ে গা-হাত-পা টেপায় আর চামড়ার সঙ্গে সেঁটে থাকা স্কিনিটাকে একটু একটু করে সরিয়ে ইভলিন তার নগ্ন পায়ে আলতো করে হাত বোলাতে থাকে, তখন শরীরে শরীর ছোঁয়ার রসায়নটাই বলে দেয়, এটা ঠিক চাকরানিকে দিয়ে মালকিনের পদসেবার ব্যাপার নয়। সিন্থিয়া অবশ্য একটার পর একটা ফরমায়েশ চালিয়েই যায়। আর কাজে ভুল হলেই, ইভলিনকে হিড়হিড় করে বাথরুমে টেনে নিয়ে গিয়ে ‘সাজা’ দেয়! বন্ধ স্নানঘরে শাস্তির ‘ধরন’টা ঠিক কী রকম, অস্বচ্ছ কাচের দরজার ও-ধার থেকে আমরা আন্দাজ করে শিউরে উঠি। তার পর রাতে, শোওয়ার ঘরে যখন দুজনকে নিবিড় আদরে ভেসে যেতে দেখি, বুঝতে পারি, সারা দিনের ওই হুকুমদারি-জোরজুলুম-শাস্তি, সবটাই আসলে প্রেমের অভিনয়— ‘লাভ অ্যাক্ট’!
এ ছবির পরিচালক দর্শকদের সঙ্গে খেলতে ভালবাসেন। এখানে তিনি দুই নারীর প্রেমকে ‘বিডিএসএম’ বা বন্ধন-আধিপত্য-ধর্ষ ও মর্ষকামের খেলার ছকে ফেলেছেন। কিন্তু একটু পরেই, ছকটা তছনছ! মনে হচ্ছিল আধিপত্যের সুতোটা সিন্থিয়ার হাতে, ক্রমশ বোঝা যায়, ব্যাপারটা একদম উলটো! নির্যাতনের পুরো চিত্রনাট্যটাই আসলে ইভলিনের বানানো। তার মর্ষকামী প্রেমের তীব্র বাসনাই বরং সিন্থিয়ার শরীর-মনকে ব্যবহার করে। সে-ই সিন্থিয়ার কাছ থেকে নিত্যনতুন যন্ত্রণা যাচনা করে। তাকে নিগ্রহ করার ‘আদেশ’ করে, বিশদ ভাবে নির্দেশগুলো লিখে দেয়! অত্যাচারের সময় নিষ্ঠুর অ্যাটিটুডে শিথিলতা দেখলেই, সিন্থিয়াকে বকে।

Advertisement

এক সময় সে চায় সিন্থিয়া তাকে ‘শাস্তি’ হিসেবে মস্ত সিন্দুকটার ভেতর হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখুক। যৌবন পেরিয়ে আসা সিন্থিয়া ইভলিনের ‘প্রেমের চাহিদা’র সঙ্গে সব সময় তাল রাখতে পারে না। সিন্দুক টানতে গিয়ে তার কোমরে খিঁচ ধরে যায়। সে প্রেমে সাহচর্য চায়। কিন্তু ইভলিন চায় যৌনতার বৈচিত্র। সঙ্গিনীকে সিন্দুকে ফেলে রাখার চেয়ে নিজের কাছে রাখতে উৎসুক সিন্থিয়া তাই গোমড়া হয়ে কাজগুলো করে যায়, আনন্দের বদলে এটা তার শুকনো কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় সে বিদ্রোহ করে, ইভলিনের প্ল্যানের বাইরে গিয়ে আদেশ করতে থাকে। সেই আদেশ পালন করতে ইভলিনকে এতটুকু খুশি হতে দেখা যায় না। মানে, তার আনন্দটা নিগৃহীতা হওয়ায় নয়, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নিগৃহীতা হওয়ায়! সিন্থিয়া শেষমেশ ইভলিনকে অন্য নারীর প্রতি অনুরক্ত হওয়ার অভিযোগেও যা-তা বলে। সেটা সত্যি না বানানো, কে জানে। ইভলিন তো নোট নেওয়ার সময় অন্য নারী-প্রফেসরের দিকে মুগ্ধ চাউনি দেয়!

কীসের নোট? এই আশ্চর্য অঞ্চলে জোড়ায় জোড়ায় মেয়েরা থাকে, প্রভু-দাসী সমীকরণে। আর সারা ক্ষণ প্রজাপতি বিষয়ে সেমিনার করে। সিন্থিয়াও প্রজাপতি নিয়ে কাজ করে। ছবির নামটিও এক ধরনের প্রজাপতির। প্রজাপতিরা ক্রমাগত উড়ে ফ্রেম ভরিয়ে, ছবিটাকে প্রায়ই বাস্তবের বাইরে নিয়ে যায়। সোজা ন্যারেটিভে চলতে চলতে কখন যে পরাবাস্তব দৃশ্য শুরু হয়ে যাবে, আর দর্শক তার মানে খুঁজতে না খুঁজতে ফের বাস্তব এসে সুতো ধরবে, ছবিটার এই আর এক খেলা। যখন মনে হচ্ছে দুই পাত্রীর বিচ্ছেদ আসন্ন, ছবি আবার শুরুর জায়গায় ফিরে আসে। সাইকেলে চড়ে ইভলিন সদর দরজায়, সিন্থিয়া দরজা খোলে। তা হলে কি শুরু হবে নতুন কোনও খেলা? না, আগের খেলাই চলবে? যে কোনও খেলাই কি জীবনের মতো আসলে ক্লান্তিকর? যে কোনও সম্পর্কই কি শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে বদলানোর মতো প্রথমটায় আশ্চর্য আর পরে নিতান্ত পাতি, প্রেডিক্টেব্‌ল?

Advertisement

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement