পেরুর দক্ষিণে পিসকো উপত্যকায় সারি সারি গর্ত। ছবি: সংগৃহীত।
উঁচু থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কোনও প্রকাণ্ড একটা সাপ চলে গিয়েছে পাহাড়ের কোল দিয়ে। আর সেই ভারী শরীরের ছাপ রয়ে গিয়েছে মাটিতে। জায়গাটির নামকরণও হয়েছে তেমনই— মন্টে সিয়ের্পে। বাংলা তর্জমা করলে মানে দাঁড়ায়, সর্প পর্বত। আসলে ওই অংশটিতে নির্দিষ্ট ব্যবধান অন্তর ছোট ছোট গর্ত। যা ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় পেরুর দক্ষিণ প্রান্তে আন্দিজ পর্বতমালার এই অংশটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে আজও এক বিস্ময়।
পেরুর দক্ষিণে পিসকো উপত্যকায় এমন প্রায় ৫২০০টি ছোট ছোট গর্ত রয়েছে। সারিবদ্ধ ভাবে সেগুলি ছড়িয়ে রয়েছে। লোকমুখে এই গঠনটি ‘ব্যান্ড অফ হোলস’ বা ‘গর্তের সারি’ নামে পরিচিত। এই গর্তগুলি কবে হয়েছে, কারা করেছেন— কিছুই স্পষ্ট নয়। কোনও প্রাচীন নথিতেও এ বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। ফলে এই গর্তগুলি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। প্রতিরক্ষা, হিসাবরক্ষা, সংরক্ষণ, বাগান বা জলধারণের জন্য এগুলিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তবে বেশির ভাগ প্রত্নতাত্ত্বিকই একটি বিষয়ে সহমত, এই গঠন প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয়নি। এটি মনুষ্যসৃষ্ট। কেউ কেউ এই গঠনের নেপথ্যে ‘ভিন্গ্রহী’ তত্ত্বও খাড়া করার চেষ্টা করেছেন, তবে তা ধোপে টেকেনি।
শত শত বছর আগে এই গর্তগুলি তৈরি হলেও দীর্ঘ সময় ধরে তা বিশ্ববাসীর নজরের আড়ালেই রয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক শতাব্দী আগে, ১৯৩৩ সালে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ এই সর্পিল পর্বতের কিছু ছবি প্রকাশ করে। আকাশ থেকে তোলা ওই ছবিগুলি প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায়। বিস্তর গবেষণাও হয়। কিন্তু ধোঁয়াশা কাটেনি। এ বার ওই গর্তগুলির বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য তুলে ধরল নতুন এক গবেষণা। কী কাজে ওই গর্তগুলি ব্যবহার হত, তা নিয়েও আলোকপাত করল নয়া গবেষণা।
আকাশ থেকে এমনই দেখায় পিসকো উপত্যকার সেই গর্তগুলিকে। ছবি: সংগৃহীত।
আনুমানিক ১২০০ সালে আন্দিজ পর্বতমালায় গড়ে উঠেছিল ইনকা সভ্যতা। নতুন গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে, ইনকা সভ্যতা গড়ে ওঠারও আগে থেকে এই গর্তগুলি সেখানে রয়েছে। গবেষকদের অনুমান, ১০০০-১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই গর্তগুলি খোঁড়া হয়েছিল। প্রাক্-ইনকা সভ্যতাতেও এই গর্তগুলি ব্যবহৃত হত বলে দাবি প্রত্নতাত্ত্বিকদের। চলতি মাসেই এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যান্টিকুইটি’ জার্নালে। ড্রোন ক্যামেরায় তোলা নতুন কিছু ফুটেজ এবং ওই গর্তগুলি থেকে পাওয়া কিছু পরাগরেণুর ‘মাইক্রোবোটানিক্যাল’ বিশ্লেষণ করে দেখেন গবেষকেরা। তা থেকে তাঁদের অনুমান, এই গর্তগুলি প্রাক্-ইনকা সভ্যতায় একটি বাজার এলাকা হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরে ইনকা সভ্যতায় এগুলিকে হিসাবরক্ষণের পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
এই গবেষকদলের নেতৃত্ব দেন প্রধান সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং অস্ট্রেলিয়ান মিউজ়িয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক জ্যাকব বোঙ্গার্স। তাঁর কথায়, “দক্ষিণ পেরুতে পাহাড়ের পাদদেশে সেই প্রাচীন যুগে মানুষ কেন পাঁচ হাজারেরও বেশি গর্ত খুঁড়েছিল, তা আমরা এখনও জানি না। তবে আমরা কিছু নতুন তথ্য খুঁজে পেয়েছি, যা এই এলাকাকে নিয়ে গবেষণার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।”
নির্দিষ্ট ব্যবধানে এই গর্তগুলি খোঁড়া হয়েছে ইনকা সভ্যতারও আগে। ছবি: সংগৃহীত।
ড্রোনের মাধ্যমে তোলা পেরুর এই সর্প পর্বতের নতুন কিছু ছবি গবেষণায় বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে। ড্রোনপ্রযুক্তির মাধ্যমে দেখা গিয়েছে, প্রতিটি গর্তের ব্যাস ৩.৩-৬.৬ ফুটের মধ্যে। গভীরতা ১.৬-৩.৩ ফুট। গবেষকদলের প্রধান বোঙ্গার্স জানান, এই গর্তগুলি প্রায় ৬০টি ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগের কিছু নিজস্বতা রয়েছে। যা থেকে স্পষ্ট যে এগুলি ভীষণ ভাবে সংগঠিত। গর্তগুলির ভিতরে পুরনো কিছু পরাগরেণু পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে যেমন ভুট্টাজাতীয় শস্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে কিছু বুনো গাছের অংশও। ওই বুনো গাছগুলিকে মূলত ঝুড়ি তৈরির জন্য ব্যবহার করা হত বলে দাবি গবেষকদের।
গবেষকদের অনুমান, এই গর্তগুলিতে ফসল এনে বিনিময়ের উদ্দেশ্যে জমা করা হত। অর্থাৎ, এক গর্ত ফসলের পরিবর্তে অন্য কোনও গর্তের ফসল লেনদেন করা হত। প্রাক্-ইনকা যুগের চিনচা উপজাতির মানুষেরা বিনিময় প্রথার মাধ্যমে এখানে ব্যবসা করতেন বলে অনুমান করছেন বোঙ্গার্স এবং তাঁর দল। বোঙ্গার্সের কথায়, “সম্ভবত তুলো, কোকা, ভুট্টা বা লঙ্কার মতো ফসল এই গর্তগুলিতে রাখা হত এবং তা পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করা হত।” অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সংখ্যক গর্তের ভুট্টার পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক গর্তের তুলো বা কোকা বিনিময় করা হত এই বাজারে।
পরবর্তী সময়ে পেরুতে ইনকা সভ্যতা গড়ে ওঠার পরে এটিকে হিসাব রাখার একটি একক হিসাবে ব্যবহার করা হত বলে অনুমান করা হচ্ছে। গবেষকদলের কথায়, ইনকাদের আমলে এটির ব্যবহার ছিল অনেকটা ‘এক্সেল স্প্রেডশিট’-এর মতো। ইনকারা হিসাব রাখার জন্য এক ধরনের গিঁটযুক্ত দড়ি ব্যবহার করত। তার সঙ্গে পিসকো উপত্যকার এই দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ গঠনের অনেকাংশে মিল পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি গবেষকদের।
পেরুতে ইনকা সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৫৩২ সালে। তার পরে এখানে স্পেনের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। দাবি করা হচ্ছে, ওই ঔপনিবেশিক আমলেও ‘সর্প পর্বত’-কে ব্যবহার করা হত। এই গর্তগুলি থেকে লেবু গাছেরও পরাগরেণু খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। লেবু গাছ এখানে আসে মূলত ঔপনিবেশিক আমলেই (১৫৩১-১৮২৫ সালের মধ্যে)। তবে পরে এই অঞ্চলটি স্পেনের অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তবে এই তত্ত্বগুলিকে অকাট্য হবে গ্রহণ করার আগে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।