জা স্ট যা চ্ছি

বালির দানা জলের ডানা

জো য়ারের সময় এখন। মাথার ওপর কড়া সাদা আকাশ। তার ঠিক মাঝখানে সূর্য। এত তেজ যে তাকানোই যায় না। আলোর দাপটে সব মেঘ পালিয়েছে। শুষে নিয়ে গেছে আকাশের নীলকে। পায়ের কাছে বালিতে নিজের ছায়াটাও জড়সড়, জল চলে এলেই আর নেই। জল ফিরে যাওয়ার সময় অলৌকিক ব্যাপার। নোনতা ঘামে ভেজা কালো শরীরে ফেলে যাওয়া সাদা ফেনার বুদ্বুদ। তাদের উচ্ছ্বাস পছন্দ নয় এ পুণ্যভূমির।

Advertisement

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ২০:৪৪
Share:

ছবি: শুভময় মিত্র

জো য়ারের সময় এখন। মাথার ওপর কড়া সাদা আকাশ। তার ঠিক মাঝখানে সূর্য। এত তেজ যে তাকানোই যায় না। আলোর দাপটে সব মেঘ পালিয়েছে। শুষে নিয়ে গেছে আকাশের নীলকে। পায়ের কাছে বালিতে নিজের ছায়াটাও জড়সড়, জল চলে এলেই আর নেই। জল ফিরে যাওয়ার সময় অলৌকিক ব্যাপার। নোনতা ঘামে ভেজা কালো শরীরে ফেলে যাওয়া সাদা ফেনার বুদ্বুদ। তাদের উচ্ছ্বাস পছন্দ নয় এ পুণ্যভূমির। দ্রুত শুষে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের রং বদল। বালিশরীর আবার ফর্সার দিকে। আবার যেন ফিরে আসছে আমার ভয় পাওয়া ছায়াটা, একটু একটু করে। নুনের প্রলেপ মাখানো চোখের পাতা তুললাম। জঙ্গি জল এককাট্টা হয়ে ঠেলে উঠছে উন্মত্তের মতো। মাথায় জড়ানো সাদা কাপড়টা ছড়িয়ে দিচ্ছে অনেক দূর। তার পর অদৃশ্য নির্দেশে আক্রমণ শানাচ্ছে তীরের ওপর। এলোপাথাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাক্ষুসে রোমান্টিসিজম নিয়ে। যে দিকে বওয়ার কথা তার উলটো দিকে বইছে হাওয়া। ঢেউয়ের ব্যারিকেড নিজেই তৈরি হওয়া আর ভাঙার পিছনে, দূরে ফুঁসতে থাকা বিশাল জলের ভার। তার ওপরে, ভরদুপুরে হাজার হাজার জোনাকি। একটা মাত্র সূর্যের লক্ষ লক্ষ দানা। মুক্তোর মতো। তার মধ্যে পোড়া কাঠের টুকরোর মতো মানুষ। ডুবছে, ভাসছে। ঘুরে দাঁড়ালাম উলটো দিকে মুখ করে। পরপর হোটেল, মাপা ঘরের বারান্দায় ঝুলছে কাপড় জামা। শুকিয়ে যাচ্ছে নোনা হাওয়ায়।
কত দূর জল আসতে পারে তার একটা অকারণ হিসেব করেই হাঁটছিলাম। মিলছিল না। ধোঁকা দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল আগে। কখনও পায়ের পাতা ভেজানোর নাম করে এসে শেষ মুহূর্তে বোকা বানিয়ে, হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর ভিজিয়ে চলে যাচ্ছিল বেসামাল করে দিয়ে। অপ্রস্তুত হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি আমি। জামাপ্যান্টের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। জলের ফেনা, বালির দানার কথা বলতে বলতে আমার মতো বাকি সবার কথা বলতে ভুলেই গেছি। পিচের রাস্তা পেরিয়ে, বালি ভেঙে হাঁকপাঁক করে সবাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। তার পর ইচ্ছে করে হেরে যাচ্ছে ঢেউয়ের কাছে। জলে পুড়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরত আসছে ছাড়া জামা আর চটির স্তূপের কাছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে জলের দিকে মুখ করে। কেউ কেউ পা টেনে টেনে চলে যাচ্ছে হোটেলে, কলের জলে বালি ধুয়ে বাথরুমের মিষ্টি শাওয়ারের কথা ভাবতে ভাবতে। খাবার দোকানের বাক্স, বাঁকে ডেচকি ঝোলানো মিষ্টিওয়ালা, জলাঙ্গনে বীর-বীরাঙ্গনা ছবি তোলার লোক, শুকনো মুখে অন্য এক বালির দেশ থেকে আসা সাজগোজ করা নির্লিপ্ত উট: সবাইকে দেখছি। এর মধ্যেই চোখে পড়ল একটা সাদা কাপড়ের পুঁটলি, পড়ে আছে কিছু দূরে। কাছে পৌঁছতেই দেখি একটা বুড়ি। বসেই আছে মাথা নিচু করে, নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে, সমুদ্রের দিকে পিছন ফিরে। নড়াচড়া নেই। কাপড়টা ভিজে, চান করে উঠে এসে বসেছে বোধহয়। জিরোচ্ছে। জায়গা সুবিধের নয়। যে কোনও মুহূর্তে জল চলে এলে বিপদ, সামলানো মুশকিলের হবে। হতে পারে যে আর চলবার ক্ষমতা নেই। কাছে গেলাম। ডাকলাম। মাথাটা একটু উঠল। সাদা কয়েক গাছি চুলের মধ্যে ধুয়ে যাওয়া সিঁদুরের ছোপ যেন। বিধবা নয়। অথচ কাপড়টা পুরোপুরি সাদা। বুড়ো কোথায় চলে গেছে কে জানে, দেখলাম আশেপাশে। অনেক লোক। বোঝা মুশকিল। ভাবলাম সাহায্য করি, যদি উঠে আর একটু যেতে পারে। যেখানে জল আসছে না। বললাম সেটা। মাথা নাড়ল। যেতে পারবে না। বা যাবে না। মুশকিলের ব্যাপার। অচেনা বুড়িকে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় না। একটু গলা চড়িয়ে ডাকতে বুড়ি মুখ তুলল, আমার দিকে নয়, আকাশের দিকে। সূর্য দেখলাম অল্প সময়ের জন্যে, বহু যুগের স্মৃতির তলায় তলিয়ে যাওয়া ঝাপসা মণির ওপরে।

Advertisement

ঢেউ এসে গেল। শেষ মুহূর্তে আমি সমুদ্রের দিকে পিঠ করে দেওয়াল তোলার চেষ্টা করলাম বুড়িকে আড়াল করে। বিশাল জলের ধাক্কাটা সামলালাম কোনও মতে। বুড়িকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, জল চলে গেল হা হা করে হাসতে হাসতে তার ওপর দিয়ে, পড়ে গেলাম সামলাতে না পেরে। এতখানি জলের স্রোত আর পায়ের তলায় বালি সরে যাওয়ায় বুড়ি হাতছাড়া হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পারলাম জল ফিরছে। ক্রস কারেন্ট রয়েছে, যে দিক থেকে জল এসেছে সে দিকে ফিরছে না। এটাই ভয়ংকর। মুখ ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। অন্য টুরিস্টদের চেঁচামেচি, হাসাহাসি। একটু দূরেই মনে হল ভেসে যাচ্ছে সাদা একটা কাপড়। ঢেউও আসছে। কোনও মতে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলের ওপর। আন্দাজে ভুল হয়নি, শরীর পাওয়া গেল। এক ঝাঁকুনিতে তুললাম জলের ওপর। হ্যাঁ, সেই বুড়ি, হাঁ করা মুখ, জল বেরিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। যথেষ্ট মজা করা হয়েছে ভেবে সমুদ্র ছেড়ে দিল আমাদের। জল, ফেনা, বালি নিয়ে চলে গেল অন্য দিকে। বেলেল্লাপনা করার জায়গার অভাব নেই তার। বুড়িকে তুলে কিছুটা ওপরে নিয়ে এলাম। এত ক্ষণে কিছু লোক দৌড়ে এল আমাদের কাছে। স্থানীয়ই হবে, বাংলাতে কথা বলল এক জন। হাসছিল। বুড়িকে সে বলেছিল জলের কাছে ও ভাবে না বসতে। শোনেনি। আর যারা এল, তারা নির্বিকার দেখল আমাদের। বুড়ি বেঁচেই আছে, পাশ ফিরে পড়ে আছে, সরু হাতটা নাড়ছে মাঝে মাঝে। কিছু বলছে না। দুর্ঘটনা না ঘটায় অনেকেই চলে গেল। একটা বাচ্চা ছেলে বলল বুড়ির লোকজন আছে। তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। কী করব বুঝতে পারছিলাম না, ফেলে রেখে চলেও যাওয়া যায় না। ছেলেটা মুখ নামিয়ে বুড়ির মুখের কাছে গিয়ে কী সব বলল, বাংলায় নয়। মনে হল কথাটা কানে যাচ্ছে। ক্লান্তিতে কিছু বলতে পারছে না। কী যেন বিড়বিড়ও করছে, বুঝলাম না। ছেলেটা মাথা নাড়ল। আমাকে বলল, তুমি একে নিয়ে যাও। নইলে ও এখানেই পড়ে থাকবে। জলের দিকে যাবে। এমনই করে। চলে যেতে চায় সমুদ্রের দিকে। তার পর মন্দিরের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করে। একটু আগেও এমন করেছিল। ওকে বসিয়ে রেখে ওর লোকরা মন্দিরে গেছে, এখনও ফেরেনি। ব্যাপারটা ভাল ঠেকল না। কত ক্ষণ পাহারা দেব? একটু ধাতস্থ হলেই বুড়ি কি আবার জলের দিকে যাবে নাকি?

ছেলেটা নির্বিকার বসেই রইল আমার পাশে, উবু হয়ে। মুখ নামিয়ে কী সব বলছিল। বুড়িও আস্তে আস্তে উত্তর দিচ্ছিল। সরু ফ্যাকাসে হাত তুলে দেখাল সমুদ্রের দিকে। তার পর পাড়ের দিকে। এ বার আমার দিকে। মনে হল হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে, আমার দিকেই তাকিয়ে। দৃষ্টিটা শূন্য। আমি ধরলাম এক বার। ঠান্ডা, কুঁচকোনো চামড়া। ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুড়িও শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দেখে ছেলেটা খুব হালকা ভাবে মজার গলায় বলল, ‘তুমি তো ওকে বাঁচিয়ে দিলে আবার।’ বুড়ি একটু তেজি হয়ে উঠেছে, কী সব বলছে, হাত নাড়ছে, শরীরটা অবশ্য পড়ে আছে বালিতে। ঢেউয়ের শব্দ, লোকজনের কথাবার্তা কমে আসছে। রোদের তেজও কম, তাকিয়ে দেখি মেঘ এসেছে, সূর্য ঢাকা পড়েছে। কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে একটু দূরে। কান্নার মতো কোমল একটা শব্দ ভেসে আসছে বার বার। দেখছিলাম এ দিক ও দিক। হঠাৎই মনে হল পায়ের কাছে নড়াচড়া করছে কেউ। বুড়ি আস্তে আস্তে উঠে বসেছে, ছেলেটার হাত ধরে। হাঁটুর ওপর জোর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বোধহয়। ধরতে গেলাম। হাত ধরল না। দু’হাত দু’পায়ের ওপর ভর করে শরীরটা একটু তুলে ধরল অদ্ভুত ভাবে। মাথাটা নামিয়ে আনল আমার পায়ের পাতার কাছে, পাতার ওপরে ঠেকে গেল ওর কপালটা। অস্বস্তিতে পড়লাম, নিজেই নিচু হয়ে মুখটা নিয়ে গেলাম বুড়ির মুখের কাছে। শুনি বলছে, ‘জগন্নাথ, জয় জগন্নাথ।’

Advertisement

suvolama@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement