আভিয়াল
পিনাকী ভট্টাচার্য
দক্ষিণ ভারতের পাঁচমিশেলি সবজির পদ ‘আভিয়াল’-এর সঙ্গে মহাভারতের ভীমসেনের নাম ওতপ্রোত জড়িয়ে। যে হাতে গদা চালাতেন, সেই হাতে হাতাও ধরতেন! শোনা যায়, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় যখন ‘বল্লব’ নাম নিয়ে ভীমসেন বিরাট রাজার পাকশালের দায়িত্ব নেন, তখনও তিনি রান্না করতেই জানতেন না। এ দিকে নতুন শেফ পেয়ে রাজা বিরাট বিশাল আহ্লাদিত। শেফ্’স স্পেশাল খানা খেতে চাইলেন। ভীম পড়লেন বিপদে। উপায় না দেখে তিনি বেশ কিছু রকম সবজি কেটে সেদ্ধ করে, তার ওপর নারকেল কুরিয়ে ছড়িয়ে দিলেন। পাতে দেওয়া মাত্র সেই রান্নাই বিশাল হিট! বিরাট রাজার এতই পছন্দ হল যে রাজদরবারে নতুন অতিথি এলেই তাঁর পঞ্চব্যঞ্জনে আভিয়াল থাকতই।
আর এক গল্প বলে, মহাভারতের বনপর্বে, অর্জুন যখন দিব্যাস্ত্রের খোঁজে রওনা দিলেন, লোমশ মুনি বাকিদের নিয়ে তীর্থদর্শনে চললেন। সেই সময় পাণ্ডবরা ঘুরতে ঘুরতে দেশের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যান। অন্য ভাইরা নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য ফল খেয়ে থাকতেন কিন্তু ভীমসেনের শুধু ফলাহারে তৃপ্তি হত না। তিনি রাস্তায় যেতে যেতে বিভিন্ন সবজি দিয়ে নিজের জন্য যে পদটা রান্না করে নিতেন, সেইটাই আজকের আভিয়াল।
আভিয়াল তল্লাশির পুরো রাস্তাতেই রাজা-রাজড়ার গপ্প; এমনকী উইকি-জ্যাঠাও মহাভারতের গল্পই শুনিয়েছেন। এ দিকে খুঁজতে খুঁজতে, দক্ষিণ ভারত ছেড়ে কখন যেন আবার উত্তর ভারতে এসে গেছি! স্যর যদুনাথ সরকারের জয়পুরের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, বিরাট রাজার বিরাটনগর যে মৎস্যদেশের রাজধানী ছিল, তা হল এখনকার জয়পুর-আলোয়ার। মৎস্যদেশ নামের কারণ, সেখানকার লোকের প্রধান জীবিকা ছিল মাছ ধরা। সরস্বতী নদী বইত যে সেখানে। সরস্বতী শুকিয়ে যেতে সেখানকার মানুষ চলে আসেন চর্মনবতী নদীর তীরে। একেই আমরা চম্বল নদী বলে চিনি। ‘চম্বল’ কিন্তু দ্রাবিড় শব্দ। মানে ‘মাছ’। কিন্তু সেখানেও মাছ ফুরিয়ে এলে এই মানুষরা আরও দক্ষিণে গিয়ে ডেরা বানান, যেখানে জীবন আর জীবিকার জন্য পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাবে। তবে কি আভিয়াল উত্তর ভারতে জন্মেও এঁদের সঙ্গেই দক্ষিণ ভারতে পৌঁছায়?
প্রায় সব দক্ষিণ ভারতীয়ই মানেন, আভিয়াল সব চেয়ে সুস্বাদু হয় নায়ারদের হেঁশেলে। কিন্তু কারা এই নায়াররা? তুলু ব্রাহ্মণদের নিয়ে লেখা ‘গ্রামা পদ্ধতি’ এবং কেরলের উৎপত্তি নিয়ে লেখা ‘কেরালোলপথি’ বলছে, নায়াররা আদতে ক্ষত্রিয়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল অহিছত্র দেশ বা উত্তর পাঞ্চাল। সেখান থেকেই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে, বসবাস শুরু করেন তাঁরা। তা হলে কি আভিয়াল উত্তর ভারত থেকে আসার পথেই ভীমের গল্প সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে? নাকি পাণ্ডবরা নিজেরাই আভিয়াল নিয়ে এসেছিলেন কেরলে?
আর একটা গল্প। কত্তারাথিল সঙ্কুন্নি তাঁর ‘আইথিহিয়ামালা’তে লিখেছেন, ত্রাভাঙ্কোরের মহারাজা ‘মুরাজাপাম’ নামে বিশেষ পুজো-যজ্ঞ করতেন। অনেক পণ্ডিত, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আসতেন। এক বছর মুরাজাপাম-এর শেষ দিনে সব সবজি শেষ। তখন প্রধান-রাঁধুনি করলেন কী, ফেলে দেওয়া সবজি সরু ফালি করে কেটে আভিয়াল রেঁধে রাজার সম্মান বাঁচালেন। তা এতই সুস্বাদু হয়েছিল যে রাজা তাঁকে সোনার কাঁকন পুরস্কার দেন ও আদেশ করেন, তাঁর মুরাজাপাম-এ প্রত্যেক বছর যেন আভিয়াল রান্না হয়।
pinakee.bhattacharya@gmail.com
আমার জন্য প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন
বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার, ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন, তিরুবনন্তপুরম। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিজীবন শুরু হল এই ঠিকানা থেকেই।
শহর থেকে প্রায় দশ-পনেরো কিলোমিটার দূরে, বিশাল এলাকা নিয়ে স্পেস সেন্টার। রোজ সকাল আটটায় নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ঝকঝকে অফিস-বাসের অপেক্ষায়। বাসযাত্রাটা ছিল বড়ই মনোরম। সুন্দর মসৃণ রাস্তা, কখনও এঁকেবেঁকে নীচে নামছে, কখনও উঠছে ওপরে, দু’পাশে নারকেল আর রবার গাছ। গাছগাছালি আর সামুদ্রিক মাছের বিচিত্র গন্ধে ভরা সকালের বাতাস চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ত। তিরুবনন্তপুরম এয়ারপোর্টকে পিছনে ফেলে এক সময় বাস এসে দাঁড়াত সিকিয়োরিটি গেটের সামনে। থুম্বা ইকোয়েটারিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন। আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে, কড়া নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে, হেঁটে যেতাম যে যার ক্যাম্পাস-শেডে।
আমাকে দেওয়া হল স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইক্ল-৩ বা এসএলভি-থ্রি প্রজেক্টে। প্রথম স্যাটেলাইট ‘রোহিণী’র ওজন ছিল মাত্র চল্লিশ কেজি। স্যাটেলাইট বা পে-লোডে বিভিন্ন প্যারামিটার মাপার জন্য থাকত বিভিন্ন সেন্সর আর গাদা যন্ত্রপাতি— ট্রান্সমিটার, রিসিভার। আমার কাজ ছিল এই যন্ত্রগুলোকে স্যাটেলাইটে প্রতিস্থাপন করে পরীক্ষা করা, আর মূল রকেটের সঙ্গে ‘ইন্টিগ্রেট’ করা।
সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে পাঁচটা অফিস, শনি-রবি ছুটি। কিন্তু ব্যস্ততার সময়, সময়ের ঠিক-ঠিকানা থাকত না। শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় হয়তো গ্রুপ-হেড এসে বললেন: ‘রবিবার ঠিক সকাল দশটায় ভাইব্রেশন টেব্ল রেডি থাকবে। পল, প্লিজ টেক নোট। ভিইক্ল উইল পিক ইউ আপ অ্যাট নাইন।’
আমাদের ক্যান্টিনটা ছিল সমুদ্র-লাগোয়া। খাওয়ার টেবিলে বসে জানলা দিয়ে সীমাহীন সমুদ্র দেখতাম। মন খুলে হত গালগল্পও— আজ বাসে কী হল, নটরাজনের বস কেমন ঘাড় ঘুরিয়ে স্বাতীরত্নমের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর স্বাতীই বা কী ভাবে হেসে সাড়া দিচ্ছিল, সব। মালয়ালম ভাষায় ‘পাল’ শব্দটার অর্থ দুধ। আমার পদবি পাল হওয়ায় নানান ডাকনাম জুটল: পল, পাল, পালে, পালু, পালুলু, মিল্কু। ‘মিট মিস্টার পল’ বলে যখনই কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হত, উলটো দিক থেকে প্রশ্ন আসত: ‘ভিডু এবিডে?’ মানে, বাড়ি কোথায়? ওঁরা মনে করতেন, আমি বুঝি মালয়ালি খ্রিস্টান।
এসএলভি-থ্রি প্রজেক্টের প্রজেক্ট ডিরেক্টর, সর্বময় কর্তা ছিলেন স্বনামধন্য ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম। আমরা এক ঝাঁক নতুন মুখ, খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখেছি। গুড মর্নিং-গুড ইভনিং তো বটেই, নানান মিটিংয়ে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে, অনেক কিছু শুনেছি, বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। এক দিন সকালে ডক্টর কালামের সঙ্গে এক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারের প্রথম সাক্ষাৎ। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ডক্টর কালাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং?’ উৎফুল্ল হয়ে তিনি উত্তর দিলেন: ‘নো প্রবলেম স্যর, এভরিথিং ইজ ফাইন স্যর।’ ডক্টর কালাম এগিয়ে যেতে যেতে বললেন: ‘দ্যাট মিন্স ইউ হ্যাভ নট ডান এনিথিং।’ মানে, কাজ করলে কিছু না কিছু সমস্যা তো থাকবেই! সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারমশাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।
প্রজেক্টের কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব ডক্টর কালামের নজরে থাকত। মৃদুভাষী তিনি সবার সঙ্গে কথা বলতেন, সব খবরাখবর রাখতেন। এক দিন অ্যাডমিন শেড থেকে ওয়ার্কশপ শেডের দিকে যাওয়ার পথে, ইন্টিগ্রেশন-এর গ্রুপ-হেড তাঁর মুখোমুখি। ডক্টর কালাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য স্টেটাস অব ইউনিট/কম্পোনেন্ট ভাইব্রেশন টেস্ট?’ খুব যত্ন সহকারে, বিশদ ভাবে গ্রুপ হেড তাঁকে সমস্তটা বুঝিয়ে বললেন। ডক্টর কালামও মন দিয়ে শুনলেন, তার পর শুধু বললেন, ‘আই সি।’ বলে এগিয়ে চলে গেলেন। মানে: ‘আমি তো জানি, দেখলাম তুমি জানো কি না।’
মজার ঘটনাও ঘটত। ওয়ার্কশপে ডক্টর কালাম এক জনকে ফোনে খুঁজছেন। ফোন ধরলেন অন্য এক কর্মচারী। ডক্টর কালাম বলছেন: ‘আই অ্যাম কালাম হিয়ার, হু আর ইউ স্পিকিং?’ কর্মীটি উত্তর দিল: ‘সালাম স্যর।’ ডক্টর কালাম যত বার জিজ্ঞেস করেন ‘হু ইজ স্পিকিং’, তত বারই ও-পার থেকে উত্তর আসে, ‘সালাম স্যর।’ কী বিপত্তি! পরে জানা গেল, ফোনের ও-পারে কর্মীটির নামই সালাম। সেই নিয়ে তুমুল হাসাহাসি।
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায়, এসএলভি-থ্রি রকেট লঞ্চিংয়ের কাজে সবাই ব্যস্ত। লঞ্চিংয়ের দিন এগিয়ে আসছে, এক দিন ডক্টর কালাম আমাকে বললেন: ‘পল, টুমরো ইউ হ্যাভ টু গো টু কার নিকোবর টু কন্ডাক্ট স্যাটেলাইট কমপ্যাটিবিলিটি টেস্ট।’ মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, ‘রকেট লঞ্চিং ডেট ইজ নিয়ারিং, স্যর!’ ওই সময়টাতেই যদি থাকতে না পারলাম, তবে তার থ্রিলটা উপভোগ করব কী করে! উনি শুধু বললেন, ‘পল, আই শ্যাল সি দ্যাট ইউ আর ব্যাক বিফোর দ্য রকেট ইজ লঞ্চড।’ পর দিন বেরিয়ে পড়লাম কার নিকোবরের পথে। সব কাজ করলাম। যে দিন ফিরব, দেখি, আমাকে নিতে আসা ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের প্লেনটায় আমিই একমাত্র যাত্রী। পাইলট বললেন, ‘মিস্টার পল, ক্যান ইউ সি, ইউ আর দি ওনলি প্যাসেঞ্জার, আ ভিআইপি!’ বুঝলাম, সবই হয়েছে ডক্টর কালামের নির্দেশে। অত ব্যস্ত এক জন মানুষ, কনিষ্ঠ এক ইঞ্জিনিয়ারের আবদার রেখে রকেট লঞ্চিংয়ের ঠিক এক দিন আগে আমাকে শ্রীহরিকোটায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। দেখা হতে বললেন, ‘সো ইউ আর ব্যাক ইন টাইম, এনজয় দ্য থ্রিল নাউ!’ ১৯৮০-র ১৮ জুলাই শ্রীহরিকোটা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে এসএলভি-থ্রি রকেটের সাহায্যে স্যাটেলাইট ‘রোহিণী’র সফল প্রতিস্থাপন করেছিলাম আমরা সবাই মিলে। কী আনন্দের যে ছিল সেই দিনটা! এখনও মনে আছে। আর মনে আছে জ্বলজ্বলে, দৃৃঢ়চেতা সেই মানুষটাকে। আমার প্রজেক্ট ডিরেক্টর, এপিজে আব্দুল কালাম।
দেবাশিস পাল, বিশালাক্ষীতলা, বেহালা
dpaliicb@gmail.com
যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১