পৃথিবীর নিকটেই নতুন এক মহাজাগতিক বস্তুর হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীত।
মহাকাশের বিচারে দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাত্র ৪৫ লক্ষ কিলোমিটার। এর চেয়েও কত দূরের বস্তুকে কত সহজে ক্যামেরায় ধরেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা! কিন্তু ‘হাতের কাছে’ পড়ে থাকলেও এত দিন তার খোঁজ মেলেনি। কী ভাবে যেন চোখের আড়ালে সে কাটিয়ে দিয়েছে ছ’টি দশক! আচমকা কিছু দিন আগে অবশেষে তার দেখা মিলল। প্রতিবেশীর রূপে চমকে গেলেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীর এই প্রতিবেশীকে ঠিক গ্রহ বলা যায় না। আবার সে চাঁদের মতো উপগ্রহও নয়। অধিকাংশ বিজ্ঞানী একে গ্রহাণু বলার পক্ষপাতী। এমন এক গ্রহাণু, যা পৃথিবীর গা ঘেঁষে তার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে চলেছে। চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই গ্রহাণু পৃথিবীকে নয়, প্রদক্ষিণ করে সূর্যকেই। তবে পৃথিবীর ছায়াসঙ্গী হয়ে। তাই তার নাম কোয়াসি-মুন। পৃথিবীর কাছাকাছি এমন অন্তত ছ’টি কোয়াসি-মুনের কথা আগে থেকেই জানতেন বিজ্ঞানীরা। এ বার সেই সংখ্যা পৌঁছোল সাতে। নতুন আবিষ্কৃত কোয়াসি-মুনের নাম দেওয়া হয়েছে ২০২৫পিএন৭।
কোয়াসি-মুন কী
কোনও গ্রহের কাছ ঘেঁষে, তার কক্ষপথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে সমস্ত পাথরখণ্ড নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে, তাদের ওই গ্রহের কোয়াসি-মুন বলা হয়। ‘মুন’ বা ‘চাঁদ’ শব্দটি এদের নামে রয়েছে বলে অনেকে সাধারণ উপগ্রহের সঙ্গে এদের গুলিয়ে ফেলেন। মনে করেন, আর পাঁচটা উপগ্রহের মতো কোয়াসি-মুনও নির্দিষ্ট গ্রহের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু বাস্তবে তা গ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কক্ষপথে নক্ষত্রকেই প্রদক্ষিণ করে থাকে।
নতুন আবিষ্কারে কী কী জানা গেল
এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর কাছে যে ক’টি কোয়াসি-মুনের খোঁজ মিলেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট নতুন আবিষ্কৃত এই ২০২৫পিএন৭। এর ব্যাস প্রায় ৬২ ফুট। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা একে ‘ক্ষুদ্র’ আখ্যা দিতেও দ্বিধা করছেন না। তবে আকারে ছোট হলেও ২০২৫পিএন৭ উজ্জ্বল। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপের মাধ্যমে একে দেখা যায়। যে কক্ষপথে ২০২৫পিএন৭ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তা পৃথিবীর কক্ষপথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে যখন চলে আসে ২০২৫পিএন৭, তখন পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব হয় ৪৫ লক্ষ কিলোমিটার। এই দূরত্ব ৪৫ লক্ষ থেকে ৫ কোটি ৯৫ লক্ষ কিলোমিটারের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আরও অন্তত ৬০ বছর পৃথিবীর কাছে এ ভাবেই থেকে যাবে ২০২৫পিএন৭, দাবি বিজ্ঞানীদের।
এত দিন অন্তরালে কী ভাবে
বিজ্ঞানীদের ধারণা, মূলত আকারে ছোট হওয়ার কারণেই এত দিন আড়ালে থেকে গিয়েছে ২০২৫পিএন৭। হাতের কাছে ঘুরলেও তার দেখা পাওয়া যায়নি। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে কমপ্লুটেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্লোস দে লা ফুয়েন্তে মার্কস ২০২৫পিএন৭-কে উজ্জ্বল বলতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘২০২৫পিএন৭ একটা খুব ছোট, আবছা কোায়সি-মুন। পৃথিবী থেকে একে ভাল করে দেখা যায় না। সেই কারণেই এটা এত দিন আবিষ্কৃত হয়নি। কারও চোখেই পড়েনি। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই।’’ গত ৩০ অগস্ট ২০২৫পিএন৭ আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনা হয়। তার পর ২ সেপ্টেম্বর আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি (এএএস)-এর ‘রিসার্চ নোট্স’ নাম জার্নালে এই কোয়াসি-মুনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
ভূত ও ভবিষ্যৎ
কোয়াসি-মুন আসলে মহাজাগতিক পাথরখণ্ড। বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, পৃথিবীর স্বাভাবিক উপগ্রহ চাঁদের ছোট ছোট অংশ এই কোয়াসি-মুনগুলি। অতীতে কোনও সময়ে চাঁদ থেকেই পাথরের টুকরো ছিটকে বেরিয়ে বেরিয়ে এগুলি তৈরি হয়েছে। তার পর তা পৃথিবীকে অনুসরণ করে সূর্যের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। ২০২৫পিএন৭-এর ক্ষেত্রেও এই অনুমান প্রযোজ্য। পৃথিবীকে অনুসরণ করলেও কোয়াসি-মুন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের অধীন নয়। তাদের গতিপথ স্বতন্ত্র। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে এই ধরনের পাথরখণ্ড পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের অধীনে চলে আসে। তখন তার নাম দেওয়া হয় মিনি মুন। যদিও পরে আবার তা ছিটকে বেরিয়ে যায়। পৃথিবীর সঙ্গী হিসাবে আপাতত আরও ৬০ বছর ২০২৫পিএন৭-কে দেখতে পাওয়া যাবে, দাবি বিজ্ঞানীদের। এর দ্বারা পৃথিবীর ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা নেই।