এক সময়ে এ শহরে ‘নাইটক্লাবে যাওয়া’ আর ‘তন্ত্র-তে যাওয়া’ দু’টো কথাই ছিল সমার্থক। মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে, দূরের কোনও এক অন্য রকম জায়গা। তবে দিন বদলে গিয়েছে। ক্লাব পার্টি-নাইট আউট এখন কলকাতার মধ্যবিত্ত মহলেও ইন থিং। রাত বারোটার পরে পার্ক হোটেলের পার্কিং লটে দামি গাড়ির পাশাপাশি দিব্যি জায়গা করে নিচ্ছে মাঝারি দামের ছোট গাড়িও। কেউ ফিরেও তাকায় না, কে কোন গাড়িতে উঠলেন দেখতে। কারণ, শহর এখন অনেক খোলামেলা। ডান দিকে সামপ্লেস এল্স আর বাঁয়ে গেলে সেই তন্ত্র। দাগ পড়া স্যান্ট্রো-র যুবকের সঙ্গেই কখন ডান্স ফ্লোরে আলাপ জমে যায় পোর্শে চালানো তরুণীর। কিছু ক্ষণের আড্ডা জমাতে কখনও হয়তো ডান্স ফ্লোর ছেড়ে তাঁরা বিশ্রাম নেন বাইরের লাউঞ্জে। কখনও বা পার্কিং লটের সামনেই পাঁচ মিনিটের স্মোক ব্রেক। তার পরে ফের ‘লেটস্ হিট দ্য ডান্স ফ্লোর’। শীত-শহরের মেজাজটা এখন এমনই।
হাওয়ায় হিমেল ছোঁয়া মানেই যে জমাটি হুল্লোড়। দলবেঁধে বা দোকা। কখনও একাও। শহর কিন্তু সবের জন্যই প্রস্তুত।
নাইটক্লাব থেকে পাব, লাউঞ্জ বার— হাতছানি দিয়ে ডাক দিচ্ছে সব মেজাজের মানুষকে। মায়াবী আলো-আঁধার, রকমারি মিউজিক। বছর শেষের সপ্তাহটায় হঠাৎ একটু উষ্ণতার সন্ধানে আর কী বা চাই? বাড়িতে গানবাজনা, রাতজাগা পার্টির পাশাপাশি নাইটক্লাব, ডিস্কোথেক-ও এখন মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে। বন্ধুরা দলবেঁধে অথবা বান্ধবীর সঙ্গে কিছু ক্ষণ উষ্ণতা বিনিময়ের ইচ্ছে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় যে কোনও নাইটক্লাবে।
মেজাজটাই তো আসল
রাত ১১টা বা তারও একটু পরে। দিনভর কাজের স্ট্রেস কাটিয়ে কিছু ক্ষণের ভেতর মনটাকে হাল্কা করে নিতে হবে। চাই মিউজিক। কোনও একটা নাইটক্লাবে সটান ঢুকে পড়লেই হল। মুহূর্তেই যেন নতুন মন।
ম্যাজিক তো শুধু সুরে নয়। ঢুকতেই যেন অন্য জগৎ। লাল-নীল-গোলাপি রঙা আলোর মিশেলে মায়া ছড়ানো চার ধার। ডান্স ফ্লোর সবে জমে উঠছে। চলছে রকমারি গানের রিমিক্স। মাঝে মাঝে আসছে অন্য গানের অনুরোধও। পিছনে চেয়ারে বসা দলবল তখনও ওয়ার্ম আপে ব্যস্ত। বার কাউন্টারে চরম শোরগোল। কখনও ব্লাডি মেরি তো কখনও গ্লেনফিডিশ— জোগান দিতে ব্যস্ত বারটেন্ডার।
ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই মেজাজ-বদল। কখন যেন ধীরে ধীরে বেড়ে গিয়েছে গানের তেজ। জোর কমেছে গোলাপি আলোর। আবহ আরও যেন নীলচে। উপচে পড়ছে নাচের জায়গা। হাজির বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে আনওয়াইন্ড করার মুহূর্ত। কখনও ব্লুজ, কখনও বা বলিউড। সুরে-তালে দুলছে ডান্স ফ্লোর। কখনও বা কিছুটা লাফালাফি। অ্যাম্বিয়েন্সটা যেন চোখ-কান ছাপিয়ে ধীরে ধীরে মাথায়-হাতে-পায়ে। হইচই করে তাল মেলাচ্ছেন আপনিও। কেটে গিয়েছে অচেনা ভিড়ের অস্বস্তি।
পা কিন্তু তখনও সাবধান। মাঝে মাঝে ক্লাব-কর্মীরা জানান দিয়ে যাচ্ছেন, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং। ক্যামেরা নজর রাখছে। দুষ্টুমি করুন, কিন্তু অভদ্রতা নয় মোটেই। অন্যের বৌ হঠাৎ বরের হাত ছাড়িয়ে পাশে এসে কাঁধ মেলাতে চাইলে ভয় নেই। সম্মতিতে কেউ দোষ ধরে না।
ইতিমধ্যেই ঘুরেফিরে ফের হাজির হোটেল-কর্মী। ডাকছেন। ভয় নেই। লাস্ট ড্রিঙ্কের সময় হয়ে গিয়েছে যে! সঙ্গীদের সঙ্গে মজে হয়তো বা শেষ ডিঙ্কটা বাতিলই হল। অমন উন্মত্ত সময়ে আর জলে কী বা এসে যায়। নেশা তখন প্রতিটি গানের তালে। কিছুটা হয়তো ঠেলাঠেলি তখন নাচের জায়গা করে নিতে। একটু দূরে নাচে মত্ত সুন্দরী হয়তো দেখা যাচ্ছে না আর সহজে। হঠাৎ এ সবের মধ্যেই আর এক সুন্দরীর দিকে এক ঝলক। হাতঘড়িতে চোখ রেখেছেন তিনি। পকেট থেকে টুক করে নিজের মোবাইল বার করে সময় দেখা।
পর দিনের অ্যাসাইনমেন্টটা যেন হঠাৎ স্মরণে এল। কিন্তু স্ট্রেস তত ক্ষণে গায়েব!
