দূরদর্শনের শান্তিনিকেতন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অরুণা চক্রবর্তীর সঙ্গে পঙ্কজ সাহা
অ ল্প বয়স থেকেই কবিতা লেখালিখির সূত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। সব সময় পেয়েছি তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয়। কিন্তু অনেক সময় কঠোর হতেও দেখেছি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ৭৫তম জন্মদিনের অনুষ্ঠান ভাষা পরিষদে, আমি সংযোজনা করছি। সুনীলদার উপস্থিতিতে অনেক অনুষ্ঠানই আগে সংযোজনা করেছি, কখনওই কোনও মতামত দিতেন না। সে দিন বললেন, ‘প্রতিটি ঘোষণার আগে অবশ্যই আমায় জিজ্ঞেস করে নেবে।’ বুঝলাম, কতটা শ্রদ্ধা করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। যখন আকাশবাণীতে চাকরি আরম্ভ করলাম, ‘যুববাণী’ অনুষ্ঠান শুরু করেছি আমরা, সুনীলদা খুব আগ্রহ নিয়ে যুবক-যুবতীদের এই অনুষ্ঠানের কথা জানতে চাইতেন। বলতেন, ‘এই বয়সে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করবে। কিন্তু রেডিয়ো নিয়ে মেতে উঠেছ বলে কবিতা লেখার ব্যাপারে অবহেলা কোরো না।’ তরুণ কবিদের প্রতি তাঁর আশ্চর্য ভালবাসা!
কলকাতায় টিভি আসার পর প্রথম কবিতার অনুষ্ঠানেই সুনীলদা অংশ নিলেন, সঙ্গে আরও কয়েক জন খ্যাতনামা কবি। সেই অনুষ্ঠান রেকর্ডিং নিয়ে নবনীতা দেবসেন একটা খুব মজার লেখা লিখেছিলেন কৃত্তিবাস-এ। এই প্রথম পর্বের কৃত্তিবাসে যখন আমার কবিতা প্রথম বেরলো, সুনীলদা ফোনে বললেন, ‘বাড়িতে এসো, সংখ্যাটা আমি নিজে হাতে তোমাকে দেব।’ পরে ‘দেশ’-এ কবিতার পাতায় আমাকে দিয়ে অনেক লিখিয়েছেন, আমার অনেক বই আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেছেন, তাঁর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছি, কিন্তু সে দিনের সেই উত্তেজনা কোনও দিন ভুলবার নয়।
আমার প্রযোজিত বেশ কয়েকটি ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর সুনীলদাকে প্রস্তাব দিলাম, অনুষ্ঠানটি সংযোজনা করার জন্য। এক কথায় রাজি! তিনি হয়ে উঠলেন এই অনুষ্ঠানের এক নিয়মিত সংযোজক। রেকর্ডিং কিংবা লাইভ অনুষ্ঠানের আগে এক দিন এসে কী চাইছি তা বুঝে নিতেন, রিহার্সাল করতেন। কখনও আসতে দেরি করতেন না। মনে হত যেন এটাই তাঁর প্রফেশন। কত দিন দুপুরে রেকর্ডিং হয়ে যাওয়ার পর অন্য অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, চলো সুনীল, কোথাও গিয়ে আড্ডা দিই! সুনীলদা সঙ্গে সঙ্গে রাজি। অথচ উনি তখন ব্যস্ততম জনপ্রিয় লেখক, এবং দায়িত্বশীল চাকরি করেন। কিন্তু ওঁর হাবভাব দেখলে মনে হত, যেন তিনি অনন্ত ছুটিতে। তখন টিভিতে যাঁদের দেখা যেত, তাঁরা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতেন। সুনীলদার বিপুল সাহিত্যিক জনপ্রিয়তার জন্যে কত লেখক যে তাঁকে তীব্র ভাবে ঈর্ষা করতেন, টের পেতাম। অনেকেই বলতেন, শুধু সুনীল কেন, আমরাও তো সংযোজনা করতে পারি! অনেক তিরস্কার, কুকথা, আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু টিভির মতো এমন জটিল, আধুনিক একটা মাধ্যমে সংযোজনার কাজটা যে সবাইকে দিয়ে সম্ভব নয়, সেটা বোঝানো যেত না।
কলকাতা দূরদর্শনের তিরিশ বছরে আমি কিছু গুণিজনকে ‘দূরদর্শন সম্মাননা’ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত সেই বর্ণময় লাইভ অনুষ্ঠানে সম্মাননা দেওয়ার জন্য সাহিত্যজগৎ থেকে বেছে নিয়েছিলাম সুনীলদাকেই। অনেকগুলো সংস্থা, যেমন ‘বুধসন্ধ্যা’, ‘ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি’, ‘বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব কমিটি’তে সুনীলদার সঙ্গে আমি বিশেষ ভাবে যুক্ত ছিলাম। সেখানে দেখেছি তাঁর সহজাত নেতৃত্ব, সংগঠনের ক্ষমতা। আড্ডা ছাড়া সুনীলদা ভালবাসতেন খোলা গলায় গান গাইতে আর নাটক করতে। মনে হত যেন সমস্ত গীতবিতানই তাঁর কণ্ঠস্থ। দূরদর্শনে সুনীলদা গেয়েছেন, অভিনয় করেছেন। এক বার রায়গঞ্জে একটা প্রেক্ষাগৃহ উদ্বোধন করতে সুনীলদা আর আমি গিয়েছি, ফেরার পথে আমাদের দেখে ট্রেনের চেকার দুজনের একটা কুপে-তে আমাদের জায়গা করে দিলেন। সারা রাত সুনীলদা তাঁর জীবনের অনেক অজানা কথা বললেন। আমি বললাম, মুখোমুখি বসে এ রকম একটা খোলামেলা অনুষ্ঠান করতে চাই। বললেন, ‘না না, এ সব ব্যক্তিগত ভাবে তোমাকে বলা।’
শান্তিনিকেতন দূরদর্শনে সুনীলদা এবং তাঁর উপন্যাসের অনুবাদিকা অরুণা চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর সুনীলদাকে দূরদর্শন কেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখালাম। দেখে বাস্তববাদী সুনীলদা বললেন, ‘এখন তো নতুন, তাই সবই ভাল। কত দিন এ রকম রাখতে পারো তা-ই দেখব।’ মাঝে মাঝে সুনীলদা তাঁর বই উপহার দিতেন। ‘মনের মানুষ’ বইটি দিয়েছিলেন। খুলে দেখি প্রথম পাতায় লিখেছেন, ‘সময় পেলে পড়ে দেখার জন্যে।’ অত বড় মানুষের এমন বিনয়! ২০১২-র পুজোর সময় বাংলাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ গ্রহণ করতে যাওয়ার আগে সুনীলদাকে জানালে তিনি সাগ্রহে বললেন, ‘ফিরে এলে সব গল্প শুনব।’ মহাষ্টমীর দিন অনেক রাতে ফিরলাম, পরের দিন সকালে উঠে শুনলাম সুনীলদা চলে গেছেন। গল্প আর শোনানো হল না।
pankajsaha.kolkata@gmail.com