কালা ম্যাঘে রুপালি র‌্যাখা

ঠিক সেই গন্ধটা পেলাম আমি, অবিকল সেই গন্ধটা। আর অমনি ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে এল ইলিশের ঝাঁকের মতো মিষ্টি মিঠে স্মৃতির দল! বাইরে এখন বিকেলের বৃষ্টি, ইলশেগুঁড়ি। আর ওই দূর আকাশে ভাসছে কয়েক টুকরো কালো মেঘ, যেমন করে পদ্মা ভেসে যায় গঙ্গার টানে, কিংবা মেঘনার ডাকে তিতাসে ভাসতে থাকে আদরের নৌকা! লিখছেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Advertisement

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০০
Share:

ঠিক সেই গন্ধটা পেলাম আমি, অবিকল সেই গন্ধটা। আর অমনি ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে এল ইলিশের ঝাঁকের মতো মিষ্টি মিঠে স্মৃতির দল! বাইরে এখন বিকেলের বৃষ্টি, ইলশেগুঁড়ি। আর ওই দূর আকাশে ভাসছে কয়েক টুকরো কালো মেঘ, যেমন করে পদ্মা ভেসে যায় গঙ্গার টানে, কিংবা মেঘনার ডাকে তিতাসে ভাসতে থাকে আদরের নৌকা! ঠিক এই সময় আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। দু’চোখ ভিজে ওঠে আমার, বুকের ভিতর বেজে ওঠে বিষণ্ণ বর্ষামঙ্গল। কী যেন নেই আমার! কী যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি!

Advertisement

জীবনের এই প্রায় অপরাহ্নে, এই মার্কিনমুলুকে বসে, এখন পাতে ইলিশ পড়লেই এ রকম হয় আমার। আর সঙ্গে যদি থাকে ‘একখানি জলভরা কালো মেঘ রহিয়াছে ঢাকিয়া আকাশ’, আর সেই ইলশেগুড়ির ধারাপাত, আমার তখন ‘দ্যাশের স্মৃতি’ পেয়ে বসে। আমার ‘ঘুমিয়ে পড়া’ মায়ের সেই আশ্চর্য রান্নাঘর থেকে আমি দরদি ভাপা ইলিশের সুবাস পাই। বাড়ির উঠোনে গাছের ডালে মেলে দেওয়া মায়ের শাড়ির আঁচলে আমি খুশবু পাই সেই মায়াবি সর্ষে ইলিশের। এক্ষুণি, একটু আগে আমি এই গন্ধটাই পেলাম! ইলিশ মাছের পাতুরির কলাপাতার মোড়কটা খুলতেই সেই গন্ধটা ছেয়ে ফেলল আমাকে, জাদুর নেশার মতো!


—নিজস্ব চিত্র

Advertisement


ইস্টবেঙ্গল জিতেছে। আজ ন্যাশভিলে তাই আমাদের ইলিশ পার্টি, কাজলদার বাড়িতে, ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে নেমন্তন্ন সব্বার। কাজলদা মানে কাজল ইসলাম, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। রাজশাহির এক হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে! নিজের চেষ্টায় এত বড় জায়গা করে নিয়েছেন আমেরিকায়, কিন্তু ‘মার্কিন শরণার্থী’ কাজলদা ইলিশ মাছটা ছাড়েননি, আর ছাড়েননি বাঙাল ভাষা! আর আমি তো ঢাকা বিক্রমপুরের পোলা। শনিবারের সাতসকালে কাজলদার ফোন, ‘এই যে ঢাকার পোলা, চইলা আইস আমার বাড়ি, র‌্যালিস কইরা ইলিশ খাইবা’! কাজলদার যে বিবিজান, আমাদের পারুলবৌদি, ইলিশরান্নার হাতখানি তাঁর চমৎকার, আড়ালে-আবডালে ন্যাশভিলের অনেকে তাঁকে ডাকে ইলিশবৌদি বলে! তাঁর রান্নাঘরেই আজ ইলিশ মাছের পাতুরি!
কলকাতার বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ইলিশ নাকি এখন সেখানে খুব দামি! ইলিশ কিনলেই নাকি ক্রেতার বাড়িতে সিবিআই নোটিস পাঠায়, সারদার টাকা খেয়েছে বলে পাড়ার লোকেরা সন্দেহ করে! তাও তো বাজারে মেলে শুধু খোকা ইলিশ! আর এমন মন্দার বাজারে কি না আমেরিকায় বসে আমরা ইলিশ খাচ্ছি! তাও আবার কাজলদার বাড়িতে, ব্যাপারটা স্পেশাল, কারণ ওই ভদ্রলোক ইলিশের বিষয়ে এক্কেবারে মৌলবাদী রকমের গোঁড়া আপসহীন। এখানের যে বাংলাদেশি দোকানে ইলিশ পাওয়া যায়, সেখানে তিনি বলেই রেখেছেন, ‘আমার ওই সব খোকা-টোকা চলবে না মশাই, ওই খোকা ইলিশ হইল গিয়ে ধোঁকা ইলিশ। আমার চাই আসলি ইলিশ।’ তাই কাজলদার জন্য ওই দোকানে নিউইয়র্ক-শিকাগো-আটলান্টা থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে ইলিশ আনানো হয়। আর হ্যাঁ, পেটে ডিমওলা ইলিশ মোটে চলবে না, শর্ত দিয়েছেন কাজলদা!
কাজলদার এই ‘ইলিশিজম’ এক্কেবারে আমার বাবার মতো। আমাদের টালিগঞ্জের বাড়ি থেকে বাবা ইলিশ কিনতে আসত জগুবাবু বাজারে, সুলেমানচাচার দোকানে। ইলিশের চেহারা দেখেই বাবা বলে দিতে পারত এ মাছ পদ্মার, নাকি মেঘনা-তিতাসের, নাকি গঙ্গার। আমার ‘উদ্বাস্তু’ বাবা এপার বা ওপার বাংলায় বিশ্বাস করতে না, বাবা বলত, ‘অপার বাংলা’! তবে ইলিশের বেলা অন্য কথা। বাবা বলত, ‘জলের নীচে ইলশা গো প্রেথক ভূগোল আছে। ওরা সীমান্ত বোঝে, কাঁটাতার বোঝে! দেশভাগ মাইন্যা লইতে পারে নাই ইলশারা। এই লাইগ্যাই তেগো কইলকাত্তায় ইলশার এত আকাল’! ছিন্নমূল বাবা আমার ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছিল, কিন্তু ইলিশ মাছ আর বাঙাল ভাষাটা ছাড়েনি! আর হ্যাঁ, পেটে ডিমওলা ইলিশ মোটে পছন্দ করত না বাবা। একবার ‘না বুঝে’ ডিমওলা কিনে পরদিন ভোর ভোর সেই দোকানে হাজির হয়ে বাবার সে কি হম্বিতম্বি, ‘কী গো সুলেমান, তুমি যে কইলা ইলশার প্যাটে ডিম নাই, এ তো দেখি ভরা মাসের পোয়াতি’! জবাবে সুলেমানচাচার মস্করা, ‘আইগ্যা ভাইজান, যুবতী মাছ জলের তলায় কী দুষ্টলীলা করছে, কী কইরা কই কন’! দেশভাগের পর বাবা একবারই ওপারে গিয়েছিল, সেটা এই সুলেমানচাচার সঙ্গেই, তিতাস পাড়ের ব্রাহ্মণবেড়িয়ায়, সিনেমার শুটিং দেখতে! ঋত্বিক ঘটকের ক্যামেরায় তখন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নির্মিত হচ্ছে। বাবা সাক্ষী ছিল সেই ইতিহাসের। সুলেমানচাচার সেই ঘটি-বিবি বাবাকে একবার ইলিশ পোস্ত রেঁধে খাইয়েছিল, সেই স্বাদ বাবা কোনও দিনও ভুলতে পারেনি। বাবা বলত, ‘মানষের মইধ্যে ঘটি-বঙ্গাল আছে, ইলশার কোনও জাত নাই, ইলশার আছে সোয়াদ।’
বাবার পরে এমন ইলিশ-ফ্যান আমি একজনকেই দেখেছি, সেটা কাজলদা। উনি তাঁর একমাত্র ছেলের ডাকনাম রেখেছেন ইলিশ। ওনার বাড়ির ইলিশ পার্টিতে এখনও আমরা ঘটি-বাঙ্গাল নিয়ে ঘাড় ঝাঁকিয়ে তর্ক করি, গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করি ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান নিয়ে। নিজের শিকড়ের কথা বলতে গিয়ে কাজলদা গল্প করেছিলেন, ‘বুঝলা রে ভাই, আমার বাবা আছিলেন পদ্মানদীর মাঝি। উপন্যাসটা লেখার আগে মানিক বাড়ুজ্জে গ্যাছলেন আমাগো বাড়ি। সারা রাত্র ধইরা আমার বাবার লগে উনি মাঝিমল্লার আর জেলেদের জীবন লইয়া গপ্পো করছিলেন। মা মানিকবাবুরে ইলিশের ডিম ভাজা খাওয়াইছিল, এক্কেবারে ইলিশের ত্যালে