রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

সুপারহিটের সঙ্গে মোকাবিলা

Advertisement

সেই সময় কেব্ল টিভির দাপট শুরু হয়নি। দূরদর্শনের বেড়ে দেওয়া ভাত, আর সঙ্গে আটপৌরে কয়েকটা পদ, মানুষ তৃপ্তি করে খেত। সবার ঘরে তখন টিভি পৌঁছয়নি। সাদা-কালো টিভি তার বনেদিয়ানা ধরে রেখেছিল মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের হৃদয়ে। আর ছোট-বড় যা-ই হোক, ঘরে একখানা ‘কালার টিভি’ থাকলে, নিজেদের বৈভব জাহির করা যেত খোশমেজাজে। ‘আজনবি’, ‘জুনুন’ ইত্যাদি সিরিয়ালগুলো অনেকের মধ্যেই নতুন এক নেশার জন্ম দিয়েছিল। যাদের ঘরে টিভি ছিল না, তারা ভিড় জমাত পরিচিত কারও ঘরের সাদাকালো টিভির সামনে। সেখানে দিদিমা, জেঠিমা, পাশের বাড়ির বউদি, কাজের মাসি, মুড়ি-ফুলকপি শোভিত আপিসবাবু, সবাই ছিলেন। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আর কী!

এরই মধ্যে হাজির হল ‘সুপারহিট মুকাবলা’। তুফান তুলল সবার মনে। বৈপ্লবিক এই কাউন্টডাউন শোয়ের দশটা গান নিয়ে মানুষের মধ্যে তখন ব্যাপক হইচই। স্বপ্নসুন্দরী দিব্যা ভারতী সব কিছু তোলপাড় করে হঠাৎ চলে গেলেন। তাঁর অভিনীত ছবির গানগুলো থেকে গেল কাউন্টডাউনে। সুপারহিট মুকাবলা সবচেয়ে বেশি মন টেনেছিল অল্পবয়সিদের। স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষণশীল, কালচার-কাউবয়রা সবাই তেড়ে এলেন। আমি তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর-এ পড়ি। ওটি ছিল আমাদের বয়সের নিষিদ্ধ জিনিস। সুপারহিট মুকাবলা দেখে না মানে ঘরে বা পাড়ায় ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ টাইপ পরিচিতি। যে সব গার্জেনরা আমাদের মতো ‘গো-পাল’কে ইস্কুল থেকে বাড়ি আনতে যেতেন, তাঁরা একটা অস্থায়ী ঠেক বানিয়ে নিয়েছিলেন। সবাই নিজের সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। ওখানে অনেকে গর্ব করে বলতেন, ‘আমার ছেলে কিন্তু সুপারহিট মুকাবলা দেখে না।’ এই কথাটা ছিল লেখাপড়ায় ভাল কোনও ছেলে বা মেয়ের অভিভাবকের বুকফোলানো স্টেটাস সিম্বল।

Advertisement

বড় সময় ধরে ‘সুপারহিট মুকাবলা’ মাতিয়ে রেখেছিল ‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’ গান।

শাহরুখ আর কাজলের ফ্রেশ অ্যাপিল, আর অনু মালিকের ‘র্যাপ’ মিলে, জমজমাট।

সুপারহিট মুকাবলা অল্পবয়সি অনেকেরই শরীরের হরমোনগুলোকে ঠিক সময়ের আগেই একটু বেশি অ্যাক্টিভ করে দিয়েছিল। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানটার পোকা। মনে আছে, অনুষ্ঠানটা শুরু হত ‘আমি পড়া থেকে উঠব’ আর ‘মা খেতে দেবে’ এই দুটো ঘটনা ঘটবার সংযোগস্থলে। আমি যে ঘরে পড়তাম, সেখানে কোনও ঘড়ি ছিল না। সন্ধে যত গড়াত, নানা ছুতোয় পাশের ঘরে গিয়ে সময় দেখে আসতাম। তখন আমাদের রিডিং পড়তে হত। জোরে না পড়লে জুটত পিটুনি। মনে মনে পড়ার কোনও ছাড় ছিল না, এক যদি না টনসিল বাড়ত। অনুষ্ঠানটার সময় যতই ঘনিয়ে আসত, আমার রিডিং পড়ার ডেসিবেলও বাড়ত ততই। একেবারে ক্লাসিকাল শিল্পীর রেওয়াজের মতো। শো শুরুর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে, মিনমিনে গলায় মায়ের কাছ থেকে এক গ্লাস জল চেয়ে সুপারহিট মুকাবলা দেখার অনুমতিটাও বাগিয়ে নিতাম। মা নিমরাজি হতেন। কিন্তু তিনিও সুপারহিট মুকাবলা দেখার লোভ সামলাতে পারতেন না। বহু পরিবারে এই ঘটনা ছিল চেনা ব্র্যান্ডের মানেবইয়ে সাজেশনের মতোই কমন।

সুপারহিট মুকাবলাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল বাবা সায়গল-এর সঞ্চালনা। যদিও আমি দীর্ঘ সময় ধরে ওঁর নাম ‘বাবা সাইকেল’ জেনে এসেছি, বলেও এসেছি। অদ্ভুত এক প্রাণ ছিল অনুষ্ঠানটায়। চূড়ান্ত আলসেকেও চঞ্চল ও তৎপর করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। রংবাহারি সব কেতা ছিল সেই বাবা সায়গল নামধারী ভদ্রলোকের। ন্যাড়া মাথা, কানে দুল, খালি গা, মাথায় ফেট্টি। সেই সময় থেকেই খুব সম্ভবত আমেরিকার জাতীয় পতাকার তারাওলা ফেট্টি প্রবল জনপ্রিয় হয়। পাড়ার ছেলেরা ঠাকুর দেখার সময় ওই ফেট্টি মাথায় লাগিয়ে বেরোত। অকালে অনেক ছেলের পেকে যাওয়ার কার্বাইডও ছিল বাবা সায়গল। ‘ঠান্ডা ঠান্ডা পানি’, ‘দিল ধড়কে’, ‘আ যা মেরি গাড়ি মে’ তখন খুব জনপ্রিয়। পাড়ার কোনও ছেলের মুখে ওঁর গান গুনগুনাচ্ছে মানেই এ ছেলে ‘দাগি’, এর আর লেখাপড়াটড়া হবে না। বাবা সায়গল-এর গানের দু’একটা লাইন বোঝা যেত। বাকিগুলো উনি খুব দ্রুত বলতেন। অনেক পরে জেনেছি, এটাকে নাকি র্যাপ বলে।

‘ঘুঙ্ঘট কি আড়সে দিলবর কা’, ‘ইয়ে কালি কালি আঁখে’, ‘মুকাবলা মুকাবলা’— গানগুলো যে কত সপ্তাহ ধরে চার্টের ওপরে ঘোরাঘুরি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভাই-বোন-ইয়ার-দোস্তদের মধ্যে প্রচুর জল্পনা আর বাজি রাখা চলত সপ্তাহের এক-দুই-তিন নম্বর গান কী হবে তাই নিয়ে। মাঝেমধ্যে বলি-তারকারাও আসতেন অনুষ্ঠানে। আমির খান এসেছিলেন এক বার। সে কী উত্তেজনা তাঁকে দেখে!

অনেক মিউজিক ভিডিয়োও জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময়। স্বল্পবসনা আধুনিকারা টিভির পরদা কাঁপাতেন, আর আমরা দরজার পরদার আড়াল থেকে দেখতাম। আলিশা চিনয়-এর ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পপ মিউজিকে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। পাড়ার ফাংশনে লতা-আশা যে কণ্ঠীই আসুক না কেন, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ গাইলে আসর জমজমাট। সামনের সারিতে বসা, দোক্তা-খাওয়া ফোকলাদাঁত ঠাকুমার মৃদু আপত্তিরা উড়ে যেত আসরের পিছনের দিকে কাউন্টার-বিড়ি ফোঁকা বোম্বেটে বাদশাদের মুখ থেকে ছিটকে আসা স্বতঃস্ফূর্ত সিটিতে।

সুপারহিট মুকাবলা আর বাবা সায়গলও হারিয়ে গেল এক দিন। আবার কত নতুন নামের ঝড় এল। সব যুগেই কয়েক জন তৈরি থাকে, ঘর থেকে বেরিয়ে ঝড়ে উড়ে যাওয়ার জন্য। কী জানি, এখনও হয়তো তারা উড়ছে!

সুমন সরকার,
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউট, কলকাতা

sumansarkar_r@isical.ac.in

নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

স্বাধীনতা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, আগামী কাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত থানা তুলে দেওয়া হবে। সব পুলিশকর্মীদের স্বেচ্ছাবসর দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গে আর কোনও আইপিএস নেওয়া হবে না। এখন থেকে এলাকাভিত্তিক ক্লাব বেছে নিয়ে, আইন-কানুন দেখভালের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে তাদেরই হাতে। এমনকী ওই এলাকার মানুষের অপরাধের বিচার ও শাস্তি ঘোষণার ক্ষমতাও তাদের দেওয়া হবে। এতে আদালতে দীর্ঘ দিন জমে থাকা মামলার চাপও কমবে। নতুন মামলা তো রুজু হওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। অভিযোগকারী সরাসরি ক্লাবে খবর দেবেন, ক্লাবের দাদারা সব পক্ষকে বসিয়ে, শুনানি করে, শাস্তি দিয়ে দেবেন। জরিমানা আদায়, আড়ং ধোলাই, মাথা কামিয়ে দেওয়া— সব ধরনের শাস্তি প্রয়োগ করার জন্য এলাকা থেকেই মস্তান নিয়োগ করতে হবে। ক্লাবের সভ্যদের এর জন্য যে অসীম পরিশ্রম ও মানসিক চাপ হবে, সে কথা মনে রেখে রাজ্য সরকার থেকে প্রতি বছর ক্লাবপিছু দশ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হবে। আর প্রতিটি থানাবাড়িতে এলাকার বিভিন্ন ক্লাবের সদর দফতর তৈরি করা হবে। সেখানে প্রতি দিন আমোদ-প্রমোদ, খানাপিনার ঢালাও বন্দোবস্ত থাকবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মস্তান ও দুর্বৃত্তদের এই আইনব্যবস্থায় ওতপ্রোত জড়িয়ে নিতে হবে, কারণ ভক্ষকই সেরা রক্ষকে রূপান্তরিত হতে পারে, গুন্ডা-বদমাশরাই অপরাধের খুঁটিনাটি সবচেয়ে ভাল জানে ও ধরে ফেলতে পারে। এই কাজে জড়িয়ে তারা রোজগারও করতে পারবে, অপকর্মের ফুরসতও পাবে না। তা ছাড়ায় প্রায়ই থানায় গিয়ে নাচা-গানা-মৌজ-মস্তি করে আসার ফলে, তাদের মন সব সময় ফ্রেশ থাকবে। অন্যায় করার কথা মাথাতেই আসবে না। ক্লাবের বেকাররা সকলেই এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে, নিদেনপক্ষে অনুদানের অংশ ভোগ করবে। তাই তারাও দিব্যি সৎপথে থাকবে। সরকারের আশা, বাকি দেশও বাংলার দেখাদেখি কিছু দিনের মধ্যেই থানা-পুলিশ তুলে দেবে।

জগন্নাথ অগস্তি, অলিগঞ্জ, মেদিনীপুর

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন