সৌরজগতের শেষ প্রান্তে নতুন ধরনের এক কক্ষপথের হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
সৌরজগতের শেষ কোথায়? হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের সেই শেষ প্রান্ত দেখতে কেমন? প্রতি মুহূর্তে কী ঘটে চলেছে সেখানে? এ সব নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই। অজানা সেই রহস্যপথে ঢুঁ মারতে নানা ভাবে নানা দিকে ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছেন তাঁরা। তেমনই এক ক্যামেরায় সম্প্রতি ধরা পড়ল এক অত্যাশ্চর্য উপস্থিতি! সৌরজগতের মধ্যেই নতুন এক মহাজাগতিক বস্তু খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা, যার ঠিকানা একেবারে শেষ প্রান্তে। সূর্যের শেষ গ্রহ নেপচুনেরও ও পারে!
সূর্যের মোট আটটি গ্রহের কথা স্বীকার করেন বিজ্ঞানীরা। আগে প্লুটোকেও গ্রহের তালিকায় রাখা হত। কিন্তু প্লুটো পূর্ণাঙ্গ গ্রহ নয়। ২০০৬ সালে প্লুটোকে বামন গ্রহ হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকে সূর্যের নবম গ্রহের আসনটি খালি হয়ে গিয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের একাংশের অনুমান, নেপচুনের পরেও একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রহ রয়েছে সৌরজগতে। এখনও পৃথিবী থেকে তার অস্তিত্বের হদিস পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ দিন ধরেই সৌরজগতের শেষ প্রান্তের সেই অজানা সম্ভাবনাময় গ্রহের খোঁজে তল্লাশি চলছিল। সেই সংক্রান্ত গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক আবিষ্কার।
নেপচুনের কক্ষপথ পেরিয়ে যে বস্তুটির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, তার নাম ২০২৩কেকিউ১৪ বা অ্যামোনাইট। সৌরজগতের শেষ গ্রহ বরফাবৃত নেপচুন। তার পরে যত মহাজাগতিক বস্তু সৌরজগতের সীমানার মধ্যে রয়েছে, তাদের সেডনয়েড বলা হয়। অ্যামোনাইট তেমনই একটি সেডনয়েড। এখনও পর্যন্ত চারটি সেডনয়েডের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সৌরজগতে। তবে অ্যামোনাইট এবং তার কক্ষপথ বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে। এই কক্ষপথ আদৌ গোলাকার নয়। উদ্ভট আকারের কক্ষপথ ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অ্যামোনাইট। সবচেয়ে কাছে পৌঁছোলে সূর্যের সঙ্গে তার যত দূরত্ব থাকে, তা পৃথিবী-সূর্যের দূরত্বের ৭১ গুণ। এ ছাড়া, বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, এই সেডনয়েড ২২০ থেকে ৩৮০ কিলোমিটার চওড়া। যা মাউন্ট এভারেস্টের ৪৫ গুণ মাত্র।
সৌরজগতের ইতিহাসের সন্ধানে! —ফাইল চিত্র।
প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপুঞ্জের মৌনা কিয়া আগ্নেয়গিরির উপর বসানো রয়েছে সুবারু টেলিস্কোপ। ২০২৩ সালের মার্চ, মে, অগস্ট মাসে সেই টেলিস্কোপের পর পর পর্যবেক্ষণে অ্যামোনাইটের অস্তিত্ব জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। পরে কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়। সেই থেকে অ্যামোনাইটের কক্ষপথ বোঝার চেষ্টা চলছে।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, আজ থেকে অন্তত ৪২০ কোটি বছর আগে নেপচুনের বাইরের একই কক্ষপথে ঘুরত অ্যামোনাইট-সহ চারটি সেডনয়েড। কিন্তু তার পরে এমন বিধ্বংসী কিছু ঘটেছিল যে, এই চারটি মহাজাগতিক বস্তুর কক্ষপথ আলাদা হয়ে গিয়েছে। সেখানেই লুকিয়ে থাকতে পারে সূর্যের নবম গ্রহ বা প্ল্যানেট ৯-এর রহস্য।
সৌরজগতের শেষ গ্রহ নেপচুন। —ফাইল চিত্র।
৪৫০ কোটি বছর আগে সূর্য তখনও ‘শিশু’। তার চারপাশে তখন সবেমাত্র এক এক করে গ্রহের জন্ম হচ্ছে। পরিধি বিস্তার করছে সৌরজগত। এই সময় থেকে যাবতীয় ঘটনার সাক্ষী এই অ্যামোনাইট। তার কক্ষপথের কাল্পনিক চিত্র তৈরি করতে জাপানের বিজ্ঞানীরা আসরে নামেন। গত ১৯ বছর ধরে কী ভাবে কোন পথে সে ঘুরে চলেছে, তার নকশা আঁকেন বিজ্ঞানীরা। জাপানি দলের অন্যতম সদস্য ফুমি ইয়োশিদা বলেছেন, ‘‘নেপচুনের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব যে অঞ্চলে অত্যন্ত ক্ষীণ, সেখানে অ্যামোনাইটকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই অঞ্চলটিতে অস্বাভাবিক উদ্ভট কক্ষপথের উপস্থিতি অত্যাশ্চর্য কোনও ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করে। প্রাচীনকালে, যে সময়ে অ্যামোনাইটের সৃষ্টি, সেই সময়েই ওই ঘটনা ঘটেছিল বলে আমরা মনে করছি। এই নতুন রহস্যময় সেডনয়েডের কক্ষপথের বিবর্তন, তার বৈশিষ্ট্যগত বিবর্তন বোঝা খুব জরুরি। সৌরজগতের ইতিহাস জানতে তা আমাদের সাহায্য করবে।’’
বিজ্ঞানীদের অনুমান, অ্যামোনাইটের জন্মকালে যে রহস্যময় এবং অত্যাশ্চর্য মহাজাগতিক ঘটনাটি ঘটেছিল, তার ফলে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় সৌরজগতের গণ্ডি থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল নবম গ্রহটি। তার আগে পর্যন্ত সেই গ্রহের ঠিকানা ছিল সূর্য থেকে দূরে, নেপচুনের পাশেই। সৌরজগতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর তার হদিস পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের এই অনুমানের সমর্থনে এখনও যথেষ্ট প্রমাণ মেলেনি। অ্যামোনাইটের কক্ষপথ থেকে মহাজাগতিক এই ঘটনার আভাস পাওয়া গিয়েছে মাত্র। তা নিশ্চিত করতে আরও পর্যবেক্ষণ, আরও গবেষণা এবং আরও চর্চা প্রয়োজন। তবেই উন্মোচিত হতে পারে নবম গ্রহের রহস্যের পর্দা।