Napoleon’s Army

শুধু টাইফাস নয়, নেপোলিয়নের সেই ‘গ্র্যান্ড আর্মি’কে কুপোকাত করেছিল আরও দুই ব্যাধি! দেখাল নতুন গবেষণা

রাশিয়া থেকে ফিরতে ফিরতে নেপোলিয়নের অর্ধেকের বেশি বাহিনী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রবল শীত, ক্ষুধা এবং রোগে মৃত্যু হয়েছিল অনেক সৈন্যের। এত দিন মনে করা হত, অসুস্থতার নেপথ্যে ছিল একটিই রোগ। এ বার নয়া গবেষণায় দেখা গেল, আরও অন্তত এক জোড়া রোগের সংক্রমণ ছড়িয়েছিল বাহিনীতে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৫৩
Share:

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। —ফাইল চিত্র।

১৮১২ সালের কথা। প্রায় পাঁচ-ছয় লক্ষ সৈন্যবাহিনী নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। মস্কোয় পৌঁছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু প্যাঁচে পড়ে পিছু হটতে হয়েছিল। যার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর সৈন্যদের অসুস্থতা। এত দিন পর্যন্ত জানা ছিল, এই অসুস্থতার নেপথ্যে রয়েছে টাইফাস মহামারির সংক্রমণ। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাল, শুধু টাইফাসই নয়, আরও বেশ কিছু রোগ কাবু করেছিল ফরাসি সম্রাটের ‘গ্র্যান্ড আর্মি’কে।

Advertisement

নেপোলিয়ন তাঁর ‘গ্র্যান্ড আর্মি’ নিয়ে ১৮১২ সালের জুন মাসে সোভিয়েত আক্রমণ করেন। তারা তখন সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে পিছু হটতে থাকে। পিছিয়ে যেতে যেতে পথে নিজেদের সব গ্রাম এবং চাষের খেত পুড়িয়ে দিতে দিতে যায় তারা। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই কৌশলী চালে, নেপোলিয়নের বাহিনী যখন মস্কোয় পৌঁছোয়, তখন তাদের কাছে খাবারের অভাব দেখা দেয়। সঙ্গে প্রবল শীতও কাবু করতে থাকে তাদের। এরই মধ্যে রোগের সংক্রমণেও বাহিনী দুর্বল হয়ে যায়। সব মিলিয়ে রুশ অভিযানের সময়ে নেপোলিয়ানের প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য ক্ষুধা, শীত এবং রোগের কারণে মারা যায়।

এত দিন পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত, টাইফাস মহামারির কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নেপোলিয়নের বাহিনী। রাশিয়া অভিযান থেকে পিছু হটার সময়ে ইউরোপের লিথুয়ানিয়ার ভিলনিউসে ‘গ্র্যান্ড আর্মি’র মৃত সৈন্যদের কবর দেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে ওই গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়। তার পরে ২০০৬ সালের এক গবেষণায় ২১৩ বছরের পুরনো ওই টাইফাস-বৃত্তান্ত সম্পর্কে প্রথম জানা যায়। সৈন্যদের কিছু কঙ্কালের দাঁত বিশ্লেষণ করে দেখেন বিজ্ঞানীরা। ওই নমুনাগুলি থেকে জানা যায়, সৈন্যদের ‘রিকেটসিয়া প্রোয়াজেকি’ নামে এক ব্যাকটেরিয়া (যা থেকে টাইফাস রোগ হয়)-র সংক্রমণ হয়েছিল। তবে প্রযুক্তিগত কারণে ওই সময় গবেষণা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, নেপোলিয়নের সৈন্যদের কাবু করেছিল আরও অন্তত দু’টি রোগ।

Advertisement

সম্প্রতি জীববিদ্যা সংক্রান্ত সাময়িকী ‘কারেন্ট বায়োলজি’তে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। ওই একই এলাকার কবর খুঁড়ে পাওয়া আরও কিছু কঙ্কালের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকেরা। এ ক্ষেত্রেও কঙ্কালগুলির দাঁত বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। তাতে আরও দু’টি ব্যাকটেরিয়া— ‘সালমোনেলা এনটেরিকা’ এবং ‘বোরেলিয়া রেকারেনটিস’ নামে আরও দুই ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মেলে। এগুলির ফলে ‘প্যারাটাইফয়েড’ এবং ‘রিল্যাপসিং ফিভার’ (বার বার জ্বর ফিরে আসা) দেখা যায় রোগীর শরীরে। এই দুই ব্যাকটেরিয়ার বিষয়ে ২০০৬ সালের গবেষণায় পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, এখন আর বলা যাবে না শুধুমাত্র টাইফাসের মহামারির জেরেই নেপোলিয়নের সেনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাদের অসুস্থতার নেপথ্যে রয়েছে আরও বেশ কিছু রোগ।

নতুন গবেষণায় পাওয়া এই দুই ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি আরও অন্য জীবাণুর সংক্রমণের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ নতুন গবেষণাটি করা হয়েছে মাত্র ১৩টি কঙ্কালের নমুনা নিয়ে। সে ক্ষেত্রে অন্য কঙ্কালগুলির দাঁতের নমুনা থেকে অন্য কোনও সংক্রমণের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গবেষকেরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এই ১৩টি নমুনার মধ্যে টাইফাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি।

এই গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন এস্টোনিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অফ তারতু’-র গবেষক রেমি বারবেরি। আগে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে ‘পাস্তুর ইনস্টিটিউট’-এর গবেষক ছিলেন। তাঁর কথায়, “এত দিন আমরা ভাবতাম যে নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করেছিল শুধুমাত্র একটিই সংক্রামক রোগ— টাইফাস। তবে নতুন গবেষণায় একেবারে অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়া গিয়েছে। সৈন্যবাহিনী ধ্বংসের নেপথ্যে আরও সংক্রামক রোগের যোগ থাকার সম্ভাবনার দিকে খুলে দিয়েছে এই গবেষণা।”

২০০৬ সালের গবেষণায় প্রযুক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। ফলে ওই সময়ে ‘রিকেটসিয়া প্রোয়াজেকি’ ব্যাকটেরিয়াকে চিহ্নিত করা গেলেও, গবেষণা আর বেশি দূর এগোনো যায়নি। পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার ধরনে বদল আসে। সম্প্রতি গবেষকেরা ‘হাই-থ্রুপুট সিকোয়েন্সিং’ নামে একটি পদ্ধতিতে মৃত সৈন্যদের কঙ্কাল থেকে পাওয়া দাঁতের নমুনা পরীক্ষা করেন। এই পদ্ধতিতে এক সঙ্গে লক্ষাধিক ডিএনএ-র নমুনা বিশ্লেষণ করা যায়। ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো ডিএনএ-র নমুনা বিশ্লেষণ করা যায় এই পদ্ধতিতে। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য তথা ‘পাস্তুর ইনস্টিটিউটের’ মাইক্রোবিয়াল প্যালিওজেনোমিক্স শাখার প্রধান নিকোলাস রাসকোভানের কথায়, “নেপোলিয়ানের সেনায় যে বেশ কয়েকটি সংক্রামক রোগ ছিল, তা আমাদের এই গবেষণা থেকে স্পষ্ট।”

তবে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর উপর এই রোগগুলির প্রভাব কতটা ছিল, তা জানতে গেলে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন রাসকোভান। কারণ, এই গবেষণায় মাত্র ১৩টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। বস্তুত, ‘প্যারাটাইফয়েড’ বা ‘রিল্যাপসিং ফিভার’ বর্তমানে খুব বেশি দেখা যায় না। এগুলি এখন আর ততটা মারাত্মকও নয়। তবে ১৮১২ সালে তাঁর সৈন্যরা অসুস্থ হয়ে পরার জেরে ‘গ্রেট আর্মি’র সিংহভাগই ধ্বংস হয়ে যায়। বাকি সৈন্যবাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়ে। তার কয়েক বছর পরে ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে পতন হয় নেপোলিয়নের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement