প্রতীকী ছবি।
খেয়াল করে দেখেছেন, এই অতিমারির সময় ঘরবন্দি আর সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে আপনি একটু বেশিই পেটুক হয়ে পড়েছেন? সামনে যা দেখছেন তা-ই খেতে ইচ্ছে করছে। শুধু ছবি দেখেই সেটা হচ্ছে। যা খেতে এত দিন ভাল লাগত না, তাতেও জিভ ঠেকাতে ইচ্ছে করছে। সব সময় ‘খাই খাই’ করছে মন!
এটা দেখেছেন, বাড়িতে যাঁর আনাগোনায় এক সময় আপনি বিরক্ত বোধ করতেন এখন হাতের কাছে তাঁর ছবি থাকলে সেটাই বার বার নাড়াচাড়া করছেন? সেই ছবি অনেক ক্ষণ ধরে দেখেও চলেছেন!
হয়তো উপলব্ধি করেননি। তাই নিজেকে প্রশ্ন করেননি। আমরাও খেয়াল করিনি। তাই নিজেদের প্রশ্ন করিনি আমরাও। এটা কেন হচ্ছে?
এ বার সেই প্রশ্নেরই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল একটি গবেষণা। সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার নিউরোসায়েন্স’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। ২৩ নভেম্বর। গবেষণাটি করেছে ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-র স্নায়ুবিজ্ঞানীদের একটি দল।
মস্তিষ্কই চালায় আমাদের। আমাদের যাবতীয় অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। ‘সে’ যেমন ভাবে চালায়, যেমন ভাবে আমাদের চলতে বলে, চলার সঙ্কেত পাঠায় স্নায়ুদের মাধ্যমে আমরা সেই ভাবেই চলি।
একাকিত্ব। -ফাইল ছবি।
গবেষণা দেখিয়েছে, এই অতিমারির পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময় বা তার পরেও আমরা যখন তুলনামূলক ভাবে অনেক অনেক বেশি একাকী, ঘরবন্দি হয়ে পড়েছি, কার্যত সমাজ-বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছি, সেই সময় মস্তিষ্কই আমাদের খাই খাই স্বভাবটাকে জাগিয়ে তুলেছে। যা দেখছি, তা-ই জিভে ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছে। এটা খাব না, ওটা খাব, এমন বাছবিচারটাও আমাদের মধ্যে থেকে যেন উবেই গিয়েছে এই কঠিন সময়ে।
আরও পড়ুন- হকিং, পেনরোজ কি উদ্ভাসিত অমল আলোয়? কী বলছে ইতিহাস
আরও পড়ুন- এ বারের নোবেলজয়ী গবেষণার অন্তরালে এই বাঙালিও
গবেষণা এও দেখিয়েছে, এই দীর্ঘ একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রায় ‘একঘরে’ হয়ে থাকার মানসিক যন্ত্রণা আমাদের চার পাশের বহু অবাঞ্ছিত মানুষের ছবিও দেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। এত দিন বাড়িতে যাঁদের আসা-যাওয়াটা আমরা তেমন পছন্দ করতাম না, পথেঘাটে, ক্লাবে-রেস্তরাঁয় দেখা হলে যাঁদের আমরা একটু এড়িয়ে চলতাম এত দিন, তাঁরা এ-দিক দিয়ে এলে আমরা অন্য পথ ধরতাম, এখন এই কঠিন সময়ে আমাদের বাধ্যতামূলক একাকিত্ব তাঁদের ছবি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময়েও বিরক্তি উৎপাদন করছে না। যে সব মানুষকে রোজ দেখেছি এত দিন তাঁদের ছবিও অনেক ক্ষণ ধরে দেখতে ইচ্ছে করছে এখন।
গবেষকরা দেখেছেন, এটা হচ্ছে সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই। আর এ ক্ষেত্রে কোনও লিঙ্গভেদ নেই। পুরুষ, মহিলা বাছবিচার নেই।
কোনও খাবার দেখলে যে আমাদের খিদে পায়, তা খাওয়ার ইচ্ছা জাগে তার জন্য দায়ী আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যভাগের একটি বিশেষ অংশের কয়েকটি স্নায়ুকোষ বা ‘নিউরোন’। অতিমারির সময়ে, লকডাউনের সময় গবেষকরা এই নিউরোনগুলিকে অতি সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখেছেন গবেষকরা।
মূল গবেষক লিভিয়া টোমোভা জানিয়েছেন, তাঁরা ৪০ জনকে টানা ১০ ঘণ্টা কিছু না খাইয়ে রেখেছিলেন। তার পর তাঁদের দামী পিৎজা আর চকোলেট কেকের ছবি দেখানো হয়। সেগুলি দেখেই খাওয়ার জন্য তাঁরা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন।
এটা কেন হচ্ছে? লিভিয়ার কথায়, ‘‘আমরা দেখেছি মস্তিষ্কের মধ্য ভাগের একটি বিশেষ অংশে থাকা যে নিউরোনগুলি কোনও কিছু খাওয়ার ইচ্ছা জাগায়, টানা ১০ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর পিৎজা, কেকের ছবি দেখানো হলেই সেই নিউরনগুলি অতি সক্রিয় হয়ে উঠছে। ভাবুন, খাবার নয়, খিদে জাগছে ছবি দেখলেই!’’
গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই নিউরোনগুলি রয়েছে মস্তিষ্কের দু’টি অংশে। একটি ‘সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা পার্স কমপ্যাক্টা’। অন্য অংশের নাম ‘ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া’। পিৎজা আর কেকের ছবি দেখানো হলে ওই নিউরনগুলি ডোপামাইন ক্ষরণ করছে। সেটাই ওই খাবারগুলির প্রতি আগ্রহী করে তোলে আমাদের।
পরে আর এক দিন ওই ৪০ জনকেই টানা ১০ ঘণ্টা সব কিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন গবেষকরা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন তো নয়ই, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামেও তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এর পর গবেষকরা দেখেছেন, এক সময় বিরক্তিকর লাগত এমন মানুষজনের ছবি দেখানো হলেও ওই ৪০ জন তা সরিয়ে দেননি বা মুখ ঘুরিয়ে নেননি। বরং সেই ছবি বার বার দেখেছেন। দেখতে চেয়েছেন। অনেক ক্ষণ ধরে দেখেছেন।