ফুর্তির ঠিকানা
শহরজুড়ে এখন নানা রকমের নাইটক্লাব। পাঁচতারা হোটেল থেকে বড় কোনও রেস্তোরাঁ, অনেক জায়গাতেই এখন নাইট ক্লাব রয়েছে। তন্ত্র-এর পাশাপাশি এ সময়ের আরও কিছু পরিচিত নামের মধ্যে অন্যতম হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালের আন্ডারগ্রাউন্ড, সুইসোটেলের মায়া, অ্যাস্টর হোটেলের প্লাশ। পার্ক স্ট্রিটের ভেদা রেস্তোরাঁর নীচতলায় ভেদা লাউঞ্জও অল্প দিনেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সল্টলেকের দিকে যেতে হলে ঘুরে আসা যায় শিমার্স এবং ব্যাকস্টেজ থেকে। ক্যামাক স্ট্রিটের শিশা আর মিন্টো পার্কের সোহো লাউঞ্জও পার্টি মহলে গুরুত্বপূর্ণ নাম। এ ছাড়াও আরও নতুন নতুন রাত পার্টির ঠেক হয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।
পার্টি সংস্কৃতি
একটু বেশি রাতে শুরু হওয়া এই ধরনের পার্টিতে সাধারণত একা কেউ যেতে পছন্দ করেন না। তাই দু’জন কিংবা বেশি লোক নিয়েই যাওয়ার রীতি। তবে কাপল ছাড়া ঢোকা যায় না, এমন ধারণা ভুল। একদল ছেলে বা মেয়ে দিব্যি যোগ দিতে পারেন পার্টিতে। বহু নাইটক্লাবেই এখন সপ্তাহে এক দিন করে ‘মহিলা স্পেশ্যাল রাত’ থাকে। আর একাই কিছু ক্ষণ পার্টি মেজাজে মজতে চলে যাওয়া যায় কোনও পাব বা লাউঞ্জে। অন্যের হুল্লোড়েই কখন যেন মন পার্টি-পার্টি হয় ওঠে।
নাইটক্লাবে নিরাপত্তার প্রশ্ন খুব সঙ্গত। কিন্তু নিজের সুরক্ষার বেশিটাই নিজের হাতে। একটু সচেতন থাকলেই পার্টি হতে পারে নির্বিঘ্ন ও আনন্দের। অপরিচিত কারও দেওয়া পানীয় বা লিফট না নেওয়াই ভাল। আর কর্তব্যরত হোটেল-কর্মীরা তো আছেন বটেই। অতিথিদের সুরক্ষা দেওয়াই তাঁদের দায়িত্ব।
গাড়ি না থাকলে নাইটপার্টি করা যায় না, এমন ধারণাও ভুল। পার্টি সংস্কৃতি কলকাতায় খুব জমজমাট না হলেও, ততটা পিছিয়ে নেই কল্লোলিনী। বেশির ভাগ নাইটক্লাবের সামনেই অনেক রাত পর্যন্ত ট্যাক্সির লাইন থাকে। পার্টি শেষে বাড়ি ফেরা তাই খুব অসুবিধের নয়।
খরচ কেমন
খরচও এখন মধ্যবিত্তের নাগালেই। পাঁচতারা হোটেলে দু’জনের খরচ হাজার তিন-সাড়ে তিন। তবে বান্ধবীকে নিয়ে রাত পার্টিতে মজা করা যায় মাথাপিছু ৬০০-৭০০ টাকা খরচেও।
তবে আর দেরি কী? নতুন বছর আসুক নতুন মেজাজে!