হ্যালো 80's

বুলেট ছুটে এল দর্শকের দিকেই

মার্চ ১৯৮৫। আমার বয়স তখনও পুরো ন’বছরও হয়নি। শুনলাম শহরে নাকি অদ্ভুত এক ছবি রিলিজ করেছে, যার নাম থ্রি-ডি সিনেমা। সিনেমা হল থেকে দেওয়া বিশেষ এক চশমা পরে নাকি দেখতে হয় সেই ছবি। আর তার পর চোখের সামনে যা ঘটতে থাকে, সে ভারী অদ্ভুত এক আমোদ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

আশির দশকে তৈরি প্রথম হিন্দি থ্রি-ডি ছবি ‘শিবা কা ইনসাফ’-এর পোস্টার। থ্রি-ডি চশমার লেন্সে জ্যাকি শ্রফ-এর অ্যাকশন হয়ে উঠেছিল সুপারহিট

মার্চ ১৯৮৫। আমার বয়স তখনও পুরো ন’বছরও হয়নি। শুনলাম শহরে নাকি অদ্ভুত এক ছবি রিলিজ করেছে, যার নাম থ্রি-ডি সিনেমা। সিনেমা হল থেকে দেওয়া বিশেষ এক চশমা পরে নাকি দেখতে হয় সেই ছবি। আর তার পর চোখের সামনে যা ঘটতে থাকে, সে ভারী অদ্ভুত এক আমোদ। পরদা থেকে সিনেমার সব কিছু বেরিয়ে ধরাছোঁওয়ার মধ্যে চলে আসে, পরদায় ছোড়া মোহর-তির-বর্শা-বুলেট, সব কিছুই ছুটে আসতে থাকে দর্শকদের লক্ষ্য করেই! মানে, সত্যি সত্যি আসে না, কিন্তু ঠিক ওই রকমই মনে হয় আর কী।

Advertisement

মাস্টারমশাইয়ের কাছে শুনলাম, থ্রি-ডি মানে থ্রি-ডাইমেনশন। দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ, এই দুটো ডাইমেনশনের সঙ্গে ছবিতে ‘গভীরতা’ নামের থার্ড ডাইমেনশনটা জুড়ে দিতে পারলে, তাকেই বলে থ্রি-ডি ছবি। আমরা তখন থাকতাম শ্যামবাজারে। বাড়িতে খুব একটা সিনেমা দেখার চল ছিল না। কিন্তু এমন মজার জিনিস তো ছাড়া যায় না! মাসি-মেসো আর দুই মাসতুতো দিদি থাকত টাটানগরের কাছে জাদুগোড়ায়। কয়েক মাস অন্তর তারা বেড়াতে আসত কলকাতায়, আর তখন সবাই মিলে হইহই করে সিনেমা দেখা ছিল মাস্ট। সে বারও তাই হল। সঙ্গে আবার ভিড়ল যাদবপুরের মামা-মামি, মামাতো দাদা। সবাই হাজির হলাম ধর্মতলার এলিট-এ। আর পরের তিন ঘণ্টায় যা হল, তাকে ম্যাজিক বলাই ভাল, মির্যাক্‌ল বললেও ক্ষতি নেই!

সিনেমাটার নাম ‘শিবা কা ইনসাফ’। জ্যাকি শ্রফ আর পুনম ধিলোঁকে নিয়ে রাজ এন সিপ্পির পরিচালনায় নিছকই বম্বে-ফরমুলায় তৈরি এই ছবি গোটা দেশ জুড়ে ব্লকবাস্টার হিট হয়ে গেল স্রেফ নতুন একটা প্রযুক্তির দৌলতেই। ছবিটা রিলিজ করেছিল ’৮৫-র ১৫ মার্চ। তার ক’দিন পরই শহর কাঁপাতে চলে এল আর একটা থ্রি-ডি সিনেমা, ‘ছোটা চেতন’। একে ছোটদের ছবি, তায় ভারী মিষ্টি মজার এক ভূতের গল্প। আমায় আর পায় কে? এ বার মাসি-মেসোর অপেক্ষায় না থেকে আবদার জুড়লাম মায়ের কাছেই।

Advertisement

এ ছবি দেখতে গিয়ে আর এক কাণ্ড। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি সে দিন! শ্যামবাজার থেকে ট্রামে হিন্দ সিনেমা হলে যাওয়ার সময় হঠাত্‌ মা আবিষ্কার করল, ব্যাগ থেকে ছোট্ট পার্সখানা উধাও। ঝানু পকেটমারের কীর্তিতে দুজনেরই মাথায় হাত। কী হবে? ওর মধ্যেই তো সিনেমার টিকিট দুটো! শেষে সেই বাদুলে দুপুরে মা আর আমি কাকভেজা হাজির হলাম হিন্দ সিনেমার ম্যানেজারের কাছে। তিনি সহৃদয় এক ভদ্রলোক, হাউসফুল সিনেমা হল-এর সিট চার্ট দেখে কী এক গোপন ম্যাজিকে খুঁজে বের করলেন আমাদের সিট দুটো। মা আর আমি চুটিয়ে দেখলাম ছোট্ট ভূত চেতন-এর দারুণ মজার সব কাণ্ডকারখানা, ঘরের সব দেওয়াল-ছাদ জুড়ে তার হেঁটেচলে বেড়ানোর অবাক বৃত্তান্ত। কী ভাল যে লেগেছিল! পরে জেনেছি, ‘ছোটা চেতন’ আসলে ভারতে তৈরি প্রথম থ্রি-ডি ছবি ‘মাই ডিয়ার কুট্টিচাথান’ (১৯৮৪-র ২৪ অগস্ট রিলিজ করেছিল)। মূল ছবিটা হয়েছিল মালয়ালম ভাষায়, ‘ছোটা চেতন’ হিন্দি ডাব্‌ড ভার্সান।

বাড়ি ফিরে আনন্দে লাফাচ্ছি, মা আলমারি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল সেই ছোট্ট পার্সটা, আর তার মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকা সেই টিকিট দুটো। হায় রে, পুরোটাই তা হলে আমার ভুলোমনা মায়ের অনিচ্ছাকৃত অন্তর্ঘাত!

সেই বছরই রিলিজ হল আর একটা থ্রি-ডি ছবি, বাংলায়! নাম ‘মহারুদ্র’। খোঁজ করে জানলাম, এ-ও আসলে ‘মহাশক্তিমান’ নামের একটা হিন্দি ছবির ডাব্‌ড ভার্সান। থ্রি-ডি ছবি নিয়ে বাজারে তখন ব্যাপক ক্রেজ। ফায়দা তুলতে বেরল থ্রি-ডি কমিক্সও। কমিক্স-এর বই বা ছবির অ্যালবামগুলো বেশ মনে আছে, সঙ্গে থাকত সাদা আর্ট-পেপারে তৈরি লাল-নীল সেলোফেনের থ্রি-ডি চশমা। একটা বাংলা কমিক্‌স, ‘রহস্য চশমা ও শয়তান’, আর ইংরেজি ছবির একটা অ্যালবাম, ‘অ্যামেজিং থ্রি ডি’, এখনও সংগ্রহে আছে। দুটোরই দাম ছিল ছ’টাকা করে। সঙ্গের চশমাটা গোড়ায় খুব সস্তা ঠেকে ঠিকই, কিন্তু সেই চশমাই চোখে লাগাতে কেয়াবাত!

অনেক পরে, ১৯৯৮-এ আবার রিলিজ হয় আমার ছোটবেলার সেই ‘ছোটা চেতন’, আর লাইট হাউস-এ একা একা সেই ছবি দেখতে গিয়ে দেখি, কী কাণ্ড, পুরনো ছবিটার মধ্যে কী ভাবে যেন ঢুকে পড়েছে বলিউডি নায়িকা ঊর্মিলা মাতন্ডকর! আইটেম ডান্স জুড়ে যতই ছবিটার ডিমান্ড নতুন করে বাড়ানোর চেষ্টা হোক, ছোট্টবেলার সেই মজাটা আর পাইনি।

এখন, যখন মাল্টিপ্লেক্সগুলোয় সেভেন-ডি আর ইলেভেন-ডি ছবির রমরমা (ছবি চলাকালীন সিটটা ঝাঁকুনি দিতে শুরু করলে সেটাও নাকি একটা ডাইমেনশন), আর ক্রিস্টোফার নোলান ‘ইন্টারস্টেলার’ বানিয়ে ফিফ্থ ডাইমেনশনে পৌঁছে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন, তখন থ্রি-ডি ছবি নিয়ে চূড়ান্ত মশকরাটা ঘটতে দেখলাম এ শহরেই।

২০১৪-র কলকাতা ফিল্‌ম ফেস্টিভ্যালে গদার-এর নতুন ছবি ‘গুডবাই টু ল্যাংগোয়েজ’ থ্রি-ডি’তে তৈরি বলে নন্দনে দেখানোই গেল না। অবাক লাগলেও সত্যি, আশির দশকেই তৈরি নন্দনে আজও থ্রি-ডি ছবি দেখানোর কোনও ব্যবস্থা নেই! ভাবছিলাম, থ্রি-ডি ছবি দেখানোর দৌড়ে কি ২০১৪-র কলকাতাকে দশ গোল দিয়ে হারিয়ে দিল আশির দশকের কলকাতা?

ভাস্কর রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড, কলকাতা

bhaskar.film@gmail.com

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন