লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু প্রতিযোগিতায় নামে— কে আগে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছোবে। এই লড়াইয়ে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রও মানে না শুক্রাণু! গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
একে রূপকথার গল্প বললেও অত্যুক্তি হয় না! ঘোড়া ছুটিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে রাজকুমার যে ভাবে গল্পের শেষে রাজকুমারীর কাছে পৌঁছোন, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মিলন কাহিনিও ঠিক তেমনই। লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু প্রতিযোগিতায় নামে, কে আগে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছোবে। এই লড়াইয়ে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রও মানে না শুক্রাণু!
নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র বলে, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই সূত্র মেনেই জলে সাঁতার কাটতে পারে মাছ। পাখনা দিয়ে জল ঠেলে বলে জলও পাল্টা ঠেলা দেয়। তাতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় মাছ। একই ভাবে সাঁতার কাটে মানুষও। কিন্তু শুক্রাণুর মাছের মতো পাখনা বা মানুষের মতো হাত-পা নেই। তাদের আছে লেজের মতো সরু অংশ, যাকে ‘ফ্ল্যাজেলা’ বলে। আঠালো তরলে (মিউকাস) এই লেজ নাড়িয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যায় শুক্রাণুরা।
কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! হাত-পা, এমনকি পাখনা থাকলেও একটা কথা ছিল। তা দিয়ে থকথকে মিউকাসে যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করা যেত। কিন্তু তা নেই। আর পাতলা সুতোর মতো সরু লেজ দিয়ে যথেষ্ট বল প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এই যুক্তি ধরে এগোলে তো সাঁতার কাটতে পারারই কথা নয় শুক্রাণুদের। তা হলে এই ঘটনা ঘটছে কী ভাবে? এই প্রশ্ন দীর্ঘ দিন ভাবিয়েছে বিজ্ঞানীদের। অবশেষে উত্তর খুঁজে পেলেন কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেন্টা ইশিমোতো এবং তাঁর দল। এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ‘পিআরএক্স লাইফ’ নামক এক জার্নালে।
শুক্রাণুর সাঁতার কাটার ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছেন ইশিমোতোরা। পাশাপাশি, এককোষী প্রাণী সবুজ শৈবালের (অ্যালগি) নড়াচড়াও পরীক্ষা করা হয়েছে। কারণ, শুক্রাণুর মতো অ্যালগিরও ‘ফ্ল্যাজেলা’ রয়েছে। গবেষকেরা দেখেন, শুক্রাণুর দেহে এই পাতলা সরু লেজের মতো দেখতে জিনিসটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একে তাঁরা বললেন অস্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা বা ‘অড ইল্যাস্টিসিটি’।
কোনও বস্তুকে টানলে বা বাঁকালে তার আকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু টান বা চাপ সরিয়ে নিলে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। একে স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা (নর্ম্যাল ইল্যাস্টিসিটি) বলে। কিন্তু অস্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতায় তা ঘটে না। এ ক্ষেত্রে কোনও বস্তু নিজের শক্তি ব্যবহার করেই এক ধরনের অসম ক্রিয়া তৈরি করে। ফ্ল্যাজেলাও তা-ই। সে-ও নিজের রাসায়নিক শক্তি খরচ করে যে ক্রিয়া তৈরি করে, তার পাল্টা সমান এবং বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করতে পারে না আশপাশের থকথকে মিউকাস। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র মানছে না ফ্ল্যাজেলা।
গোটা বিষয়টি একটি গাণিতিক ধারণা দিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকেরা। তার নাম— ‘অড ইল্যাস্টিক মডিউলাস’। কোনও বস্তু কতটা নমনীয় বা কতটা কঠিন, তা পরিমাপ করা হয় ‘মডিউলাস’ দিয়ে। কিন্তু এই নমনীয়তা যদি অসম হয়, তা কখনওই সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে না। সেই কারণেই একে ‘অড’ বা অস্বাভাবিক বলা হচ্ছে। এই ধারণা থেকে গবেষকদের অনুমান, ফ্ল্যাজেলা যখন নড়াচড়া করে, তখন তাতে খুব বেশি শক্তিক্ষয়ও হয় না।
গবেষকদের মত, এই গবেষণা ভবিষ্যতে অনেক নতুন দিক খুলে দেবে। মিউকাসের মধ্যে কোষেদের নড়াচড়ার ব্যাখ্যাও মিলতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী কালে ছোট রোবট তৈরিতেও এই গবেষণা কাজে লাগতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।