RJ রাজা

শুনলাম, পরে চিনলাম

আমার ছোটবেলাতেই আলাপ তাঁর সঙ্গে— বেতার মাধ্যমে। খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার আমাদের। দুপুরবেলার সঙ্গী অংক হোমওয়ার্ক আর রেডিয়ো। ছোট থেকেই আমি একটু চুপচাপ। বেশি বন্ধুবান্ধব নেই। যা কিছু ওই রেডিয়ো। বেশ কিছু গান-নির্ভর অনুষ্ঠান হত। আর সেই গানগুলোকে অভিনব ভাবে জুড়তেন তিনি। এখন নিজে যখন কাজ করি একই মাধ্যমে, যা যা জেনেছি, যতটুকু জানি আর কী, তাতে বুঝেছি, আসল হচ্ছে: সংযোগ বা ‘কানেক্টিভিটি’।

Advertisement

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আমার ছোটবেলাতেই আলাপ তাঁর সঙ্গে— বেতার মাধ্যমে। খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার আমাদের। দুপুরবেলার সঙ্গী অংক হোমওয়ার্ক আর রেডিয়ো। ছোট থেকেই আমি একটু চুপচাপ। বেশি বন্ধুবান্ধব নেই। যা কিছু ওই রেডিয়ো। বেশ কিছু গান-নির্ভর অনুষ্ঠান হত। আর সেই গানগুলোকে অভিনব ভাবে জুড়তেন তিনি।

Advertisement

এখন নিজে যখন কাজ করি একই মাধ্যমে, যা যা জেনেছি, যতটুকু জানি আর কী, তাতে বুঝেছি, আসল হচ্ছে: সংযোগ বা ‘কানেক্টিভিটি’। যা বলছি তা শ্রোতাকেই বলছি সরাসরি। আর খুব কাছে বসেই বলছি, বন্ধু হয়ে। সেই উষ্ণতা-টা চাই। তার পর ‘কনটেন্ট’। সেটা যদি যে শুনছে, তার দেখা বা জানার সঙ্গে মিলে যায়, তার অনুভূতিগুলো মিশে যায় বক্তার বলার সঙ্গে— তা হলে কথাগুলো তাকে নাড়া দিয়ে যাবে। তখনকার দুপুরগুলোতে আমার কাছে এই সবের সমষ্টি ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।

হঠাৎ এক দিন দূরদর্শনে তাঁকে খবর পড়তে দেখলাম। তার আগে অবধি, শুধুই গলা শুনেছি। সাধারণত রেডিয়ো শুনে যে কল্পনা হয় এক জনের সম্পর্কে, তা কখনওই মেলে না, আমারও তা-ই হল। আচ্ছা, ইনিই! খবর পড়া দেখতে দেখতে একটা জিনিস লক্ষ করার চেষ্টা শুরু করলাম। কিছু বিশেষ বিশেষ শব্দ যা ওঁর উচ্চারণে অন্য মাত্রা পায়, সেগুলো কী ভাবে বলছেন, মানে বলার সময় আলাদা কী করছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

Advertisement

ভাল গলার স্বর শুনলে আমার দারুণ লাগে। ছোটবেলায় আমার গলার স্বর খুব খারাপ ছিল। তাই কথা আরও কম বলতাম। শুধু শুনে শুনেই কেটে গেছে ছোটবেলা। এর পর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠান রেডিয়োতে যে দিনগুলোয় হত, রেডি থাকতাম— গলাটা শুনলেই রেকর্ড করতে শুরু করতাম। নানা অনুষ্ঠানের ছোট ছোট অংশ শুনতাম। ভাবতাম, ঠিক কী প্রক্রিয়ায় এ ভাবে বলেন?

কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। অল্প কিছু অনুষ্ঠান করতে শুরু করেছি তখন। কিছুই পারি না, তবুও কানে শোনা কিছু জিনিস— ওটুকুই সম্বল। কবিতা বলা শুরু, বিভিন্ন জনকে একটু একটু করে চিনতে শেখা। হঠাৎই এক দিন উত্তম মঞ্চে একটি অনুষ্ঠানে গেছি, দেখি সংযোজনায় উনি।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, আমার কী যে হল, দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে ডেকে বললাম, ‘আমার নাম রাজা। আপনার কাছে শিখতে চাই। শেখাবেন?’ আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, বললেন, ‘এখন তো কোথাও শেখাচ্ছি না, তুমি তিন মাস বাদে যোগাযোগ কোরো।’ একটি ল্যান্ডলাইন নম্বর দিলেন। আমি তখন আনন্দে দিশাহারা। তিন মাস পর ভয়ে ভয়ে ফোনটা করেই ফেললাম। সেই কণ্ঠস্বর। মনে করাতে চেষ্টা করলাম আমাকে। হয়তো ভুলেই গেছেন। বললেন, ‘ও হ্যাঁ, তুমি অরবিন্দ ভবনে চলে এসো। শুক্রবার বিকেল পাঁচটায়।’

এখান থেকে আর এক আরম্ভের শুরু। ওঁর ক্লাসে যোগ দিলাম। প্রথম দিকটা মনে আছে বেশ। বললেন, ‘একটা কবিতা শোনাও।’ তখন ভাবতাম, ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা আমি খুব ভাল বলি। তাই খুব উৎসাহ নিয়ে শোনালাম। নিশ্চয়ই ‘দারুণ’ বলবেন। বলা শেষ। দেখি কিছুই বলছেন না। কিছু ক্ষণ পর বললাম, ‘কিছু বললেন না?’ বললেন, ‘তোমাকে নিশ্চয়ই অনেকে বলেছে যে তোমার গলাটা খুব সুন্দর, তাই না?’ আমি হতবাক। ‘কেউ কথা রাখেনি নেগেটিভ একটা স্টেটমেন্ট। এত মিষ্টি করে বলতে কাউকে আগে শুনিনি।’

সেই শুরু। মডিউলেশন বুঝতে শেখা। গলা ভাল হলেই যে ওটা থাকে না, বা ওটা না থাকলে কিছুই আসলে হয়ে ওঠে না— এই বেসিক জায়গাটা বুঝতে শেখা।

এর পর খুব কাছ থেকে শিখতে পারা। যেটা সত্যিই একটা জার্নি। শিখেছি ক্লাসের বাইরেই বেশি। যেখানে যেখানে অনুষ্ঠান বা রেডিয়ো বা টেলিভিশন বা ভয়েস ওভার, চেষ্টা করতাম যেতে। রাস্তায় নানা গল্প শুনতে শুনতে যাওয়া। নানা অভি়জ্ঞতা— রেডিয়ো উপস্থাপনা, রেডিয়ো নাটক, গল্পপাঠ, বিজ্ঞাপনের কাজ— এই সমস্ত গল্প। এক দিন বললেন, ‘শোন, প্রতিটা শব্দের একটা ক্যারেক্টার আছে। তুই যদি শব্দগুলোকে ভালবেসে তাদের ক্যারেক্টার অনুযায়ী বলার চেষ্টা করিস, ওরাও তোকে ফেরত দেবে। তখন দেখবি তোর বলা সবার ভাল লাগছে।’

তত দিনে আমি ‘তুই’ হয়ে গেছি। আর আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি যতটুকু নিতে পারি। আলাদা আলাদা করে বলার স্পিড শেখা। অর্থাৎ উপস্থাপনার স্পিড, খবর বলার স্পিড, গল্প বলার স্পিড এক নয়।

‘ধর, তুই জানিস এর পর এক জন নির্দিষ্ট শিল্পীর গান আছে, বা বিশেষ একটা গান আছে, কিন্তু সেটা শ্রোতা জানে না। একটা ঘটনা বলতে শুরু করলি, নিজের জীবনের হোক বা অন্য কিছু, তিন-চার লাইন বলেছিস, সবাই ভাবছে কেন বলছে এটা? তার পর আরও তিন-চার লাইনে তোকে ঘটনাটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে, যার পরে ওই গানটাই অবধারিত। ওখানেই মজা। ওখানেই আলাদা মাত্রা আনা। অন্য এক প্রসঙ্গকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। এটা রেডিয়ো, স্টেজ দুটোতেই খুব কাজে আসে।’

এই সবই ছোট থেকে আজ অবধি আমার পথ চলার অ্যাসেট। যতটুকু কাজ করেছি, তার সঙ্গে এই কথাগুলো থেকেছে। মাঝে মাঝে যখন আত্মবিশ্লেষণ করি, এ সব উলটেপালটে দেখি। বুঝতে চেষ্টা করি, কোনও কাজ কি পঞ্চাশ শতাংশও করতে পেরেছি?

এই কয়েক বছরে দুনিয়াব্যাপী সব কিছুই অনেকটা বদলেছে। সাউন্ডস্কেপ বদলেছে সব কিছুর। সাউন্ড ডিজাইন বড় ভাল জিনিস। নতুন নতুন পদ্ধতিতে কাজ করতে পারছি। সত্যিই দারুণ। কিন্তু সব সময় মনে হয়, মূল ব্যাপারগুলো ‌তো পালটায়নি। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, সেই সম্পর্কের উষ্ণতা, সেই ভাললাগাগুলো— এ সব কি বদলেছে? মনে হয় না। মন থেকে কথা বলে, ভালবেসে ছুঁতে চাইলে এখনও ছুঁতে পারি তো? এই নতুন সময়ে, নতুন সাউন্ডস্কেপে, কথা বলার জাদু শিখতে তাই সেই মানুষটার কাছেই ফিরে আসব। শুধু কণ্ঠস্বরের অনন্যতার জন্য নয়, মানুষের মনে একটু অন্য রকম ভাবে পৌঁছতে পারার রহস্য জানতে।

সেই কবিতাটা সম্প্রতি রেকর্ড করেছি, ‘কেউ কথা রাখেনি।’ এখন ওঁকে সতীনাথদা বলি। অনেক সময় এ রকম আবদারও করে ফেলি, ‘একটু ফোনেই বলে দেবে? এই জায়গাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

ছোটবেলার সেই দুপুরগুলো আজও সঙ্গে আছে। সেই মুগ্ধতাও। সময়টা পালটে গেছে শুধু। কতটা পারব জানি না, তবে ইচ্ছে আছে এমন একটা অনুষ্ঠান কি কোনও দিন করতে পারব, যে দিন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে সবাই?

যেমন, আমি বসে থাকতাম, কখন শুনব সেই কণ্ঠস্বর— ‘আমি সতীনাথ আপনাদের সঙ্গে।’

rajanantu2006@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement