ছবি: সুমন চৌধুরী
তেঁতুলগাছে ভূত-পেত্নির জমজমাটি সংসার। দুপুরবেলায় তেঁতুলতলায় ভূতের ছানারা সব পাত পেড়ে খেতে বসেছে। এক এক জনের পাতে পচা ইলিশের মস্ত টুকরো ঝুরো ঝুরো করে ভাজা। জেলেদের জালে ওঠা টাটকা ইলিশ সাত দিন ধরে পচিয়ে চড়া দামে বাজারে বিকোচ্ছিল। জ্যান্ত লোকে তা-ই তাজা ভেবে গাঁটের কড়ি খরচা করে কিনছেন। কিন্তু পচা মাছের গন্ধে গন্ধে যত ভূত-পেত্নিও জুটল গিয়ে সোজা মাছ পচানোর আড়তে। বরফ-চাপা ইলশে ফিশ গোটা কয় তুলে এনে, আরও দিন কতক বরফ-ছাড়া পচিয়ে, আজকের পচাগন্ধ আমোদিত মাছ ভাজা ভোজন। কী খোশবাই না ছেড়েছে! এক ছানা বলে বসল, মাঁ মাঁ, কাঁটা বেঁছে দেঁ, ভাঁজা খাঁই।
ছানাদের পেত্নি-মা বললেন, কাঁটা বেঁছে মাঁছ খাঁয় নাঁ কোঁনও ভূঁতের ছাঁ।
ওমনি সব ক’টি ছানা নাকে সুর তুলে নাকী-কান্না জুড়ল। তারা কাঁটা বেছেই মাছ খাবে আজ। তেঁতুলতলায় সে এক মহা শোরগোল!
আসলে হয়েছে কী, ভূতেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেখানে জ্যান্ত লোকের এলাকা সেখানে এক মনিষ্যিবাড়িতে সব মিলে দেখে এসেছে, মা তাঁর ছানাদের কাঁটা বেছে মাছ খাইয়ে দিচ্ছেন। ওমনি তাদেরও চাই। এ-দিকে পেত্নি মা তো মনুষ্যজীবনে মাছের কাঁটা বেছে খেতেন, এখন সব ভুলে গিয়েছেন। এক লোকেই মানুষ আজ যা বলে কাল ভুলে যায়, আজ যা করে কাল করে উলটো, আর ভৌতিক দশা হল লোকান্তরিত জীবন। মাছি-মশা বাসি-পচা ফাঁসি-গুলি খোঁচা-শূলি ছাঁটা-কাঁটা কিছুতেই কিছু যায় আসে না। বায়ু খেলেও আয়ুক্ষয় হয় না এতটুকু। কিন্তু ছানাদের বায়না না মেটালেই নয়। আদরের বাছারা যতই না কণ্টকিত আবদার করুক, মা-পিসিমারা তাকে প্রশ্রয় না দিলে আবার আদর কী! তাই পেত্নি খানিক ক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। তার পর বললেন, যাই তবে। তোমাদের পিসিমা শ্যাওড়াদিদির কাছ থেকে ঘুরে আসি। যদি তাঁর মনে থাকে কাঁটা বাছে কী করে!
ওমনি ছানারা লক্ষ্মীসোনা হয়ে ঘাড় নেড়ে ‘কাঁটা লাগা-আ-আ-আ’ গান গাইতে লাগল। কচি ভূতের গলায় সেই সুরেলা সমবেত সঙ্গীত শুনে ভূতোস্তাদ গাইয়ে মাঝদুপুরে— ভুঁতুম তাঁ না না না না দেঁরে দেঁরে মাঁছ ভাঁজা দেঁরে না দেঁরে না— বলে কষে তানকর্তব ধরলেন। সানাইয়ের গর্তে গুবরে পোকা বাসা করলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি আওয়াজের মধুরতায় ভূতের দল মোহিত হয়ে গেলেন। কিন্তু উচ্চাঙ্গের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছানাদের বেশি ক্ষণ ভাল লাগল না। তারা সব মিলে পথেঘাটে দৌরাত্ম করে বেড়াতে লাগল। মানুষের আস্তানায় গিয়ে এর ঘরে ঢেলা মারে, তার দরজায় টোকা মারে, কেউ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে দেখলে নাকে সুড়সুড়ি দেয়। লোকে একেবারে অতিষ্ঠ। ভূতেরা না চাইলে মানুষ তাদের দেখতে পায় না। তবু কেউ কেউ— খোঁচা খোঁচা চুল, ড্যাবা ড্যাবা চোখ, হাড় জিরজিরে, হাসিমুখর ছানাদের এক পলকের জন্য দেখে ফেলল। এই আছে এই নেই। কেউ ভাবল চোখের ভুল, কেউ ভাবল মনের।
এক বাড়ির দাওয়ায় এক মানুষের ছেলে ইলিশভাজা-ভাত পেটটি ভরে খেয়ে ঘুম তাড়াবার জন্য কষে নামতা পড়ছিল। তাই না শুনে, ভারী খুশি হয়ে ভূতের ছানারাও গোল হয়ে দাঁড়িয়ে প্রেতলোকের অবশ্য পাঠ্য নামতা আওড়াতে লাগল।
ভূতেক্কে ভূত/দুই ভূতে রুণ্ড
তিন ভূতে স্কন্ধকাটা/চার ভূতে জুজুবুড়ি
পেঁচো ভূতে লুটপাট/ছয় ভূতে চোদ্দো বেতাল
বারো ভূতে রাজকায্যি/ভূত তেরোং ব্রহ্মদত্যি
ভূত চোদ্দোং মামদো/ভূত ষোলোং শাঁকচুন্নি
ভূত আঠেরোং মেছোভূত...
যেই মেছো ভূত বলেছে ওমনি ভূতেদের খুদে ছানা ‘মাঁ, মাঁছভাজা খাঁব, কাঁটা বেঁছে দেঁ’ বলে কাঁদতে লাগল। মনিষ্যির ছেলে নামতা পড়া থামিয়ে ভাবতে লাগল, এত ঝিঁঝি ডাকে কোথায়।
এ-দিকে ভূতেদের বড়খোকা ছোট বোনকে কোলে তুলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে চলল। তার একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে। সে জানে মাছের কাঁটা বাছতে শেখা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ল্যাজা থেকেই শুরু করো আর মুড়ো থেকে, কাঁটা বাছতে বাছতে মাছ সাবাড়।
কী আর করা! পেটে খিঁদে মুখে হাঁসি নিয়ে সব চলল সমুখপানে। দেখে ভূতেপান্তরের মাঠে একটা ম্যারাপ পড়েছে। সাদা কাপড়ে ঢাকা এক মস্ত বাসা যেন। তার সারা গায়ে ভূতের ছবি। লোকে স্যান্ডেল পায়ে টিকিট কেটে প্যান্ডেলে ঢুকছে আর খানিক বাদে চটি-টটি ভুলে চুল খাড়া করে দৌড়ে বেরিয়ে আসছে। খানিক সুস্থ হয়ে মাছভাজা, তেলেভাজা, ফুলুরি, কচুরি, ভেলপুরি কিনে খাচ্ছে। ব্যাপার কী?
ভূতেদের বড় ছেলে সাধ্যমতো সভ্য-ভব্য মূর্তি ধরে মাছভাজানে দোকানিকে শুধোল, ‘কাঁকা, ওঁ ঘঁরে কীঁ হঁচ্ছে!’
হাড় জিরজিরে প্যাংলা, খোঁচা চুলো, ড্যাবা চোখো ছেলেটাকে সন্দেহের চোখে জরিপ করে মাছভাজাওয়ালা বলল, ‘তা দিয়ে তোর কী? ওখানে যেতে পয়সা লাগে।’
ভূতের তো আর পয়সার অভাব নেই। দরকারও নেই। তাদের সবই মানসাঙ্ক। চাইলেই পয়সা বানিয়ে ফেলতে পারে। বড় ছেলেও তখুনি পয়সা দিয়ে এক ঠোঙা চিংড়িভাজা কিনে বলল,‘পঁয়সা আঁছে। তাঁমাশা কীঁ তাঁই জাঁনতে চেঁনু।’
‘লোকে যাচ্ছে পয়সা দিয়ে ভয় পেতে। ক’জন ভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে। লোকে ভয় পেয়ে আমোদ করছে।’
‘তাঁই বঁলো!’
সে সবাইকে চিংড়িভাজা খাইয়ে সুড়ুত্ করে সক্কলকে নিয়ে ঢুকে পড়ল প্যান্ডেলে তামাশা দেখতে।
কয়েকটা মানুষের ছেলে সাদা চাদরে মুখ ঢেকে, গায়ে কঙ্কালের ডোরা এঁকে, হাতে নকল খুলি নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। ভূতের ছানারা তাই দেখে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। ন’ছেলে ভারী দুরন্ত। সে বলল, ‘চল্, ওই নকল মুন্ডু দিয়ে ফুটবল খেলা যাক!’
যেমনি বলা ওমনি বাকি সবাই যে যেমন পারল নকল খুলি নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল। সে এক দারুণ মজা!
কিন্তু মানুষের ছেলেরা তা বুঝবে কী করে! ভূতের ছানারা তো অদৃশ্য! সক্কলে দেখল, বলা নেই কওয়া নেই, প্লাস্টিকের মুন্ডুগুলি আপনা আপনি শূন্যে নেচে বেড়াচ্ছে! ভয়ে বিস্ময়ে যে যেদিক দিয়ে পারল ছুটে পালাতে লাগল। মাছ ভাজনেওয়ালা দেখল, তাজ্জব! আগে ভয় খেয়ে দর্শকেরা পালাচ্ছিল, এখন তাদের পিছু পিছু নকল ভূতের দলও দৌড়চ্ছে!
এ-দিকে হয়েছে কী, তেঁতুলগাছের প্রেতিনী মা বাছাদের খুঁজতে খুঁজতে নকল ভূতের আস্তানায় এসে বললেন, ‘তোঁরা এইখেঁনে? চঁল্, মাঁছ বেঁছে এঁনিছি, খাঁবি চল্।’
কেমন করে মাছের কাঁটা বাছতে হয়, সেই শিক্ষে দিতে দিতে পেত্নি তাঁর ছানাদের নিয়ে বাতাসে ভেসে যেতে লাগলেন। ছানারা খেলবে বলে নকল মুন্ডুগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের তো দেখা যাচ্ছে না। কেবল মুন্ডু।
ভাসমান সেইসব মুন্ডু দেখে মাছভাজাওয়ালা ভিরমি খেল। ভূতের ছানারা তা লক্ষও করল না। তেঁতুলতলায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কাঁটা বেঁছে পঁচা ইঁলিশের ভাঁজা আর ছাঁতা-পঁড়া ভাঁপা দঁই। সঙ্গে, শ্যাওড়াপিসিমার পাঠানো ক্যাওড়াজলে সেদ্ধ চাঁমচিকের স্যুঁপ আর তেঁলেভাজা! উঁলস্!