জিভে জল, মুখে হাসি

তিন পুরুষ ধরে বর্ধমানে বাস। ঠাকুরদা শুরু করেছিলেন ফুচকার ব্যবসা। সেই ব্যবসাই করছেন নাতিরা। প্রতি দিন ফুচকা তৈরি করে বিকেল, সন্ধ্যায় বর্ধমানের নানা অলিগলিতে ফুচকা বিক্রি করেন এঁরা। ফুচকার ভরসায় সংসার চলছে বেশ কয়েকটি পরিবারের। লিখছেন আজ আমরা বর্ধমানের সেই ফুচকা মহল্লার কথা বলব। জানাব কী ভাবে ফুচকার ব্যবসা করে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে।

Advertisement

সুপ্রকাশ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ১৩:০৩
Share:

চলছে ফুচকা ভাজার কাজ। ফুচকার লেই বেলার পরে। ছবি: উদিত সিংহ।

‘দেখলে আসে জিভে জল/ আলু, মটর আর টকের জল/ নাদুস-নুদুস দেখতে বেশ/ এক কামড়েই করব শেষ’, ফুচকা নিয়ে এই লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। হবে নাই বা কেন? ফুচকার মাঝে গর্ত করে আলুর পুর দিয়ে সেটা তেঁতুল আর নানা মশলা মেশানো জলে ডুবিয়ে হাতে দেওয়ার আগেই জল চলে আসে জিভে। সারা ভারত জুড়ে নানা রূপে নানা নামে এর দেখা মেলে। পাড়ার কোন মোড়ে কোন ফুচকাওয়াল পসরা সাজান, কার ফুচকার কেমন স্বাদ তা অনেকের কণ্ঠস্থ থাকে। ফুচকা যেমন জিভে জল এনে দেয়, ঠিক তেমনই এই ফুচকা কারও ঘরে এনে দিচ্ছে ভাত। আরও ভাল করে বললে বর্ধমানের একটি মহল্লার রুটিরুজির জোগান দিচ্ছে ফুচকা। আজ আমরা বর্ধমানের সেই ফুচকা মহল্লার কথা বলব। জানাব কী ভাবে ফুচকার ব্যবসা করে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে।

Advertisement

বর্ধমান শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ময়ূরমহল পেড়িয়ে সাহাচেতনের হরিজনপল্লি পৌঁছলেই রাস্তার পাশে দেখতে পাবেন ইতিউতি দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুচকা বিক্রির গাড়ি। আর রাস্তার পাশের ঘরগুলির কাছ দিয়ে সকালেবেলা গেলে নাকে আসবে লুচি ভাজার গন্ধ। উঁকি দিতেই জিভে জল। আরে এত লুচি ভাজা হচ্ছে কেন? আসলে লুচি নয়, ভাজা হচ্ছে ফুচকা। সারা পাড়াটিই ফুচকার সঙ্গে যুক্ত। সকাল থেকেই বাড়ির সকলে মিলে ফুচকা ভাজতে বসে যান। সেই ফুচকা কাঁচের জারে ভরে নিয়ে বিকেলের আগেই ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে বিক্রির জন্য বেড়িয়ে যান বাড়ির পুরুষেরা। রাস্তায়ই দেখা মিলল সমীর মাঝির সঙ্গে। জানতে চাইলাম, এখানে ফুচকা তৈরি করে এই রকম কয়েকটি ঘর দেখাতে পারবেন? এক মুখ হেসে তাঁর জবাব, এই যা ঘর দেখছেন, সবাই তো ফুচকাই তৈরি করে। গোপাল, মদন, গণেশ, সঞ্জয়, শঙ্কর কার বাড়ি যাবেন বলুন? তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারলাম, এই পাড়ার প্রায় ১৫টি ঘর এই ফুচকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এক কথায় এটি একটি ফুচকামহল্লা। রাস্তায়ই দেখা মিলল, সঞ্জয় সিংহ নামে এক ফুচকা বিক্রেতার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল না। কারণ, সে দিন সঞ্জয়বাবু খুব ব্যস্ত ছিলেন। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন, তাঁকে সে দিন তেজগঞ্জে একটি বড় বিয়েবাড়িতে ফুচকা নিয়ে যেতে হবে। তাই মাল নিয়ে বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন। শোনা গেল, শহরের নানা জায়গায় বেচার পাশাপাশি, বড়বড় বিয়ে বাড়িতেও এই এলাকার ফুচকা যায়।

পাড়ার প্রায় সবাই ব্যস্ত। অবশেষে পাওয়া গেল বিনোদ সিংহ নামে অন্য এক ফুচকা ব্যবসায়ীকে। তিনি প্রথমেই দাবি করলেন, তিনি এ শহরের অতি পরিচিত ফুচকাওয়ালা। রোজ বিকালে হাউজিং মাঠের সামনে তাঁর ফুচকা না কি, শহরের অনেকেই মন ভরে খান! তাঁর কাছেই জানলাম, এই এলাকায় ফুচকা ব্যবসার রমরমা নিয়ে। বিনোদবাবু জানালেন, ঠাকুরদার আমলে গয়া থেকে তাঁদের পরিবার বর্ধমান শহরে চলে আসেন। ঠাকুরদা বর্ধমানে ফুচকার ব্যবসা করতেন। ঠাকুরদার হাত ধরে বাবা ভোলা সিংহও এই ব্যবসায় আসেন। তার পরে, বিনোদবাবু নিজে ও তাঁর ভাইয়েরাও এই ব্যবসাই করছেন। তিনি জানান, তাঁর কাকারাও এই ব্যবসায়ই করেন। পরিবারের ১০-১২ জন সদস্য ফুচকা নিয়ে কারবার করেন। শুধু তাই নয়, এই গোটা পরিবার ফুচকা ব্যবসার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। বিনোদবাবুর ছেলে জিৎ সিংহ শহরের নামী স্কুলে পড়াশোনা করে। শুধু তিনিই নন, গোপাল সিংহ, মদন সিংহ, গণেশ সিংহ, সঞ্জয় সিংহ, শঙ্কর সিংহদেরও একই ভাবে দিন গুজরান হয়। গরম কড়াইয়ে ফুচকা ভাজতে ভাজতে ব্যবসার খুঁটিনাটি শোনালেন বিনোদবাবু। জানালেন, এই ব্যবসা থেকে তাঁদের ভালই লাভ হয়।

Advertisement

ফুচকার লেই বেলার পরে।

সকালবেলা ময়দা, সুজি আর খাবার সোডা দিয়ে প্রথমে ময়দা মাখা হয়। তার পরে, ছোট ছোট লেই করা হয় লুচির মতো। ওই লেইগুলি বেলন দিয়ে বেলে তা গরম তেলে ছেড়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে ফুলকো ফুচকা। এই ফুচকা সকালে ভাজা হয়ে যায়।। রিফাইন তেল দিয়েই সাধারণত ফুচকা ভাজা হয়। আগে সর্ষের তেল দিয়ে ভাজা হলে এখনও সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। তার পরে, আলু সেদ্ধ করে, মশলা আর তেঁতুল জল তৈরি করে বিকেলে বা দুপুরের দিকে বেড়িয়ে পড়া ফেরি করতে। এটাই এই এলাকার রোজনামচা। আলুর পুরের সঙ্গে ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো, বিট নুন, সাধারণ নুন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। একই সঙ্গে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, কাঁচাছোলা, পাতিলেবু ইত্যাদি তেঁতুল জলের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। বিনোদবাবু জানান, এক কিলোগ্রাম ময়দা থেকে ৩৫০ পিস ফুচকা তৈরি হয়। তিনি নিজে প্রতি দিন প্রায় দেড় থেকে দু’ হাজার ফুচকা তৈরি করেন। এক কিলোগ্রাম ময়দার ফুচকা, পুর, জল সব নিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয়। যদি সব ফুচকা বিক্রি হয়, তা হলে, প্রতি কিলোগ্রামে ৩০০ টাকার মতো লাভ হয়। শুধু জল ফুচকা নয়, চুরমুর স্পেশ্যাল ফুচকাও বিক্রি হয়। স্পেশ্যাল ফুচকার জন্য আলাদা ভাবে ঘুগনি তৈরি করতে হয়। তবে তাঁর দামও আলদা।

বিনোদ সিংহ, ফুচকা ব্যবসায়ী

শুধু রাস্তার দাঁড়িয়ে ফুচকা বিক্রিই নয়। তাঁদের কাছে বিয়েবাড়ির জন্যও ফুচকার অর্ডার আসে। এই অর্ডার এলে তো সোনায় সোহাগা, এমনই দাবি বিনোদবাবুর। বিনোদবাবুরা জানাচ্ছেন, দু’ভাবে বিয়ে বাড়ির ফুচকার জন্য বায়না নেওয়া হয়। প্রথমত, মাথাপিছু আর দ্বিতীয়ত, প্রতি হাজার পিস অনুসারে। ধরা যাক, কোন বিয়ে বাড়িতে ৫০০ লোক নিমন্ত্রিত হয়েছেন। মাথাপিছু চুক্তি হলে ধরা যাক জন পিছু ১০ টাকা চুক্তি করা হয়। সেই অনুযায়ী ফুচকার বন্দোবস্ত রাখা হয়। অন্য দিকে, প্রতি হাজার ফুচকার জন্য ১৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এ বার যে বিয়েবাড়ি যত পরিমাণ ফুচকা চাইবে তাঁরা সেই পরিমাণ অর্ডার দেবেন। দিনের বিক্রিবাট্টার সঙ্গে মাসে দু’-একটি বিয়েবাড়ির অর্ডার পেলে বেজায় খুশি হন বিনোদ, গোপাল, মদন সিংহেরা। অন্যান্য ব্যবসার মতো, ফুচকার ক্ষেত্রে হাড়ভাঙা পরিশ্রম না করেই এই ব্যবসায় লাভ তোলা সম্ভব বলে এই ফুচকা বিক্রেতাদের দাবি।

আরও পড়ুন: জিভে জল আনবেই বাড়ির ফুচকা, পাপড়ি চাট

খুঁটিনাটি

• ময়দা, সুজি আর খাবার সোডা দিয়ে প্রথমে ময়দা মাখা হয়।

• তার পরে, ছোট ছোট লেই করা হয় লুচির মতো।

• ওই লেইগুলি বেলন দিয়ে বেলে তা গরম তেলে ছেড়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে ফুলকো ফুচকা।

• রিফাইন তেল দিয়েই সাধারণত ফুচকা ভাজা হয়। এক কিলোগ্রাম ময়দা থেকে ৩৫০ পিস ফুচকা তৈরি হয়।

• এক কিলোগ্রাম ময়দার ফুচকা, পুর, জল সব নিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয়। যদি সব ফুচকা বিক্রি হয়, তা হলে, প্রতি কিলোগ্রামে ৩০০ টাকার মতো লাভ হয়।

• চুরমুর স্পেশ্যাল ফুচকাও বিক্রি হয়। এর জন্য আলাদা ভাবে ঘুগনি তৈরি করতে হয়।

অন্যান্য ব্যবসার মতো এই ব্যবসায় সারা দিন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় না। সকালটা ঘরে বসেই কাজ করা হয়। বেলা, ভাজা, আলুর পুর তৈরির অনেকটাই বাড়ির মহিলারা সামলে দেন। সেই সময়ে অনেকে বাজারহাট করেন। অনেকে আবার অন্য কাজও করতে পারেন। দুপুরের পরে, বিকেল থেকে সন্ধ্যার দিেকই ফুচকা ব্যবসার আসল সময়। পশাপাশি, এই ব্যবসার জন্য বিশাল টাকাও পুঁজি প্রয়োজন হয় না। বছরের সব সময়েই ফুচকার চাহিদা থাকে। সেটাও এই ব্যবসার অর্থকরী দিক। এখন নানা উপলক্ষে উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই আছে। প্রায়ই শহরে মেলা, উৎসব বসে। সেই সময়ে বিক্রিবাট্টা ভালই হয়।

আরও পড়ুন: সিরাজের মটন বিরিয়ানির গোপন রহস্য এ বার ফাঁস! বানিয়ে ফেলুন বাড়িতেই

ব্যবসায় সমস্যা বলতে সেই রকম কিছু নেই বললেই চলে। আলু, পিঁয়াজ ইত্যাদির দাম বাড়লে একটু সমস্যা হয়। কারণ, সঞ্জয়বাবুর মতে, দাম এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেলেও সেই অনুপাতে ফুচকার দাম বাড়ে না। মূল্যবৃদ্ধি হলে সমস্যা হয়। আর সমস্যা হয় বর্ষায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে। বৃষ্টিতে মালপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে একটি দিনের রোজগার মাটি হয়ে যায়। এ ছাড়া পরিবারের সকলের চেষ্টায় এই ব্যবসা বেশ লাভদায়কই বলছে ফুচকা মহল্লার বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, এই ফুচকা নিয়ে সরকারি সাহায্য পেলে ভাল হয়। কারণ, তাঁরা বাপ, ঠাকুরদার আমল থেকে ব্যবসা করে আসছেন, কিন্তু সে ভাবে সাহায্য মেলে না। অনেক ছোট উদ্যোগ নানা সরকারি সাহায্য পেলেও, এই ব্যবসা কার্যত অবহেলায় থেকে গিয়েছে বলে ফুচকা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। বর্ধমান পুরসভার আধিকারিক তাপস মাঁকড় জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রম দফতরের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নানা প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পগুলির সুবিধা পেতে এঁরা পুরসভায় যোগাযোগ করতে পারেন।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন