দুই নিউট্রন তারার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি। শিল্পীর কল্পনায়।
‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ হত ভারতীয় বিজ্ঞানীরা না থাকলে! চোখে দেখেন না যিনি, হাতির শুঁড় ছুঁয়ে় তিনি মনে করেন, ওটাই বুঝি হাতি! বা হাতি বলতে বোঝায় তার লেজটাই!
ভারতীয় বিজ্ঞানীরাই পথটা দেখিয়েছিলেন, হাজারো গোলমাল (নয়েজ), রকমারি সঙ্কেত, শব্দের মধ্যে থেকে কী ভাবে আলাদা ভাবে চিনে নেওয়া যেতে পারে সেই বহুকাঙ্খিত অচেনা সুর। কয়েকশো কোটি বছর আগে যে সুর বা সুরগুলি দিয়ে কেউ গান বেঁধেছিল আর তা গেয়েছিল।
ভারতীয় বিজ্ঞানীরাই প্রথম দেখাতে পেরেছিলেন, কয়েকশো কোটি বছর ধরে ব্রহ্মাণ্ডে ছড়াতে ছড়াতে সেই সুর শেষমেশ পৃথিবীতে এসে পৌঁছলেও তা হারিয়ে যেতে পারে হাজারো গোলমালের ভিড়ে। ফলে, হরেক গোলমালের মধ্যেও তাকে আলাদা করে চিনতে পারার দরকারটা সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন- যুগান্তকারী আবিষ্কার, নিউট্রন তারার ধাক্কার ঢেউ দেখা গেল প্রথম
আরও পড়ুন- আইনস্টাইনকে পাশ করিয়ে নোবেল পেলেন তিন পদার্থবিজ্ঞানী
হারিয়ে যেও না গোলমালে...
দুই ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানী সঞ্জীব ধুরন্ধর আর বি এস সত্যপ্রকাশের দেখানো সেই পথে (’৯১ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে) না হাঁটলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম হদিশ পাওয়ার জন্য হাঁ করে বসে থাকা বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীদের অবস্থাটা হত ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’-এর মতো। ২০১৫-র ১৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনে বসানো লেসার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি’র (লাইগো) দু’টি ‘চোখ’ বা ডিটেক্টরে প্রথম ধরা পড়া ‘ছলাৎ’ শব্দটা যে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে জন্মানো একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরই, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হত না বিজ্ঞানীদের। মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের মতো ব্রহ্মাণ্ডের হাজারো গোলমালের শব্দের ভিড়ে সেই সঙ্কেত বা সিগন্যাল হারিয়ে যেত।
আরও চোখ, আরও আরও চোখ...
মাথার দু’পাশে দু’টি চোখ একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে বলেই যেমন আমরা কোনও কিছুকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাই, তিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সঞ্জীব ধুরন্ধর, সুকান্ত বসু ও অর্চনা পাই-ই প্রথম যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক সেই ভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে দেখার চেষ্টা করা হলে, তা আদতে কোথা থেকে আসছে, কত দূর থেকে আসছে, যেখান থেকে আসছে বলে ভাবা হচ্ছে, সেখান থেকেই আসছে কি না, সে ব্যাপারে নির্ভুল তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক জোরালো হবে। তার মানে, একই জায়গায় বা কাছাকাছি দূরত্বে দু’টি ডিটেক্টর বা ‘চোখ’ থাকলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎসকে সঠিক ভাবে বোঝা যাবে না। সেটা তখনই সম্ভব হতে পারে যদি একাধিক ‘চোখ’ বা ডিটেক্টর দিয়ে তাকে দেখা হয় আর সেই ‘চোখ’গুলি যদি থাকে একে অন্যের থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে বা একেবারে ঠিক উল্টো প্রান্তে।
সেই কথাটাই সত্যি হল, গত ১৪ অগস্ট আমেরিকার হ্যানফোর্ড ও লিভিংস্টোনের দু’টি লাইগো ডিটেক্টরের সঙ্গে যখন হাত মিলিয়ে ইতালির পিসার কাছে বসানো ‘ভার্গো’ ডিটেক্টরও এমন একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পেল যেটির জন্ম হয়েছিল ১৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে। মানে, আলোর গতিতে ছুটলে যে জায়গাটায় পৌঁছতে সময় লাগবে ১৮০ কোটি বছর।
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে...
পুরাতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিকরা যেমন মাটি খুঁড়ে কোটি কোটি বছর আগেকার প্রাণীর জীবাশ্ম উদ্ধার করে সেই সময়ের ইতিহাস জানতে-বুঝতে পারেন, তেমনই আলোর হাত ধরেই কোটি কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কী ঘটনা ঘটেছিল, কাদের কাদের জন্ম বা ধ্বংস কী ভাবে হয়েছিল, তার পর কী হয়েছিল, সেই সব অজানা, অচেনা ঘটনা জানতে পারি। ব্রহ্মাণ্ডের অতীত ঘটনার চিঠি, বার্তা বা খবরাখবর কোটি কোটি বছর ধরে দৌড়নোর পর ‘রানার’-এর মতো এত দিন আমাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে আলোর কণা ফোটন। আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে এসেছে এত দিন শুধুই আলো।
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে...
সেই সব ধাক্কাধাক্কি মহাকাশে: দেখুন ভিডিও
এসে গেল আরেক রানার: ঢেউ
১০০ বছর আগে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইনই প্রথম বলেছিলেন, আলো ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডের অতীতের ঘটনাবলীর খবরাখবর আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে একটা ঢেউ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। যা আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ না হলেও ছোটে প্রায় আলোর গতিতেই। কারণ, মহাজাগতিক বস্তুগুলি নড়াচড়া করলে, ছুটলে, একে অন্যের গায়ে ধাক্কা মারলে, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হলে বা সেই ধ্বংসের থেকে নতুন কিছুর জন্ম হলে ব্রহ্মাণ্ডের স্থান-কাল (স্পেস টাইম) বেঁকেচুরে (কার্ভেচার) যায়। চাদরটা টানটান করে পাতা বিছানার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব ভারী একটা ধাতব বলকে গড়িয়ে দিলে যেমন কিছুটা বেঁকেচুরে যায় চাদরটা, ঠিক তেমনটাই। আমরা যে এ পাশ থেকে ও পাশে সরছি, হাত নাড়াচ্ছি, পা ছড়াচ্ছি, তাতেও সেই তরঙ্গটা হচ্ছে। খুব খুব দুর্বল বলে তা মালুম হচ্ছে না। কিন্তু দু’টি ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন তারা একে অন্যকে ধাক্কা মারলে সেই তরঙ্গটা অনেক জোরালো হয়। পুকুরে বড় ঢিল ফেললে যেমন ঢেউয়ের জন্ম হয় আর তা ধীরে ধীরে ছড়াতে ছড়াতে ঘাটে এসে ভেড়ে, তেমনই কয়েকশো কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম প্রান্তে দু’টি ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন তারার মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটলেও সেই ঢেউ তৈরি হয় আর ছড়াতে ছড়াতে তারও পৃথিবীর ‘ঘাট’-এ ভেড়ার সম্ভাবনা থাকে। আর তখনই তা ‘রানার’ হয়ে ওঠে। কারণ, সেই ঢেউই জানিয়ে দেয়, কয়েকশো কোটি বছর আগে এমন একটা ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছিল।
আকাশকে বেশি করে দেখ, বেশি জানা যাবে ‘তাহাদের কথা’
তবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অত্যন্ত ক্ষীণ বলে আর জন্মানোর পর তা বহু বহু কোটি বছর ধরে ব্রহ্মাণ্ডে ছড়াচ্ছে বলে পৃথিবীতে বসে তার ধাক্কাটা কতটা বোঝা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয় ছিল খোদ আইনস্টাইনেরই। কিন্তু গত শতাব্দীর সাত আর আটের দশকে সেই তরঙ্গকে অনুভব করার উপায় প্রথম বাতলেছিলেন যাঁরা, সেই রাইনার ওয়েস, ব্যারি সি ব্যারিশ এবং কিপ এস থর্নকে এ বছর নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। তাঁদের দেখানো পথেই লাইগোর দু’টি ডিটেক্টর বসেছে আমেরিকায়, বসেছে ইতালিতে। ভারতেও বসবে আর ক’বছরের মধ্যেই। সেটাই লাইগো ইন্ডিয়া প্রকল্প। যাতে আরও এক বার প্রমাণিত হবে প্রায় ১৬ বছর আগে (২০০১ সাল) ঠিক কথাটাই বলেছিলেন তিন ভারতীয় বিজ্ঞানী সঞ্জীব ধুরন্ধর, সুকান্ত বসু ও অর্চনা পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যত বেশি ‘চোখ’-এ একই সঙ্গে একই সময়ে আকাশকে যত বেশি করে দেখা সম্ভব হবে, কয়েকশো কোটি বছর আগেকার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আর তার উৎস সম্পর্কে তত বেশি তথ্য পাওয়া যাবে আর সেই সব তথ্য আরও বেশি নির্ভুল হবে।
২০১৫-র সেপ্টেম্বরের পর ওই বছরেরই ডিসেম্বরে আরও এক বার সেই তরঙ্গ ধরা দিয়েছিল লাইগো ডিটেক্টরে। যে আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল অধ্যাপক তরুণ সৌরদীপ, সঞ্জিত মিত্র, সুকান্ত বসু ও আনন্দ সেনগুপ্তের মতো ৩৭ জন ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানীর। গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন (আইসার)-এর অধ্যাপক রাজেশ নায়েক ও তাঁর ছাত্রী অনুরাধা সমাজদারেরও।
সেই আবিষ্কারের তাৎপর্যটা ছিল কোথায়?
পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধ্যাপক লাইগো ইন্ডিয়ার প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর তরুণ সৌরদীপ বলছেন, ‘‘আলোর মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গও ব্রহ্মাণ্ডের অতীতের ঘটনাবলীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, আরও একটি ‘হাতিয়ার’ হয়ে উঠতে পারে।’’
তৃতীয় বার সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। লাইগো ডিটেক্টরেই। আর চতুর্থ বার একই সঙ্গে আমেরিকার লাইগো ও ইতালির ভার্গো ডিটেক্টরে। গত ১৪ অগস্ট। সেই ৪ বারই যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছিল তার জন্ম হয়েছিল ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে। আর গত ১৭ অগস্ট যে তরঙ্গ ধরা পড়েছিল তার জন্ম হয়েছিল দু’টি নিউট্রন তারার মধ্যে সংঘর্ষের ফলে। যে দু’টি নক্ষত্র ভরের নিরিখে আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি।
কখনও ব্ল্যাক হোল, কখনও বা নিউট্রন নক্ষত্র
কোনও তারার মৃত্যু হয় সাধারণত দু’ভাবে। সূর্যের ভরের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি ভারী হলে মরা তারাগুলি থেকে হয় জন্ম হয় ব্ল্যাক হোলের। না হলে তৈরি হয় নিউট্রন তারা। ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষ বল এতটাই জোরালো যে তা আলোকেও বেরিয়ে আসতে দেয় না। ফলে, সেই দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে কয়েকশো কোটি বছর আগে ধাক্কাধাক্কির সময় ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল, আলো সে খবর আমাদের জানাতে পারে না বলে সেই ধাক্কাধাক্কির ফলে জন্মানো তরঙ্গটা কখন পৃথিবীতে পৌঁছবে আর তা আমাদের নজরে পড়বে কি না, তার ওপরেই আমাদের নির্ভর করতে হয়। সেখানে তরঙ্গের ধাক্কা আর তার ‘ছলাৎ’ শব্দটাই যেটুকু তথ্য দেওয়ার, আমাদের দেয়।
কেন শুধু ঢেউ নয়, আলোও দেয় নিউট্রন তারা?
জীবদ্দশায় কোনও তারা নিউট্রন নক্ষত্র হয়ে গেলে তার মধ্যে পদার্থ থাকে অসম্ভব বেশি ঘনত্বে। আমাদের সূর্যের সমান ভরের একটা বস্তুকে যদি শুধু এসপ্ল্যানেডের চত্বরের মধ্যে ধরে রাখা হয়, তা হলে তার যে প্রচণ্ড ঘনত্ব হবে, নিউট্রন তারাদের দশাটাও হয় ঠিক তেমনই। সেই দু’টি নিউট্রন তারার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলে, যেহেতু তাদের অভিকর্য বল ব্ল্যাক হোলের মতো জোরালো নয়, তাই সেই সংঘর্য শুধুই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম দিয়েই থেমে যায় না। তাদের শরীরে থাকা বিভিন্ন পদার্থের অণু, পরমাণু, প্রোটন, নিউট্রনগুলি ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। যা গামা রশ্মির স্রোত হয়ে বেরিয়ে আসে। খুব সামান্য সময়ের জন্য। খুব সরু হয়ে কিন্তু অসম্ভব জোরালো ভাবে। সারা জীবনে সূর্যের মতো কোনও তারা যতটা শক্তির বিকিরণ ঘটাতে পারে, তা দু’সেকেন্ডেই উগড়ে দিতে পারে সেই অসম্ভব শক্তিশালী গামা রশ্মির স্রোত।
সোমবার যে যুগান্তকারী মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের ঘোষণা করা হয়েছে, তার জন্ম হয়েছিল ১৩ কোটি বছর আগে গ্যালাক্সি ‘এনজিসি-৪৯৯৩’-তে। দু’টি নিউট্রন তারা়র মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে। এর অভিনবত্ব এখানেই যে, সেই তরঙ্গের সঙ্গে গামা রশ্মির স্রোতও বেরিয়েছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। তার ফলে আলোর কণাও ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল ব্রহ্মাণ্ডে। গত ১৭ অগস্ট সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সঙ্গে আলোকতরঙ্গও এসে ভিড়েছিল পৃথিবীর ‘ঘাট’-এ। ১.৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে।
ফলে, এ বার তরঙ্গের ধাক্কা বা কম্পনও এল, এল তার ‘ছলাৎ’ শব্দ। আবার আলোও বেরিয়ে এল সেই ঘটনা থেকে।
কনসার্ট হলের ‘শিল্পী’দের দেখা গেল
পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধ্যাপক সুকান্ত বসু বলছেন, ‘‘কনসার্ট হলে বসে এত দিন চোখ বুঁজে গান শুনতে পারছিলেন বিজ্ঞানীরা। একটুও আলো নেই বলে মঞ্চে কারা রয়েছেন, তাঁরা কোন কোন যন্ত্র বাজাচ্ছেন, বিজ্ঞানীদের পক্ষে তা দেখা সম্ভব হয়নি এত দিন। মহাকাশের কনসার্ট হলের সেই ‘শিল্পী’ আর তাঁদের ‘বাদ্যযন্ত্র’গুলিকেও এ বার দেখতে পেলেন বিজ্ঞানীরা! এই প্রথম।’’
সুর যখন পঞ্চমে!
পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধ্যাপক সঞ্জিত মিত্রের কথায়, ‘‘২০১৫-র সেপ্টেম্বরে প্রথম যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছিল দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে সেই ঘটনাটা ঘটেছিল ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। ওই বছর ডিসেম্বরে ধরা পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গটির উৎসস্থল ছিল ২৯০ কোটি আলোকবর্ষ। ২০১৭-র জানুয়ারিতে হদিশ মেলা তরঙ্গটির জন্ম হয়েছিল ১৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে। গত ১৪ অগস্ট যে তরঙ্গটির হদিশ মিলেছিল, সেটির উৎসস্থল ছিল ১৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব। আর নিউট্রন তারাদের ধাক্কাধাক্কির ফলে যে তরঙ্গ আর আলোর দেখা মিলেছিল গত ১৭ অগস্টে, তার জন্ম হয়েছিল ১৩ কোটি বছর আগে।’’
‘পঞ্চম’ সুরেই সে ধরা দিল ঢেউয়ের ‘ছলাৎ’ শব্দ আর আলোর ‘অগ্নিশিখা’ জ্বালিয়ে। ‘পঞ্চমে’ই তার ‘পায়ের ছাপ’ মিলল প্রথম!
কে বলতে পারে এর পরেও এক দিন পা হড়কাতে পারে আইনস্টাইনের!
এখনও পর্যন্ত পা হড়কাননি তিনি। ১০০ বছর আগে যা বলেছিলেন, তা-ই মিলেছে। যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ এখনও পর্যন্ত মিলেছে, তার চরিত্র, আচার, আচরণ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে মেনে চলে। শুধু তাই নয়, সেই তরঙ্গ যে আলোর গতিবেগেই ছোটে, সেই প্রমাণও মিলল এ বার। কারণ, ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে সেই মহাকর্যীয় তরঙ্গ আর আলোর ‘দীপশিখা’ গত ১৭ অগস্ট পৃথিবীতে পৌঁছেছিল মোটামুটি একই সময়ে। মাত্র ১.৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে।
কিন্তু হতেই পারে, ব্ল্যাক হোলের একেবারে কাছে, যেখানে অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষ বলে স্থান-কাল সব বেঁকেচুরে কিম্ভূত-কিমাকার হয়ে যায়, সেখানেও আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের নিয়ম মেনে চলবে কি না, নাকি দেখা যাবে কোনও ‘ডিভিয়েশন’, তারই সন্ধানে রয়েছেন কলকাতার ‘আইসার’-এর মহাকাশবিজ্ঞানী রাজেশ নায়েক ও তাঁর ছাত্রী অনুরাধা সমাজদার।
রাজেশের কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত ভুল হয়নি আইনস্টাইনের। ১.৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে তরঙ্গ আর আলো এসে পৌঁছলেও তা এসেছে ১৩ কোটি বছর আগে ঘটা একটি ঘটনা থেকে। তাই এটাকে সময়ের কোনও ব্যবধান বলা যায় না। তা ছাড়াও ধাক্কাধাক্কির পর আগে তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল। তার পর বেরিয়ে এসেছিল গামা রশ্মির স্রোত। আলো। ফলে ওই ঘটনা থেকে পৃথিবীতে আলোর একটু দেরিতে পৌঁছনোর কারণ তো রয়েছেই।’’
রাজেশরা অপেক্ষা করছেন সেই দিনটার জন্য যে দিন এমন কোনও মহাজাগতিক ঘটনার হদিশ পাওয়া যাবে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হাত ধরে, যে দিন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কিছুটা পরিমার্জনের প্রয়োজন হবে।
অচেনার আনন্দই যে সবচেয়ে বেশি...
কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (আইএসিএস)-এর অ্যাকাডেমিক ডিন সৌমিত্র সেনগুপ্ত যেমন দৃঢ় বিশ্বাসে বলছেন, ‘‘আমরা এগিয়ে চলেছি বিয়ন্ড আইনস্টাইনের দিকে। তা আজ অথবা কাল হতে পারে। কিন্তু অনিবার্যই। মহাকর্ষীয় তরঙ্গই সেই জানলাটা আমাদের সামনে খুলে দেবে।’’
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ইন স্পেস সায়েন্সেস ইন্ডিয়া, আইসার, কলকাতা, আয়ুকা, পুণে ও নাসা