ভাইজ্যা’। কাজলদার দুঃখ একটাই, আমেরিকার সব ইলিশ বরফে চোবানো। উনি বিলাপ করেন, ‘ছোট্টকালে জাইনতাম, জলে থাকে মাছ। আর এহানে তো দেখি বরফে থাকে মাছ! ভাই রে, পরবাসে নিয়ম নাস্তি’! তবুও তো এই প্রবাসে দৈবের বশে, আমরা ইলিশ মাছের পাতুরি খাই। তার কলাপাতার মোড়কটুকু খুললেই আমি সেই গন্ধটা পাই। আর অমনই আমার স্মৃতিতে উঁকি মারে সেই বিকেলের বৃষ্টি, ইলশেগুঁড়ি। আকাশে কয়েক টুকরো কালো মেঘ। বাজার থেকে ইলিশ কিনে ফিরেই বাবা আমাকে কোলে তুলে নিত। ইয়া বড়কা ইলিশটাকে ওই কালো মেঘের সামনে ধরে বাবা বলত, ‘বুঝলা খোকা ইংরেজিতে কয়, এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইন। এই ইলশা কিন্তু শুধু একটা মাছ না, এইটা হইল গিয়া ওই কালা ম্যাঘে রূপালি রেখা’। স্মৃতির কি আর শেষ আছে ছাই। ময়দানের বড়খেলায় ইস্টবেঙ্গল জিতলেই বাবা ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরত। আমাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে তখন শুরু হত ইলিশের আন্দভৈরবী। আকাশে একটু-সেকটু কালো মেঘ, খানিক ইলশেগুঁড়ি বারিশ। মা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্না করতে নামার আগে গ্রামাফোনে জর্জ বিশ্বাস চালিয়ে দিত। খুব আবছা বাঙ্গাল ডায়ালেক্টে সেই রবি ঠাকুরের গান যে কী মধুর লাগত আমার, ‘আমি সন্ধ্যার মেঘমালা।’ এ পাড়া সে পাড়ার লোকরা সে দিন আমাদের বাড়ি এসে পাত পেড়ে ইলিশ খেত। রাতে ঘুমের মধ্যে আমি মাকে জড়িয়ে ধরতাম যখন, তখন আমি মায়ের গায়ে সেই সর্ষে ইলিশের গন্ধটা পেতাম কিংবা সেই ভাপা ইলিশের সুবাস।
আজ কাজলদার বাড়িতে কলাপাতার মোড়কটা খুলতেই আমি ঠিক সেই গন্ধটা পেলাম। ‘ইলশার ঘ্রাণ’। অবিকল আমার ‘ইলিশ রাধিঁয়ে’ মায়ের গায়ের গন্ধ, ‘উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল/আনন্দ ভৈরবী’। কী যেন নেই আমার! কী যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার দু’চোখে ‘এমন বরষা ছিল সেদিন’! কেঁদে ফেললেন কাজলদাও। ছয় বছরের নাতি তাঁর ইলিশের পাতুরি দেখে প্রশ্ন করল, ‘হোয়াইট ইস দিস’? কাজলদা বললেন, ‘দিস ইজ আ ফিশ, অ্যান্ড ইটস নেম ইলিশ’। ইলিশ একটি মাছের নাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন উনি, কারণ উনি বিশ্বাস করেন, তাঁর নাতি হয়ে ইলিশ না চেনাটা ‘সামাজিক অপরাধ’। আসলে কাজলদার বাড়িতে পার্টি মানেই তো ইলিশ মাস্ট। অবশ্য ‘ঘটি’-দের জন্য চিংড়ির মালাইকারিও থাকে। কট্টর ঘটিদের মতো কাজলদার নাতিও সে দিকে হাঁটা লাগায়। জেট যুগের জেড জেনারেশন ওরা, ইলিশ খেতে বিস্তর সময় লাগে, ওদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই শর্টকাট হওয়া চাই, খাওয়াটাও। আমার কিশোরী কন্যাও ইলিশ-বিরোধী কাঁটার ভয়ে। আমার বাবা বেঁচে থাকলে খুব অভিমান করত। নাতনিকে কপট ধমক দিয়ে বলত, ‘ছি দিদিভাই, কাঠ বাঙ্গালবাড়ির মাইয়া হইয়া তুমি চিংড়ি খাও ক্যামনে। ওইটা কি মাছ নাকি, ওইটা তো পুকা। বাজারে মাছ দুই প্রকার, বুঝলানি, ইলিশ আর ফুলিশ। এইবার তুমি কোনটা খাইবা কও। এই বার তুমরা দ্যাশে আইলে, আমি তুমারে নিজের হাতে কাঁটা বাইছ্যা, গরম ভাত গাওয়া ঘি দিয়া মাইখ্যা ইলিশ ভাজা খাওয়াইমু, দেখবা, কেমন তার সোয়াদ’!
বাবা নেই আমার, মা-ও নেই। আমার কোনও দেশও নেই। শিকড় ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে! তবু, তবুও, এখনও, এই পরভূমে ইলিশের সামনে দাঁড়ালেই আমার মাথা নত হয়ে যায়! কেননা, ওই অলৌকিক মুহূর্তে ইলিশের সুবাস হয়ে আমার স্মৃতির জানলায় উঁকি মারে মানিক বাড়ুজ্জের পদ্মা, জর্জ বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত, ঋত্বিকের কোমলগান্ধার কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস। আমার চোখের সামনে অপার বাংলার স্বাধীন পতাকার মতো পতপত করে উড়তে থাকে আমার মায়ের শাড়ির আঁচল। আমার কান্না পায়। চারদিকটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসে।
আমার বাবা তখন সেই আঁধারে ইয়া বড়কা একটা ‘ইলশা মাছ’ আমার চোখের সামনে তুলে ধরে বলে, ‘বুঝলা খোকা, এইটা শুধু মাছ না, এইটা হইল গিয়া কালা ম্যাঘে রুপালি র‌্যাখা। ইংরেজিতে কয়, এভরি ক্লাউড হ্যাজ আ সিলভার লাইন’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন