রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের অধীনে আসার পরই, ইংল্যান্ডের শাসকদের নজর গেল স্কটল্যান্ডের হুইস্কি নির্মাতাদের দিকে। রাজস্ব আদায়ের জন্যে এ রকম নিশানা পেয়ে যাবে, ইংরেজরা ভাবতেও পারেনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share:

স্কটল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশ আয়ারল্যান্ডে কিন্তু বিদ্রোহের বদলে আপসই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। শুরুর দিকে একই রকম ভাবে এ দেশেও বেআইনি ভাটিখানা গড়ে উঠেছিল দেশের কোনায় কোনায়, সরকারি বিধিনিষেধের জালের বাইরে, কিন্তু এ দেশে যে হেতু মাতলামি আর হুইস্কির প্রতি আসক্তি কেই সরকারকর লাগু করার কারণ হিসাবে দেখিয়েছিল, মধ্যবিত্ত সমাজ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। যার জন্যে যেখানে ১০০০-এর বেশি ভাটি ছিল আয়ারল্যান্ডে, ১৭৭৯ এ ভাটি-কর চালু করা হলে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়াল ২৪৬-এ। ১৯০০ সালে সেই সংখ্যা আরও কমে ৩০ হয়ে দাঁড়ায়।

Advertisement

আমেরিকায় হুইস্কি তৈরি প্রথম শুরু হয় পেনসিলভানিয়াতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, যখন ১৭১৬-’১৭ নাগাদ বস্ত্রশিল্পে মন্দার কারণে আইরিশ আর স্কটরা দলে দলে আমেরিকায় অনুপ্রবেশ করতে লাগল। স্কট অনুপ্রবেশকারীরা হুইস্কি বানানোয় মন দিতে অচিরেই পশম আর বন্দুকের সঙ্গে হুইস্কি হয়ে উঠল এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিনিময়-মাধ্যম। প্রায় প্রত্যেক সম্পন্ন চাষার ঘরেই হুইস্কি তৈরি হতে লাগল উদ্বৃত্ত শস্য কাজে লাগিয়ে কারণ একটা ঘোড়াকে দু’বস্তা খাদ্যশস্য না বইয়ে তার বদলে দুটো বড় আকারের হুইস্কি-ভরা পিপে বওয়ালে ছ’গুণ রোজগার হত; স্বয়ং জর্জ ওয়াশিংটনের ভাটিখানা ছিল মাউন্ট ভার্নন-এ। জেমস অ্যান্ডারসন নামে এক স্কট তার ম্যানেজার ছিলেন। কাজেই ১৭৯১ সালে যুদ্ধক্লিষ্ট নতুন সরকার যখন হুইস্কির ওপর বিশেষ কর বসাল অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলার জন্যে, আর ট্যাক্স নগদে নেওয়ার জন্যে রাজস্ব অফিসার নিয়োগ করল, ফলাফল হল ভয়াবহ, রক্তাক্ত। বিভিন্ন জায়গায় রাজস্ব অফিসারদের নগ্ন করে শরীরে আলকাতরা লেপে পালক সেঁটে ছেড়ে দেওয়া হত। রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন শেষে মিলিটারি নামিয়ে এই হুইস্কি-বিদ্রোহ দমন করেন।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

Advertisement

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

স্কুল জীবনে আমাদের সবাইকেই ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ কিংবা ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ রচনাটা শিখতে হয়েছিল, পরীক্ষায় কারও ‘কমন’ এসেছে, কারও আসেনি। বেশির ভাগ রচনা বইতেই জীবনের লক্ষ্য বলতে শিক্ষক কিংবা চিকিত্‌সক থাকে। স্যারেরাও ওর’ম শেখান। দক্ষ কেরানি হইতে চাই, কিংবা দালাল হইতে চাই, কিংবা ক্ষমতাবানের চামচে হইতে চাই কেউ লেখে না, কিন্তু হয়ে যায়। আবার যে শিক্ষক হইতে চাই মুখস্থ করেছিল সে যে শিক্ষকই হবে, এমন কোনও কথা নেই যা খুশি হতে পারে। আমি আর রবিকান্ত দুজনই শিক্ষক হতে চাই মুখস্থ করেছিলাম, আমি শেষ পর্যন্ত কী হয়েছি আমি জানি না, কিন্তু রবিকান্ত শিক্ষকই হয়েছিল। ও বলত, বাংলা স্যারকে পরীক্ষার খাতায় কথা দিয়েছি যখন, কথা রাখবই। ‘শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষাই জাতির মানবসম্পদ উন্নয়ন করে এবং জাতিকে উন্নততর করে...এক জন আদর্শ শিক্ষক নিজের আহরিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চার করেন...একটি প্রদীপ শত প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করে...’, এ সব ঠিকঠাক লিখতে পারলে ২০-তে ১৩-১৪ পাওয়ার পক্ষে যথেষ্টই, কিন্তু রবিকান্ত বোধ হয় ওই বাক্যগুলিকে নম্বর পাওয়ার ‘পয়েন্ট’-এর বাইরেও কিছু ভেবেছিল।

রবিকান্ত সায়েন্সের ছেলে হয়েও ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ল না। বলল, এই সাবজেক্টগুলো পড়েছি বটে, কিন্তু খুব ভাল ছাত্র নই তো, নিজে ভাল করে না বুঝে ছাত্রদের পড়াব কী করে? তার চে’ ভূগোল নিয়ে পড়ি; ভূগোল টিচারদের খুব ডিমান্ড, ক্লাস সিক্স থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত ভূগোল থাকে। আর ভূগোল টিচাররা সবাই আর্টস থেকে আসে, কিন্তু ভূগোলের মধ্যে প্রচুর ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি থাকে। আমি অন্যদের চেয়ে ভাল পড়াব।

এখন ভূগোলের মাস্টার্স ডিগ্রি এম.এসসি হয়। তখন এম.এ হত। বি.টি-ও করল রবি। কলকাতা থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে একটা স্কুলে চাকরিও জুটিয়ে নিল। এক দিন ওর বাড়ি গেলাম। দেখি ছোট ছোট স্বচ্ছ বয়ামে অনেক রকম শস্য সম্ভার। ও বলল, কৃষি উত্‌পাদন পড়াবার সময় রাই, বাজরা, যব, এ সব পড়াতে হয়। কোনটা কেমন দেখতে ছাত্ররা জানে না, ওদের দেখাই, কত রকমের ধান, কত জাতের গম, কত রকমের ডাল...। কাঠের তাকে থাকে থাকে সাজানো পাথরও দেখলাম। ও বলল, যেখানে যাই পাথর কুড়িয়ে আনি, ওদের সিলেবাসে ‘শিলা’ আছে, যদিও ১০-১৫ নম্বরের মাত্র প্রশ্ন আসে, তবুও...। ও আমাকে দেখাল পাললিক শিলা, আগ্নেয় শিলা, রূপান্তরিত শিলার অনেক নমুনা। ও বলছিল এটা হল ‘গ্যাব্রো’। গলিত লাভা জমে গিয়ে এই পাথর হয়। এটা মনজোনাইট, এটা টোনালাইট, তার পর অ্যাডাকাইট, ব্যাসানাইট, মোনাজাইট এ রকম কত কী নাম বলে গেল। কোনও পাথর কাচের মতো স্বচ্ছ। বলল কোয়ার্টজ্‌। চকচকে পাথর দেখাল এখানে নাকি অভ্র আছে। গোল গোল কিছু পাথর দেখাল, আমরা বলি নুড়ি, ও বলল জলস্রোত কী ভাবে পাথরকে সব দিক থেকে ক্ষয় করে গোলাকার করে দেয়। ওর স্ত্রী বললেন, গত মাসে ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়েছিলাম, আমরা হোটেলে পড়ে রইলাম, আপনার বন্ধু সারা দিন নদীর ধারে পাথর খুঁজে বেড়াল, কী বলব।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

পাথর খোঁজাটা ওর নেশা হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যেই ঝাড়খণ্ড-ছত্তীসগঢ় চলে যেত। ওই সব এলাকা নাকি প্রাচীন গন্ডোয়ানার অংশ, পাথর শিকারের আদর্শ জায়গা। একটা পাসপোর্টও করেছিল ইচ্ছা ছিল পাকিস্তান যাবে। বালুচিস্তানে নাকি রাস্তাঘাটে ‘অ্যাগেট’ আর ‘এম্‌বা’ পাওয়া যায়। ভিসা পাচ্ছে না। পেলেও আনতে দিত কি না কে জানে। জয়সলমের থেকে কিছু হলুদ পাথর সংগ্রহ করেছিল ও, ট্রেনের টিকিট ছিল না, বিমানে আসতে হয়েছিল, এক্স রে-তে সুটকেসের পেটে পাথর ধরা পড়ে। সব পাথর ফেলে দিতে হয়েছিল এয়ারপোর্টে। ও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল এগুলো স্পেসিমেন, ছাত্রদের পড়ানোর কাজে লাগবে। নিরাপত্তা কর্মীরা বলেছিল, কোই সওয়াল নেহি হ্যায়, আপ আতংকবাদী হো সক্তে হ্যায়। ফেকো পাত্থর। পাথর নিয়ে ওর একটা গর্ব ছিল। ও বলত, আমার কালেকশনে এখন দু’শো বারোটা ভ্যারাইটির রক্স আছে। আরে, সেডিমেন্টারি রক্সই আছে চল্লিশটা। ক’জনের আছে? অথচ পাথরের, মানে কংক্রিটের পয়সা জোগাড় হচ্ছিল না বলে বহু দিন ছাদটা ঢালাই করতে পারেনি।

স্কুলে যাওয়ার সময় সাইকেলের দুই হ্যান্ডেলে প্রায়শই ঝুলত দুটো ব্যাগ। ব্যাগে থাকত পাথর।

ছাত্ররা ওর নাম দিয়েছিল স্টোনম্যান। ও জানত, রাগ করত না।

স্কুলটার সুনাম হয়েছিল, ভূগোলে ছেলেরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভাল নম্বর পাচ্ছিল। অনেকেই ভূগোল নিতে চাইত।

বছরকয়েক আগে স্কুলে ছাত্র ভর্তি নিয়ে গন্ডগোল। এলাকার এক সদ্য-ভাস্বর রাজনৈতিক নেতা ভর্তি করাতেই হবে বলে একটা লিস্টি দিলেন হেডমাস্টারকে। হেডমাস্টার পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি নেবেন না। দুটি বিবদমান পক্ষ। মানতে হবে, এবং মানছি না। রবিকান্ত তখন শিলা পড়াচ্ছিল। এক দল সোজা ক্লাসে ছুটে এল, মুহূর্তের মধ্যে আগ্নেয়, পাললিক আর রূপান্তরিত শিলা রূপান্তরিত হল ঢিলে। মাথা ফাটল অনেকের। স্কুলের বাইরে চতুর্দিক ছড়াল কোয়ার্টজ্‌, গ্র্যানাইট, ব্যাসল্ট... যা নাকি কেবলই ঢিল। পুলিশ এল।

ঢিল সাপ্লাই করল কে?

রবিকান্ত নাহা। ওরফে স্টোনম্যান।

হাজতে তিন দিন।

রিটায়ার করেছে রবিকান্ত। ভীষণ ডিপ্রেশন। ও এখন নিজেই পাথর।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement