Earth's Magnetic Field

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে বদলে দিচ্ছে হাজার হাজার নদীবাঁধ! অশনিসঙ্কেত দেখছেন বিজ্ঞানীরা

পৃথিবীর চৌম্বক মেরুতে মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর হেরফের হওয়া স্বাভাবিক। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর গতিবিধির জন্য অহরহ বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখাও দায়ী।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৮
Share:

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা হ্রাসের এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী বাঁধ নির্মাণ! —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

বিশ্বায়নের যুগে বদলে যাচ্ছে সবই। পরিবেশ, প্রকৃতি, জলবায়ু—মানবসভ্যতার উন্নয়নের কুফল ছাপ রেখেছে সর্বত্র। ভুগতে হচ্ছে জীবজগৎকেও। এ সবের মাঝে এ বার জানা গেল, নদীতে অহরহ বাঁধ দেওয়ার কারণে নাকি বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রও! এমনটাই দাবি করা হয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নতুন গবেষণায়।

Advertisement

পৃথিবীর চৌম্বক মেরুতে মাঝে মাঝে অল্পবিস্তর হেরফের হওয়া স্বাভাবিক। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর গতিবিধির জন্য অহরহ বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখাও দায়ী। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী নাতাশা ভ্যালেন্সিক ও তাঁর সহকর্মীদের দাবি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৭,০০০টি বাঁধের সাহায্যে মোট যে পরিমাণ জল ধরে রাখা হয়েছে, তার বিপুল পরিমাণ ঘনীভূত ভর ভূত্বকের (ক্রাস্ট) ঘূর্ণন অক্ষকে ভূত্বকের নীচের (কোর এবং ম্যান্টল) চৌম্বকক্ষেত্রের তুলনায় প্রায় এক মিটার সরিয়ে দিয়েছে! আর এত জল ধরে রাখার জেরে শুধু যে চৌম্বকক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, বরং বিশ্ব জুড়ে সমুদ্রতল এক ধাক্কায় ২১ মিলিমিটার নেমে গিয়েছে।

পৃথিবীর দুই মেরুর অবস্থান স্থির হলেও চৌম্বক মেরু কিন্তু কোনও স্থির বিন্দু নয়, এটি পরিবর্তনশীল। উত্তর মেরুর কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত উত্তর চৌম্বকীয় মেরু। সেখানে পৃথিবীর ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উল্লম্ব ভাবে অবস্থান করছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা কোরের গতিশীলতার কারণে এই উত্তর চৌম্বকীয় মেরু গত কয়েক শতাব্দী ধরেই ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে চলেছে। আগে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের উত্তর মেরুটি ছিল কানাডার দিকে। কিন্তু পরে তা ক্রমশ স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। এখন এই ঘটনা ঘটছে আরও ঘন ঘন। কেন? ভ্যালেন্সিকের কথায়, ‘‘যখনই আমরা বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখি, তখন এক দিকে যেমন সমুদ্রতল নেমে যায়, সেই সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে ভরের বন্টনও বদলে যায়।’’ এই ভরের পুনর্বণ্টনই পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর অবস্থানের উপর প্রভাব ফেলে বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা।

Advertisement

কী ভাবে ঘটছে সেই ঘটনা? তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ভ্যালেন্সিক। একটি ঘূর্ণায়মান গোলকের সঙ্গে যদি অতিরিক্ত ওজন যুক্ত করা হয়, তা হলে দেখা যাবে, ভারী অংশটি ক্রমশ গোলকের বিষুব অঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে গোলকের ঘূর্ণন অক্ষটিও যায় বদলে। সে রকমই, পৃথিবীপৃষ্ঠে ভরের পুনর্বণ্টন হলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষটিও বদলে যাবে। শুধু বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখাই নয়, হিমবাহের গলন, কিংবা ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার কারণেও এই ঘটনা ঘটতে পারে। এর প্রভাব পড়ে ভূচৌম্বক ক্ষেত্রের উপরেও।

চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয় কোর অঞ্চলে থাকা তরল লোহার কারণে। অথচ, বাঁধ দেওয়ার কারণে কেবল মাত্র পৃথিবীর বাইরের ভূত্বকে ভরের পুনর্বণ্টন হয়, ভিতরের কোরের নয়। এই ভরের পুনর্বণ্টনের জেরে পৃথিবীপৃষ্ঠের একটি ভিন্ন অংশ উত্তর চৌম্বকীয় মেরুর উপর সরে আসে। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে উত্তর চৌম্বকীয় মেরু নিজে স্থান পরিবর্তন না করলেও তার উপরের পৃথিবীপৃষ্ঠটি সরে যাওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, চৌম্বক মেরুর অবস্থান বদলে গিয়েছে। এই ঘটনাকে বলা হয় ‘প্রকৃত মেরু বিচরণ’ (ট্রু পোলার ওয়ান্ডার)।

ভ্যালেন্সিক এবং তাঁর দল দেখিয়েছেন, চৌম্বকীয় উত্তর মেরু দু’টি পর্যায়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। ১৮৩৫ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় পর্যাপ্ত বাঁধ তৈরির ফলে এটি পূর্বে রাশিয়ার দিকে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) সরে গিয়েছে। ১৯৫৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এশিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকাতেও প্রচুর পরিমাণে বাঁধ তৈরি হয়েছে। তখন এটি ফের ৫৭ সেন্টিমিটার সরে গিয়েছে পশ্চিমে উত্তর আমেরিকার দিকে।

বাঁধ নির্মাণের জন্য এক দিকে যেমন সমুদ্রতল নীচে নামছে, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বছর বছর বেড়েই চলেছে। গবেষকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, এই শতাব্দীতে অসংখ্য বাঁধ তৈরি হওয়ায় সমুদ্রতলের বার্ষিক উচ্চতাবৃদ্ধি এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ প্রায় ১.২ মিলিমিটার আটকানো সম্ভব হয়েছে। এক দিক থেকে ভাবলে এর ভাল দিকও রয়েছে! মানব-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে যে ভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, এত বাঁধ তৈরির ফলে তাতে সামান্য হলেও ভারসাম্য এসেছে। গবেষকরা বলেছেন, ভবিষ্যতে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির হিসাব কষা হবে, তখন যেন বাঁধের জন্য সমুদ্রতল নেমে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়।

যদি পৃথিবীর উত্তর চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ঘন ঘন বদলাতে থাকে, তা হলে কী হবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটা হওয়ার কারণে চৌম্বকক্ষেত্রেরও স্থান পরিবর্তন হবে। ফলে গভীর সমুদ্রে কিংবা মহাসাগরে দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়বে জাহাজ। আকাশে বিমানচালকদের দিশা দেখাতেও (নেভিগেশন) বড়সড় ভুল হয়ে যাবে। স্মার্টফোনে দেখানো গুগলের ম্যাপেও ভুলভ্রান্তি ধরা পড়বে। বায়ুমণ্ডলীয় স্তরের সঙ্কোচন, সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ— প্রভাব পড়বে এ সবেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement