Science

অনেক বেশি জল আছে নতুন সাত ‘পৃথিবী’তে!

পৃথিবীর চেয়ে অনেক অনেক বেশি জলে ভাসছে নতুন সাত ‘পৃথিবী’। ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে। কোনও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানালেন নতুন সাত ভিনগ্রহের মূল আবিষ্কর্তা বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল গিলন।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৭ ১৬:০০
Share:

নতুন সাত ‘পৃথিবী’। (ইনসেটে) মূল আবিষ্কর্তা মিশেল গিলন।

তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। এই নিয়ে আহ্লাদে আট খানা হওয়ার দিন বোধহয় শেষ হয়ে এল পৃথিবীর!

Advertisement

জল-পাল্লায় পৃথিবীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এমন সাত-সাতটি নতুন ‘পৃথিবী’ ধরা দিয়েছে আমাদের চোখে। নতুন সেই সাত ‘পৃথিবী’ রীতিমতো টইটুম্বুর হয়ে আছে তরল জলে। অতলান্ত, আদিগন্ত তরল জলের সাগর, মহাসাগরে। আর সেই জল ঢাকা নেই কোনও পুরু বরফের চাদরের তলায়। সেই জল বরফ হয়ে তো নেই-ই, এমনকী, বরফ-গলা জলও (আইস ওয়াটার) তা নয়। যে তাপমাত্রা পেলে, বায়ুমণ্ডলের যতটা চাপ থাকলে পৃথিবীর সাগর, মহাসাগরের জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে, ঠিক সেই তাপমাত্রা আছে বলেই সদ্য আবিষ্কৃত নতুন সাত ‘পৃথিবী’র জলও রয়েছে একেবারে তরল অবস্থায়। ভূপৃষ্ঠেই (সারফেস)।

কোনও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে এ কথাই জানিয়েছেন নতুন সাত ‘পৃথিবী’র মূল আবিষ্কর্তা বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল গিলন।

Advertisement

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে নাসার সদর দফতরে বসে যে ৫ বিজ্ঞানী সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন নতুন সাত ‘পৃথিবী’র আবিষ্কারের খবর, বেলজিয়ামের লিগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূপদার্থবিদ্যা ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের এফএনআরএস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মিশেল গিলন তাঁদের অন্যতম।


প্রথমে খোঁজ মিলেছিল তিন ‘পৃথিবী’র (ওপরে)। পরে ২০১৭-য় আরও চার ‘পৃথিবী’র হদিশ পায় স্পিৎজার (নীচে)

আমাদের পৃথিবী আর নতুন সাত ‘পৃথিবী’র জন্ম হয়েছিল কি একই ভাবে?

বেলজিয়াম থেকে আনন্দবাজারকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ ই-মেল সাক্ষাৎকারে মিশেল গিলন লিখেছেন, ‘‘প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে যে ভাবে জন্ম হয়েছিল আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহটির, হয়তো ঠিক সেই ভাবেই গড়ে ওঠেনি এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেই আমাদের খুব কাছে থাকা (দূরত্ব মাত্র ৩৯ আলোকবর্ষ) নক্ষত্রমণ্ডল ‘ট্রাপিস্ট-১’-এর সদ্য আবিষ্কৃত সাতটি ভিনগ্রহের। আমরা এখনও পর্যন্ত যতটা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে, ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্র থেকে অনেক অনেক দূরেই (সূর্য থেকে যতটা দূরত্বে রয়েছে বৃহস্পতি, শনি, নেপচুনের মতো গ্রহগুলি) জন্ম হয়েছিল এই নতুন সাত ‘পৃথিবী’র। নক্ষত্রমণ্ডলের যে-এলাকাটাকে বলে ‘প্রাইমোর্ডিয়াল প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক’। যা ভরা ছিল ঘন গ্যাসে আর জমাট বাঁধা বরফে। প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক আসলে ঘন গ্যাসের এমন একটা খুব পুরু চাকতি, যেখান থেকে গ্রহ, উপগ্রহের জন্ম হয়। আমাদের মনে হয়েছে, এই বহু দূরের প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আকারের সাতটি গ্রহ তাদের নক্ষত্রের (ট্রাপিস্ট-১) খুব কাছে এসে গিয়েছিল। সেই দূরত্ব, যাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘গোল্ডিলক্‌স জোন’ বা ‘হ্যাবিটেবল জোন’। মানে, নক্ষত্র থেকে কোনও গ্রহ যে দূরত্বে থাকলে সেখানে প্রাণের জন্ম হতে পারে বা সেই প্রাণ সহায়ক পরিবেশ পেতে পারে বিকাশের জন্য। আমাদের সৌরমণ্ডলে যেমন মঙ্গল, শুক্র আর পৃথিবী রয়েছে ‘গোল্ডিলক্‌স জোন’-এ।’’

আরও পড়ুন- বাঙালি বিজ্ঞানীর হাত ধরে ‘আবেগপ্রবণ’ হচ্ছে রোবট


তুলনায় আমাদের সৌরমণ্ডল ও সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্রমণ্ডলের গ্রহগুলি

স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপে যে ভাবে ধরা পড়েছিল নতুন ‘পৃথিবী’রা

নতুন সাত ‘পৃথিবী’র আবিষ্কারের ঘোষণার পরপরই মহাকাশে নাসার পাঠানো স্পিৎজার টেলিস্কোপ তো বটেই, মহাকাশে থাকা আরও দু’টি সুবিশাল টেলিস্কোপ-হাবল আর কেপলারও নজর রাখতে শুরু করেছে ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলের ওপর। আগামী বছর নাসা মহাকাশে পাঠাচ্ছে আরও বড়, আরও দক্ষ টেলিস্কোপ। যার নাম- জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)। তাই গিলনের আশা, ‘‘হয়তো আগামী বছর বা তার পরের বছরের মধ্যেই আমরা জানতে পারব ঠিক কতটা জলে ভাসছে নতুন সাত ‘পৃথিবী’র বুক।’’

প্রাণের সহায়ক পরিবেশ পাওয়ার সম্ভাবনা কোথায় বেশি? ভিনগ্রহ ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’ নাকি নতুন সাত ‘পৃথিবী’তে?


টেলিস্কোপের নজরে পড়া সেই সাত নতুন ‘পৃথিবী’

আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত ই-মেল সাক্ষাৎকারে গিলন বলেছেন, ‘‘এখনও এই তুলনাটা করার জায়গায় আমরা পৌঁছতে পারিনি। এখনও নতুন সাত ‘পৃথিবী’র বায়ুমণ্ডল, আবহাওয়া, পরিবেশ, বায়ুমণ্ডলে কী কী রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, সে সব সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা কিছুটা ভাসা ভাসা। নতুন সাত ‘পৃথিবী’ যে আমাদের পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য হতে পারে, হয়ে উঠতে পারে, এই কথাটা আমরা বলতে পারছি, এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যাদির ওপর নির্ভর করেই। আর তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এখনও পূর্ণাঙ্গ ভাবে ওই নতুন সাত ‘পৃথিবী’কে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে আপাতত মনে হয়েছে, ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’ ভিনগ্রহটি থেকে সদ্য আবিষ্কৃত সাতটি গ্রহ অনেক বেশি ‘গেম চে়ঞ্জার’। যা এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য মুলুকে বাসযোগ্য গ্রহ খোঁজার লক্ষ্যে আমাদের এত দিনের গবেষণার মোড় সত্যি-সত্যিই ঘুরিয়ে দিতে পেরেছে। কারণ, এই গ্রহগুলি যে-দূরত্বে রয়েছে, তাতে আমাদের হাতে থাকা প্রযুক্তি দিয়ে খুব সহজেই গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডল, আবহাওয়া আমরা ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারব বলে মনে করছি। আরও আশার কথা, এই গ্রহগুলির ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শূন্য থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩২ ডিগ্রি থেকে ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে। মানে, যে তাপমাত্রায় জল খুব সহজেই থাকতে পারে তরল অবস্থায়। আর প্রাণের জন্ম বা তার বিকাশের পক্ষেও এই তাপমাত্রাটা একেবারেই আদর্শ। ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’ ভিনগ্রহের ক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা নেই। হাবল, কেপলার, স্পিৎজার ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ ব্যাপারে আমাদের খুব সাহায্য করবে। ফলে আশা করছি, দু’-এক বছরের মধ্যেই আমরা জানতে পারব এই নতুন সাত ‘পৃথিবী’ আমাদের মতোই বাসযোগ্য কি না।’’

আরও পড়ুন- এই ভারতীয় না থাকলে নতুন ৭ ‘পৃথিবী’র হদিশ মিলত কি?


তুলনায় আমাদের সৌরমণ্ডল ও সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্রমণ্ডলের গ্রহগুলি

‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলেও কি বৃহস্পতি, শনির মতো খুব বড় আর ভারী গ্রহগুলি রয়েছে তাদের নক্ষত্র থেকে অনেকটা দূরে?

অধ্যাপক মিশেল গিলন বলছেন, ‘‘না। তেমন কোনও সম্ভাবনাই নেই। অনেকগুলি কেন, বৃহস্পতি, শনি, নেপচুনের মতো বিশাল চেহারার গ্যাসে ভরা গ্রহ ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে আদৌ আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, অত বিশাল চেহারার গ্রহ তৈরি হওয়ার জন্য যতটা ভারী হতে হয়, ওই নক্ষত্রমণ্ডলের প্রাইমোর্ডিয়াল প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক ততটা ভারী বা পুরু নয়। ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্র আসলে খুবই ঠাণ্ডা নক্ষত্র। চেষ্টা করেও যা আমাদের সূর্যের মতো বড় নক্ষত্র হয়ে উঠতে পারেনি। এগুলিকে বলে ‘বামন নক্ষত্র’ বা ‘ডোয়ার্ফ স্টার’। আমাদের সৌরমণ্ডল যখন তৈরি হচ্ছে, তখন তার প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক খুব ভারী আর পুরু ছিল বলেই বৃহস্পতি, শনি, নেপচুনের মতো ভারী ভারী বিশাল চেহারার গ্রহগুলি জন্মাতে পেরেছিল। এই প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কটাই অতটা ভারী আর পুরু নয় ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে। তাই বৃহস্পতি, শনি, নেপচুনের মতো বিশাল বিশাল ভারী গ্যাসে ভরা গ্রহ ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে আদৌ জন্মাতেই পারেনি বলে আমাদের মনে হয়েছে।’’


‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডল আর তার গ্রহুগুলি (কালো গোলাকার)

লাদাখে এইচসিটি টেলিস্কোপের অপটিক্যাল ব্যান্ডে যে ভাবে ধরা পড়েছিল ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডল

নতুন সাত ‘পৃথিবী’তে কি ‘বায়ো-সিগনেচার’ বা প্রাণের স্বাক্ষর পাওয়া যেতে পারে?

মিশেল গিলনের জবাব, ‘‘এখনও বলতে পারছি না। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে ওই গ্রহগুলির বায়ুমণ্ডল, আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণের পরেই আমরা সেটা ঠিক ভাবে বুঝতে পারব। যাই ঘটুক না কেন, সামনের দু’-এক বছরে আমরা অবাক করে দেওয়ার মতো কিছু ঘটনা ঘটবে বলে আশা করছি।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন