আঁধার কণাদের ধরতে চালু মডেল ছেড়ে বেরোতে চান পদার্থবিদরা

ডার্ক ম্যাটার মেলেনি এখনও। ব্রহ্মাণ্ডের বিপুল পরিমাণ কণা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছে। তাই ‘ঘর-বাড়ি’ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে সার্ন।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ১৪:৪৩
Share:

ডার্ক ম্যাটার মেলেনি এখনও। ব্রহ্মাণ্ডের বিপুল পরিমাণ কণা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছে। তাই ‘ঘর-বাড়ি’ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে সার্ন।

Advertisement

সার্নের আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়ে জেনিভা থেকেই ‘বোমা’ ফাটালেন কলকাতার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।

বললেন, ‘‘ব্রহ্মাণ্ডে খুব সামান্য কণারই সন্ধান পেয়েছে সার্ন। সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। এখনও বিপুল পরিমাণ কণা সার্নের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছে। তাই জোয়ান ছেলেটার মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠে এখন যে ভাবেই হোক ঘর-বাড়ি ছাড়তে চাইছে সার্ন। কিন্তু পারছে না।’’

Advertisement

অথচ ‘বাড়ি’ ছেড়ে বেরিয়ে পড়াটা খুব দরকার সার্নের। তা না হলে কিছুতেই হিসেব মেলানো যাচ্ছে না।

হিসেবের গরমিলটা হচ্ছে কোথায়? কেন হচ্ছে?

কলকাতার ‘ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারে’র অধিকর্তা, ‘পদ্মভূষণ’ বিজ্ঞানী বিকাশবাবু তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ই মেলে, ‘‘কণা পদার্থবিদ্যার অভিভাবক স্ট্যান্ডার্ড মডেলই সার্নের ঘর-বাড়ি। ওই মডেল ব্রহ্মাণ্ডে যে যে কণা বা কণিকার অস্তিত্বের পূর্বাভাস দিয়েছিল, তাদের মোট ভর যোগ করলে যা হয়, তা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের ধারে-কাছেও আসে না। এর মানে, ব্রহ্মাণ্ডের বিপুল পরিমাণ কণা ও কণিকা এখনও আমাদের অজানা, অচেনা। অধরা। যাদের কথা স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বলা নেই। যে সব কণা গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, মহাজাগতিক গ্যাস বা ধুলোয় পাওয়া যায় না। এদের নাম- ডার্ক ম্যাটার। সঙ্গে রয়েছে বিপুল পরিমাণে অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। এই ব্রহ্মাণ্ডের ৯৭/৯৮ শতাংশই হল ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। যাদের সম্পর্কে সার্ন এখনও কিছুই জানতে পারেনি। এখনও পর্যন্ত যে সব কণার হদিশ মিলেছে গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, মহাজাগতিক গ্যাস বা ধুলোয়। তা ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের সাকুল্যে দুই শতাংশ। তাই বিদ্রোহী জোয়ান ছেলেটার মতোই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে সার্ন। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। তাই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্যের জটও খোলা সম্ভব হচ্ছে না।’’

‘বাড়ি’ ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়ার আরও কিছু তাগিদ রয়েছে সার্নের।

কী সেই বাড়তি তাগিদ?

এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট চার ধরনের বলের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে। তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, দুর্বল বল (পরমাণুর কক্ষপথে ইলেকট্রনের ওপর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াসের টান), শক্তিশালী বল (নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে যে বল বেঁধে রাখে) ও অভিকর্ষ বল।

বিকাশবাবু বলছেন, ‘‘ওই চারটি বলের মধ্যে অভিকর্ষ বল কেন সবচেয়ে দুর্বল, স্ট্যান্ডার্ড মডেল তা ব্যাখ্যা করতে পারেনি। পরবর্তী কালে কোনও কোনও তত্ত্বে বলা হয়েছে, ব্রহ্মাণ্ডের আরও অনেক তল বা ‘ডাইমেনশন’ রয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড ‘মাল্টি-ডাইমেনশনাল’। অভিকর্ষ বল ছড়িয়ে রয়েছে সবকটি তলেই। তাই যে তলটিকে আমরা দেখতে পারছি, সেই তলে তা অন্য বলগুলির মধ্যে দুর্বলতম। তবে ব্রহ্মাণ্ডের ওই বহু তলের অস্তিত্ত্বের প্রমাণ এখনও পায়নি সার্ন। কোনও কোনও তত্ত্ব বলছে, ব্রহ্মাণ্ডের সেই তলগুলি লুকিয়ে রয়েছে। একটা খবরের কাগজকে পাকিয়ে চোঙা বানিয়ে ফেললে যেমন তার একটি তল হারিয়ে যায়, ঠিক তেমনই। সম্ভবত সেই সব তলেই লুকিয়ে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কণা। অজানা। অচেনা। অধরা। যাদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি এখনও। কিন্তু তারা রয়েছেই। এরাই ডার্ক ম্যাটার। এরা না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডের ভর অত বেশি হত না। তাই সার্ন এখন ‘বিয়ন্ড স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ কণার (বিএসএম) খোঁজ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’’

কোন ধরনের ডার্ক ম্যাটারের হদিশ মেলার সম্ভাবনা বেশি?

ডাবনায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাঠানো তাঁর ‘Cold Dark Matter and the Cosmic Phase Transition’ প্রবন্ধে বিকাশবাবুর দাবি, ‘‘গোত্রে সেগুলি হবে কোল্ড ডার্ক ম্যাটার। ‘বিগ ব্যাং’য়ের পরের এক সেকেন্ডের লক্ষ-কোটি ভাগ সময়ের মধ্যে যখন অসম্ভব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মাণ্ড আর তা বেলুনের মতো খুব দ্রুত ফুলে-ফেঁপে উঠছিল (‘ইনফ্লেসান’), তখন কোয়ার্ক কণিকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জন্ম হচ্ছিল ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো ‘হ্যাড্রন’ কণাদের। সেই সৃষ্টির সময়েই গড়ে উঠেছিল কোয়ার্ক কণিকাদের ধ্বংসাবশেষ। পিণ্ডের মতো দলা পাকানো সেই ধ্বংসাবশেষ আদতে ‘স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক ম্যাটার (এসকিউএম) নাগিটস্’। যেগুলি থেকে ইলেকট্রন, প্রোটন জন্মায়নি। এরাই ‘কোল্ড ডার্ক ম্যাটার’। সার্ন এখনও এদের হদিশ পায়নি। হদিশ মেলেনি অভিকর্ষ বলের ‘বাহক’ আরও এক ডার্ক ম্যাটার কণা ‘গ্র্যাভিটন’-এরও।’’

সিন্ধুতে বিন্দু নিয়ে তাই আর সন্তুষ্ট নয় সার্ন! বেরিয়ে পড়তেই হবে তাকে ‘ঘর-বাড়ি’ ছেড়েছুড়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন