তিরের ফলার মতো দেখতে ধারালো বস্তু। উজ়বেকিস্তানের গুহাতেও এমন তিরের ফলার মতো বস্তু মিলেছে। তবে সেগুলি পাথরের তৈরি, এবড়োখেবড়ো। ছবি: সংগৃহীত।
উজ়বেকিস্তানের ওবি-রাখমত গুহা। রাজধানী তাসখন্দ থেকে উত্তরপূর্ব দিকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে এই গুহার। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখান থেকে এমন কিছু জিনিস খুঁজে পেয়েছেন, যা বদলে দিতে পারে আদিম মানবপ্রজাতি নিয়ানডারথালদের নিয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণা।
নিয়ানডারথালেরা শিকার করত। তাদের খাদ্যাভ্যাসে মাংসের পরিমাণই ছিল বেশি। এই আদিমানবদের জীবাশ্মের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে আগেই তা জানা গিয়েছে। ঘোড়া, বাইসন, হাতি, গুহাবাসী সিংহের মতো জন্তু শিকারে পটু ছিল তারা। অস্ত্র বলতে ছিল মূলত বর্শা। কাঠের উপর পাথরের ফলা গোঁজা বর্শা। নিয়ানডারথালেরা তির-ধনুকের ব্যবহার জানত বলে কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে উজ়বেকিস্তানের ওবি-রাখমত গুহা থেকে পাওয়া নমুনা সেই ধারণা বদলে দিতে পারে।
গুহা থেকে পাওয়া গিয়েছে ত্রিকোণাকার ছোট ছোট কিছু পাথরের টুকরো। গড়ন যদিও পুরোপুরি ত্রিকোণাকার নয়। কিছুটা এবড়োখেবড়ো। কিছু পাথরের টুকরো আবার ভেঙে গিয়েছে, ক্ষয়ে গিয়েছে। ফলে প্রাথমিক ভাবে এগুলির উপর বিশেষ নজর যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই পাথরের টুকরোগুলির বয়স প্রায় ৮০ হাজার বছর। গবেষকদের অনুমান, সেগুলি সম্ভবত তিরের ফলা হিসাবে ব্যবহার করা হত। যদি তা-ই হয়, তবে এগুলিই হবে এখনও পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া প্রাচীনতম তিরের ফলা।
বর্তমানে তির-ধনুক ব্যবহারের সবচেয়ে প্রাচীন উদাহরণ রয়েছে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ায়। প্রায় ৭৪ হাজার বছর আগে সেই তির-ধনুক ব্যবহারের চল ছিল আদিমানবদের মধ্যে। কিন্তু তার সঙ্গে নিয়ানডারথালদের সরাসরি কোনও যোগ মেলেনি। তা অবশ্য উজ়বেকিস্তানেও মেলেনি। কিন্তু, উজ়বেকিস্তানের এই গুহায় নিয়ানডারথালদের জীবাশ্ম মিলেছে অতীতে। তাই প্রাথমিক গবেষণায় সম্ভাব্য তিরের ফলাগুলির সঙ্গে নিয়ানডারথাল-যোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। সম্প্রতি ‘প্লস ওয়ান’ জার্নালে সেই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম দিকে এই ভাঙাচোরা পাথরগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, ছুরি বা বর্শা হিসাবে ব্যবহারের জন্য এই ত্রিকোণাকার পাথরগুলি খুবই সরু ছিল। তবে তিরের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। তা ছাড়া পাথরগুলির সূচালো দিক যে ভাবে ক্ষয়ে গিয়েছে, তাতে অনুমান করা হচ্ছে অত্যন্ত বেশি গতিতে আঘাতের ফলেই ওই ক্ষয় হয়েছে। পাথরগুলির এমন গড়ন এবং সূচালো অংশের ক্ষয় দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, এগুলি তিরের ফলা হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।
উজ়বেকিস্তানের গুহায় পাওয়া পাথরের টুকরোর নমুনা। ছবি: সংগৃহীত।
এর পরেই যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হল— সত্যিই যদি এগুলি তিরের ফলা হয়, তবে কারা এগুলি তৈরি করল? যে সময়কালের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে মধ্য এশিয়ায় নিয়ানডারথালদের বাস ছিল। তবে তারা তিরের ফলা ব্যবহার করত বলে কোনও প্রমাণ অতীতে মেলেনি। নিয়ানডারথালদের পরে হোমো সেপিয়েন্স মানবপ্রজাতির মধ্যে তির-ধনুকের ব্যবহার দেখা গিয়েছে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের একাংশের মতে, একেবারে প্রারম্ভিক কালের আধুনিক মানবেরা (হোমো সেপিয়েন্স) এটি তৈরি করে থাকতে পারে। তবে নিয়ানডারথালদের হাতে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কারণ, পৃথিবীতে যখন নিয়ানডারথালেরা ঘুরে বেড়াত, তখন হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির আবির্ভাবও হয়ে গিয়েছিল। এই দুই মানবপ্রজাতির যৌনমিলনের একাধিক প্রমাণ অতীতেও পেয়েছেন বিজ্ঞানী এবং প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। ২০২৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এক শিশুর মাথার খুলি এবং দাঁতের টুকরো খুঁজে পেয়েছিলেন। সেগুলি বিশ্লেষণ করে যেমন নিয়ানডারথাল প্রজাতির চরিত্র পাওয়া গিয়েছিল, তেমনই মিলেছিল হোমো সেপিয়েন্সদের বৈশিষ্টও। গবেষকদের অনুমান, দুই ভিন্ন মানবপ্রজাতির মিলনে তৈরি হওয়া এক সংকর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল ওই শিশুটি। উজ়বেকিস্তানের ওই অঞ্চলটি দুই ভিন্ন মানবপ্রজাতির মধ্যে যোগাযোগের একটি অঞ্চল হয়ে উঠেছিল বলেও মনে করেন গবেষকেরা।
পাশাপাশি ওই ত্রিকোণাকার পাথরের টুকরোগুলি থেকেও বেশ কিছু ইঙ্গিত মিলেছে। পাথরের টুকরোগুলির গড়ন বিশ্লেষণ করে গবেষকদের অনুমান, ভারী কিছুতে আঘাত সহ্যের জন্য এগুলি তৈরি হয়নি। শিকারের শরীরে অস্ত্রকে গেঁথে দেওয়ার জন্যই এটি মূলত তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিও শিকারের সময় এই কৌশল ব্যবহার করত। ফ্রান্সের ম্যানড্রিন গুহায় তার প্রমাণ মিলেছে। প্রায় ৫৪ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সেরা শিকারের জন্য তির-ধনুকের ব্যবহার করত বলে প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকেরা। তবে উজ়বেকিস্তান তথা ইউরেশিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন মানবপ্রজাতি মিলিত হয়েছে। তাই এ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।