কে চালাচ্ছে এই ব্রহ্মাণ্ড? কোথায় লুকনো রয়েছে সেই ‘ভুতুড়ে’ শক্তি?

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’-এর অ্যাকাডেমিক ডিন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী সৌমিত্র সেনগুপ্ত।দু‘-দু’টো চমক! গত কয়েক বছরে তিনি কোনও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বড় সাক্ষাৎকার দেননি। মুখ খুলতে চাননি। দীর্ঘ নীরবতার পর আনন্দবাজারে মুখ খুললেন এ দেশের পুরোধা পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। এবং বিস্ফোরণ! জানালেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মেলাটা ততটা চমকদার ঘটনা নয়! কারণ, তার পূর্বাভাস দেওয়া ছিল অনেক আগেই। বরং এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডার্ক এনার্জি কী জিনিস, তার উৎস কোথায়, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ১২:৪৪
Share:

অধ্যাপক অশোক সেন।

দু‘-দু’টো চমক! গত কয়েক বছরে তিনি কোনও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বড় সাক্ষাৎকার দেননি। মুখ খুলতে চাননি। দীর্ঘ নীরবতার পর আনন্দবাজারে মুখ খুললেন এ দেশের পুরোধা পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। এবং বিস্ফোরণ! জানালেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মেলাটা ততটা চমকদার ঘটনা নয়! কারণ, তার পূর্বাভাস দেওয়া ছিল অনেক আগেই। বরং এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডার্ক এনার্জি কী জিনিস, তার উৎস কোথায়, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া।

Advertisement

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আর ২৬ ডিসেম্বর আমেরিকার ‘লাইগো’ ডিটেক্টরে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব দু’-দু’বার প্রমাণিত হল, সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে আপনার কোনও প্রতিক্রিয়া পাইনি। তাই আপনার মতামত জানার কৌতুহলটা আরও বেড়ে গিয়েছে...

অশোক সেন: নিঃসন্দেহে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তবে এটাও খুব সত্যি কথা, এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের পূর্বাভাস অনেক দিন আগেই দেওয়া হয়েছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। তার পর ১০০ বছর ধরে একের পর এক পরীক্ষানিরীক্ষায় আইনস্টাইনের ওই তত্ত্বের অভাবনীয় সাফল্যের পর মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া না গেলে, সেটাই খুব অস্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যেত! তা ছাড়াও যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ এ বছর প্রথম পাওয়া গিয়েছিল, দু’টি বাইনারি পালসারের মধ্যে ১৩০ কোটি বছর আগেকার একটি সংঘর্ষের ঘটনায় তার জন্ম হয়েছিল। বাইনারি পালসার নিয়ে পরীক্ষার ফলাফলে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা কিন্তু আগেই, পরোক্ষ ভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। এ বার নতুনত্ব যেটায়, তা হল- ‘লাইগো’য় প্রথম এটার সরাসরি হদিশ মিলল। নতুনত্ব এই টুকুই।

Advertisement


মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: এই আবিষ্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক কোনটা বলে আপনার মনে হয়?

অশোক সেন: এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি আর তার নানা অজানা, অচেনা ঘটনা জানার জন্য আমরা এত দিন তরিৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গকেই (যেমন, আলো) প্রধান মাধ্যম বলে জানতাম। আলোই এত দিন আমাদের অনেক দূরের আর অনেক আগেকার নানা অজানা, অচেনা তথ্য জানিয়ে এসেছে। জানিয়ে চলেছে এখনও। এখন এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ একেবারেই একটি নতুন মাধ্যম হিসেবে খবর আদানপ্রদানের জন্য আমাদের সামনে নতুন একটি জানলা খুলে দিল। যেমন, আমেরিকার ‘লাইগো’য় প্রথম যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছে, তার উদ্ভব হয়েছিল ১৩০ কোটি বছর আগে দু’টি বাইনারি পালসারের (আদতে দু’টি কৃষ্ণগহ্বর) মধ্যে সংঘর্ষের দরুন। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ না থাকলে, আমরা কোনও দিন জানতেই পারতাম না, ওই দু’টি বাইনারি পালসারের মধ্যে কোনও দিন সংঘর্ষ হয়েছিল কি না। বা, সেই সংঘর্ষ ঠিক কত দিন আগে হয়েছিল? কোথায় হয়েছিল? তার মানে, ওই সংঘর্ষের কথা এত দিন আমাদের কাছে অজানা ছিল। যা আমাদের জানাল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এটাই প্রমাণ করল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার এই ব্রহ্মাণ্ডকে আরও বেশি করে জানা ও চেনার জন্য আমাদের সামনে জানলাটাকে কতটা খুলে দিয়েছে।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: ২০১২ সালে সুইৎজারল্যান্ডের জেনিভায়, সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (এলএইচসি) আবিষ্কৃত হল ‘হিগস বোসন’ কণা। কণা-পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে যা একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই আবিষ্কার ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল অফ এলিমেন্টারি পার্টিকল্‌স’-কে তার সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। এই তত্ত্ব মহাকর্ষীয় বল ছাড়া আর অন্য সব ‘বল’ (ফোর্স বা ফিল্ড)-কেই ব্যাখ্যা করতে পারে। তিন বছরের মধ্যেই ঘটল আরও একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আইনস্টাইনের ১০০ বছর আগেকার তত্ব প্রায় সার্বিক ভাবেই প্রমাণিত হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কারে। তিন বছরের ব্যবধানে এই দু’টি যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্যে কোনটিকে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

অশোক সেন: দু’টিই খুব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। দু’টির মধ্যে সে ভাবে তুলনা করাটাও কঠিন কাজ। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। ‘হিগ্‌স বোসন’ আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ- এই দু’টিরই অস্তিত্বের কথা তাত্ত্বিক ভাবে অনেক দিন আগেই আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল। তাই এক দিন না এক দিন যে ওই দু’টি জিনিসের প্রমাণ মিলবে হাতেনাতে, তা কিন্তু আমরা আগে থেকেই আশা করেছিলাম। শুধু এত দিন ধরে আমরা সেই দু’টি জিনিসের সন্ধান পেয়ে উঠতে পারছিলাম না। এই টুকুই! এদের খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু এদের আবিষ্কার মোটেই বিস্ময়কর ঘটনা নয়। নয় নতুন কিছুর ইঙ্গিতও। তবে এটা আশা করা যেতেই পারে যে, এলএইচসি আর ‘লাইগো’-র ডিটেক্টরগুলো থেকে আমরা আগামী দিনে অনেক নতুন নতুন আর অজানা ঘটনা জানতে পারব, যা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় ধ্যানধারণাকে আমূল বদলে দেবে।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: ‘হিগ্‌স বোসন’ আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ছাড়া সাম্প্রতিক কালে পদার্থবিজ্ঞানে আর কোন আবিষ্কারকে আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা যুগান্তকারী বলে মনে করেন? আর সেটা কেন মনে করেন?


অজানা, অচেনা ‘ডার্ক এনার্জি’র উৎস জানাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ!

অশোক সেন: যেহেতু আমরা পরীক্ষালব্ধ ফলাফল নিয়ে কথা বলছি, তাই আমি আরও দু’টি আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা যুগান্তকারী বলে মনে করি। তার একটি হল- ‘ডার্ক এনার্জি’ বা ‘অদৃশ্য শক্তি’। অন্যটি- নিউট্রিনো কণার ভরের অস্তিত্বের প্রমাণ। ডার্ক এনার্জি হল সেই অজানা, অচেনা শক্তি (যা ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের ৭৩ শতাংশের কিছু বেশি), যার দরুন বিভিন্ন গ্যালাক্সি একে অন্যের থেকে ক্রমবর্দ্ধমান গতিবেগে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অজানা, অদৃশ্য শক্তির উৎসটা কোথায়, তা কী দিয়ে তৈরি, সে সম্পর্কে আমাদের এখনও সঠিক কোনও ধারণা নেই। তার মানে, এই ব্রহ্মাণ্ডের চার ভাগের তিন ভাগটাই আমরা জানি না। অন্য দিকে, নিউট্রিনোর মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার যে ভর রয়েছে, তার কোনও পূর্বাভাস ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’-এ ছিল না। কিন্তু, সেই নিউট্রিনোরও ভরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। এই দু’টি আবিষ্কারই আগামী দিনে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আ্মাদের অনেক নতুন আর অজানা তথ্য জানাতে পারবে বলে আমার অনুমান।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: ‘স্ট্রিং থিয়োরি’, যা আপনার গবেষণার মূল ক্ষেত্র, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের ব্যাপারে সেই তত্ত্ব কী বলে?

আরও পড়ুন- কেন হয় ব্রেস্ট ক্যানসার? ‘চক্রী’দের হদিশ মিলল মহাকাশ গবেষণায়!

ডিগ্রি নেই, মাইনেও কম, তবু বৃহস্পতি জয় করতে তাঁকেই ডাকল নাসা

অশোক সেন: মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সম্পর্কে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যা বলে, মনে রাখতে হবে, ‘স্ট্রিং থিয়োরি’ তার চেয়েও ওই তরঙ্গ সম্পর্কে অনেক বেশি কিছু বলে। তবে তার সত্যতা এখনও প্রমাণ করা যায়নি পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে। আর তার জন্য আমাদের গবেষণাগারকে আরও উন্নত করে তুলতে হবে, আমাদের প্রযুক্তিকে আরও আধুনিক করে তুলতে হবে। তবে মহাকর্যীয় তরঙ্গ সম্পর্কিত আইনস্টাইনের তত্ত্ব কিন্তু ‘স্ট্রিং থিয়োরি’র মধ্যেই ঢুকে রয়েছে। ওই তত্ত্ব ‘স্ট্রিং থিয়োরি’র সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: ভবিষ্যতে বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের তাৎপর্য কতটা?

অশোক সেন: যেহেতু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে জানা ও চেনার একটি নতুন মাধ্যম হয়ে গেল, তাই এর মাধ্যমে আগামী দিনে আমরা অনেক অজানা, অচেনা মহাজাগতিক ঘটনার সংকেত পাব। পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্বগুলো হয়তো এই সব বেশ কিছু ঘটনার পূর্বাভাস দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু এ বার তার বাইরেও আরও নতুন নতুন বিস্ময়কর ঘটনার সংকেত বয়ে আনবে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। যা হয়তো আমাদের পরিচিত চিন্তাভাবনা বা তত্ত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। এটাই আমার মতে, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত: ঠিক যেমন তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে এখন আমাদের সব রকমের খবরের আদানপ্রদান ঘটে ( যেমন, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন), আগামী দিনে কি আমরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমেও সেই কাজটা করতে পারব?

অশোক সেন: অদূর ভবিষ্যতে তা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে অন্তত আমার মনে হয়। তবে প্রযুক্তির অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি তো অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলতে পারে!

ছবি ও অডিও লিঙ্ক সৌজন্যে: অধ্যাপক সৌমিত্র সেনগুপ্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন