হ্যালো 60s

এক ফাটাফাটি সুপুরুষ যুবক স্বাধীন কিউবার প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৯৫৯-এ, আর আমিও আমেরিকায় গেলুম সমাগত ষাটের দশককে অভ্যর্থনা জানাতে।

Advertisement

নবনীতা দেবসেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:২২
Share:

এক ফাটাফাটি সুপুরুষ যুবক স্বাধীন কিউবার প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৯৫৯-এ, আর আমিও আমেরিকায় গেলুম সমাগত ষাটের দশককে অভ্যর্থনা জানাতে। ফিদেল কাস্ত্রো নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন সে বছরেই আর মেয়েরা চাইলেই চুমু বিলোচ্ছিলেন, কিন্তু আমি তখন কলেজে, হায়, হল না! সময়টা ভিয়েতনাম যুদ্ধের, সারা বিশ্ব জুড়ে সচেতন মানুষের যুদ্ধবিরোধিতা শুরু, নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির প্রতিবাদে বার্ট্রান্ড রাসেল-এর নেতৃত্বে ক্যাম্পেন ফর নিউক্লিয়ার ডিসার্মামেন্ট গড়া হয়েছে। অন্য দিকে আমাদের যৌবনকে মাতিয়ে রেখেছে বিট্ল্স-এর গান, জর্জ হ্যারিসন শিখছেন রবিশংকরের কাছে সেতার, কলকাতাতে হাত মিলেছে সুনীল শক্তির সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর। হায় আমি সেখানে নেই! আমি সান ফ্রান্সিস্কোতে ‘সিটি লাইট্স’ বই-দোকানে। গিন্সবার্গকে চিঠি লিখে শিগেকো-র হাতে রেখে আসছি। ১৯৬০, নিজের টিভি নেই? তো কী আছে, সারা রাত বন্ধুর বাড়িতে জেগে বসে টিভিতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিক্সন আর কেনেডির মধ্যে বিতর্ক দেখছি। নাঙ্গা তরোয়ালের খেলার মতো উত্তেজক প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেট, টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মার্কিন ইতিহাসে সেই প্রথম বার। ১৯৬১-তে আমেরিকার অন্ধকার দক্ষিণে চলেছে বর্ণবিদ্বেষবিরোধী বিপ্লব। এক দল দুঃসাহসী সাদা ও কালো স্বেচ্ছাসেবক এক সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে দক্ষিণের ইন্টারস্টেট বাসে চড়ে বসলেন। বর্ণবিদ্বেষীদের নির্মম আক্রমণ, রক্তপাত অগ্রাহ্য করে দলে দলে ‘ফ্রিডম রাইডার্স’ বাসে যেতে থাকলেন দক্ষিণে। আমার কৃষ্ণাঙ্গী বান্ধবী জেন বন্ড-এর ছোট ভাই জুলিয়ান বন্ড তাদের সঙ্গে যুক্ত, পরে জুলিয়ান সেনেটর এবং NAACP-র চেয়ারম্যান হন। জেন ছিল ম্যালকম এক্স-এর শিষ্য, তিনি তখন আফ্রো-আমেরিকান মিলনের জন্য নতুন এক ইসলাম ধর্ম চালু করে কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদে দারুণ সাড়া তুলেছেন। হস্টেলের মধ্যে জেন-এর কাছেই আমি শেষ রাতে উঠে রান্না করে রোজা রাখার ব্যাপারটি শিখলুম। দুঃখের বিষয়, ম্যালকম এক্স নিজে ধর্মান্ধ কৃষ্ণাঙ্গ আততায়ীদের হাতে প্রাণ হারান, ওই ষাটের দশকেই।

Advertisement

সিভিল রাইট্স মুভমেন্টের সঙ্গে কখন মানুষের মনে মনে জুড়ে গেল ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিবাদ, বার্কলি-তে শান্তিকামী ছাত্রদের মধ্যে শুরু হল ফ্রিডম রাইডারদের জন্য চাঁদা তোলা। কর্তৃপক্ষ বাধা দিলেন, আইন করলেন, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাজনৈতিক কারণে চাঁদা তোলা বা রাজনৈতিক আলাপ চলবে না। বার্কলিতে শুরু হয়ে গেল ফ্রি স্পিচ মুভমেন্ট।

সময়টাই ছিল বাঁধন ছিন্ন করার। বৃত্ত বড় করার। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে মুক্তকণ্ঠে কথা বলার দাবি উঠেছে। মানুষের অধিকার নিয়ে গান গাইছেন পিট সিগার, বব ডিলান, জোন বায়েজ। ’৬৩-তে পিট সিগার পার্ক সার্কাস ময়দানে গান গেয়েছিলেন, আমি শুনতে গিয়েছিলুম। সেই সময়েই লক্ষ লক্ষ বুকে আগুন জ্বেলেছিল বিখ্যাত সিভিল রাইট্স মার্চ-এ মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণ। আমেরিকায় আধুনিক নারীমুক্তি আন্দোলনের শুরুও তখনই। বেটি ফ্রিডান-এর ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ আর এক বার আমাদের চক্ষু উন্মীলন করল, ‘মিস আমেরিকা’-র দেহ প্রদর্শনীর প্রতিবাদে ‘ব্রা বার্নিং’ শব্দের উৎপত্তি হল ওই ষাটের দশকেই। এবং ষাটের দশকেই সুনীলকে লিখতে হল, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়’। তার বছর দুই বাদে অবশেষে মর্ত্যবাসীর স্বপ্নপূরণ করে বামনের চন্দ্রস্পর্শ ঘটিয়ে ষাটের দশকের আকাশস্পর্শী স্পর্ধায় যবনিকা নামল। ১৯৬৯-এ হার্ভার্ডে আমরা প্রথম বোকাবাক্সটা কিনেই ফেললুম, বাঃ, মানুষের চাঁদে নামা স্বচক্ষে দেখতে হবে না?

Advertisement

আমি এতটাই সৌভাগ্যময়ী, যত বিশেষ সময়ে যত বিশেষ জায়গায় কী সুন্দর সশরীরে হাজির রইলুম।
এক গুড ফ্রাইডেতে শ্রীলঙ্কার বন্ধু কুমারী জয়বর্ধনের সঙ্গে কেমব্রিজ থেকে লন্ডন গিয়েছিলুম, ট্রাফাল্গার স্কোয়্যার থেকে রওনা দিয়ে চার দিন ব্যাপী অলডারমাস্টন মার্চ-এ হাঁটতে। সেই মিছিলের হোতা বার্ট্রান্ড রাসেল স্বয়ং কোথাও উপস্থিত ছিলেন সেই সুদীর্ঘ যাত্রায়। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছিলুম বটে, কিন্তু চার দিন হাঁটিনি, শুধু প্রথম দিনটুকুই। আমি তখন সদ্য অন্তঃসত্ত্বা। ছোট ছোট দলে সারা
পৃথিবীর ছাত্ররা হাঁটছে, শান্তির পোস্টার নিয়ে, গান গাইতে গাইতে—
‘Ashes to ashes dust to dust
If the bomb doesn’t get you
the fall-out must!’— দলের ব্যানার বলে দিচ্ছে কারা কোথা থেকে এসেছে। আমাদের পিছনেই এক দল ভারতীয় ছাত্র ভাংড়া নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে আসছে। আজকের লন্ডনে সে দৃশ্য হয়তো পুরনো, কিন্তু ১৯৬৩-তে সেটা ছিল অদৃষ্টপূর্ব! মিছিল বার্কশায়ার-এর অলডারমাস্টন পারমাণবিক অস্ত্রাগারের সামনে গিয়ে আছড়ে পড়বে।

ওই যে বললুম, এমন কপাল, ইতিহাস যখন যেখানে, আমিও সেখানে। ১৯৬৩-তে অলডারমাস্টনের সময় ইংল্যান্ডে, কিন্তু পিট সিগারের সময় ঠিক কলকাতায়। আবার ১৯৬৪-৬৫’তে ঠিক পৌঁছে গিয়েছি পোস্ট ডক্টরাল করতে, বার্কলিতে, ফ্রি স্পিচ মুভমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে। মারিও সাভিও, বেটিনা আপ্টেকর, জ্যাক ওয়াইনবার্গদের সঙ্গে আমার আলাপ ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষবিরোধী গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের আড্ডায়। জ্যাক সে দিন একটা টেবিল নিয়ে ক্যাম্পাসে সিভিল রাইট্স বিষয়ে সংবাদ বিলোতে আর চাঁদা তুলতে বসেছিল, ক্যাম্পাস পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করল। কিন্তু আমরা বাধা দিলুম, ক্রমশ ৩০০০ ছাত্র জমায়েত হল, সগর্জনে গাড়ি ঘেরাও! টানা ৩৬ ঘণ্টা। পুলিশের গাড়ির ছাদে উঠে জ্যাক আর মারিও বক্তৃতা দিল, আমরা ঘিরে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিলুম। সেই শুরু। তার পরের ধাপে ঘটল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ‘স্প্রাউল হল’ জবরদখল করে দেড় হাজার ছেলেমেয়ের দিবারাত্রি ধর্না দিয়ে বসে থাকা। সেখানেই জোন বায়েজ এসেছিলেন, রাতভোর গান গেয়ে আমাদের মনোবল জোগান দিচ্ছিলেন। স্প্রাউল হল থেকে ভোর রাতে গ্রেপ্তার করা হল ৮০৬ জন ছাত্রকে, যা ইতিহাস হয়ে গেছে। আমাদের তার আগে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিল মারিও, বিদেশিদের ধরলেই ডিপোর্ট করে দেবে।
সম্প্রতি রাকা বার্কলিতে দেখাল, স্প্রাউল হলের সামনে একটি স্মারক অঞ্চল বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে, সেই বৃত্তে দাঁড়িয়ে যার যা খুশি বক্তৃতা দিয়ে যেতে পারো, নির্ভয়ে। ‘ফ্রি স্পিচ জোন’। রাকা হেসে বলল, ‘ওই যে, নবনীতাদি, তোমাদের ষাটের অর্জন!’

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 60s,
রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন