সন্ত্রাস-রক্ত-ট্রাম্পেট

লিলি নামে মেয়েটার বয়স বছর তেরো। তার পুষ্যি হেগ্যানের বয়স কত জানা নেই, তবে কুকুর হিসেবে যে সে উঁচু পেডিগ্রিহীন, সেটা জানা গেছে। পাতি নেড়ি না হলেও দো-আঁশলা পথের কুকুর তো বটেই।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ০০:২৭
Share:

লিলি নামে মেয়েটার বয়স বছর তেরো। তার পুষ্যি হেগ্যানের বয়স কত জানা নেই, তবে কুকুর হিসেবে যে সে উঁচু পেডিগ্রিহীন, সেটা জানা গেছে। পাতি নেড়ি না হলেও দো-আঁশলা পথের কুকুর তো বটেই। ও দেশে ফ্ল্যাটবাড়িতে অমন কুকুর পুষতে গেলে রীতিমত গাঁটের কড়ি খরচা করে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। জাতজম্মের ঠিক না থাকা কুকুরের মালিক হওয়ার গুনাগার। আর সেটাই দিতে নারাজ লিলির বাবা দানিয়েল। লিলির মা-বাবার বিয়ে ভেঙে গেছে তার সেই কোন ছোটবেলায়, সে মায়ের সঙ্গেই থাকত। কিন্তু মা সেমিনারের জন্য তিন মাস অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে, তাই হেগ্যানকে নিয়ে তার বাবার সঙ্গে থাকতে আসা, আর হেগ্যানের কপাল থেকে ভদ্দরবাড়ির আশ্রয় ঘুচতে বসা! বাবা, মেয়ে ও আধা-নেড়ি কুকুরের পারিবারিক জটটাকে এ ভাবেই পরিচালক একটু একটু করে একটা রক্তাক্ত, বিস্ফোরক রাজনৈতিক মেটাফর-এর দিকে গড়িয়ে দিয়েছেন।

Advertisement

অথচ ছবিটাকে একটু এ-দিক ও-দিক করে নিলেই এক কিশোরী আর তার পোষা কুকুরের হাসি-অভিমান-সেন্টিমেন্ট মাখামাখি ভীষণ কিউট ‘শিশু চলচ্চিত্র’ হয়ে যেতে পারত। লিলি তাকে ট্রাম্পেট শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। বাথরুমে একলা শুতে হেগ্যানের ‘ভয় করবে’ বলে সে তার পাশেই একটা শুকনো বাথটবে রাত কাটিয়ে দেয়। হেগ্যানও আহ্লাদে তার আঙুল চেটে দেয়। কিন্তু এই সব মিষ্টি মানবিক মুহূর্তই তাঁর ছবির ফ্রেম ছেয়ে থাকুক, পরিচালক চাননি। দর্শককে তিনি শুরু থেকেই প্রস্তুত করতে করতে গেছেন। তাই কসাইখানার ইন্সপেক্টর দানিয়েলকে আমরা প্রথম বার দেখি তার অফিসে। তার পায়ের নীচে বয়ে যাচ্ছে রক্তের ক্ষীণ ধারা, সামনে ঝুলছে সারি সারি চামড়া-ছাড়ানো গরু। নিখুঁত পেশাদারি ক্ষিপ্রতায় ছুরি চালিয়ে দানিয়েল সেই শব ব্যবচ্ছেদ করে। ক্লোজআপে দর্শকের চোখের সামনে উপচে পড়ে স্বাস্থ্যবান, নীরোগ পশুর রাশি রাশি সুভক্ষ্য মাংস। মাংসের গায়ে দানিয়েল দেগে দেয় সরকারি সিলমোহর ‘নিশ্চিন্তে খান’!

মানুষের পণ্য-পৃথিবী এ ভাবেই তো পশু-শরীরকে ‘ভোগ্য’ বানায়। সাদা অ্যাপ্রনের গায়ে লেগে থাকা রক্তের ফোঁটাটুকু সাফ করার মতো করেই তো দানিয়েল মেয়ের প্রিয় পুষ্যিটাকে কুকুরদের উদ্ধার-আশ্রমে পাঠিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলতে চায়। পরিত্যক্ত, নিরাশ্রয় হেগ্যান এ বার আর এক রকম মাংস ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে। এরা খাবারের লোভ দেখিয়ে অকথ্য অত্যাচার করে, বীভৎস ট্রেনিং চালিয়ে হেগ্যানের নরমসরম আদুরেপনা ঘুচিয়ে, তাকে জঙ্গি, হিংস্র, যোদ্ধা-কুকুর বানায়। হেগ্যান যেন সেই প্রাচীন রোমের ক্রীতদাস গ্ল্যাডিয়েটর। নিজে বাঁচতে হলে লড়াইয়ের রিঙে অন্য কুকুরের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতেই হবে! এ ভাবেই যেন এক পথের কুকুরের জীবন-বৃত্তান্ত একাকার করে দেয় সে-কালের দাসপ্রথা আর আজকের পুঁজিশাসিত নয়া ক্রীতদাস-ব্যবস্থাকে— প্রতিযোগিতার নামে যেখানে বিপক্ষকে ময়দান থেকে হাওয়া করে দেওয়ার ‘খুনি প্রবৃত্তি’কেই বাহবা দেওয়া হয়।

Advertisement

হেগ্যান কিন্তু এ ‘ব্যবস্থা’ মেনে নেয় না। স্পার্টাকাসের দাস-বিদ্রোহের মতোই, বন্দি কুকুরদের একজোট করে সে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। অত্যাচারীদের খতম করার সেই অভিযানেও রক্তস্রোত, দপদপে হিংসা! ‘বিদ্রোহী’দের শায়েস্তা করতে রাষ্ট্রও নামিয়ে আনে পালটা সন্ত্রাস। কিন্তু বিদ্রোহ দমানো যায় না। শেষে তার ট্রাম্পেটটা হাতে, রক্তের আলপনা-আঁকা রাস্তায়, হেগ্যান আর তার কমরেডদের মুখোমুখি হয় লিলি। না, সে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো রাষ্ট্রের তরফে বিদ্রোহীদের ভোলাতে আসেনি। বরং বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সে তাদের সামনে নতজানু হয়। ক্যামেরার যে হাইট আর অ্যাঙ্গল এত ক্ষণ হেগ্যানের চোখ দিয়ে মানুষের দুনিয়াকে দেখছিল, সেটাই এখন দু’তরফেই সমান উচ্চতায় আসে। লাঞ্ছনা করেছ, এখন অপমানে ‘সবার সমান’ যে হতেই হবে! খানিক আগের উন্মত্ত পৃথিবী ভরে ওঠে রিচার্ড ভাগনের-এর সুরে মায়ায়।

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement