সুসান ফিনলে।
মার্কশিটে একশোয় একশো পাননি কোনও দিনই। প্রথাগত শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তাঁর নেই। কলেজের গণ্ডি পেরোনোর সার্টিফিকেট হাতে নেই বলে, নাসা তাঁকে মোটা বেতনও দেয় না। অল্প রোজগার বলে, খুব মেপে চলতে হয়। এই ৭৯ বছর বয়সেও ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরিতে (জেপিএল) এখনও তাঁকে রোজ আসতে হয়। আট ঘণ্টার ডিউটি, আধ ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক। জেপিল-এ আসা আর বেরিয়ে যাওয়ার সময় রোজই নাসার দেওয়া আইডেনটিটি কার্ডটা তাঁকে ‘ইন’ আর ‘আউট’ পাঞ্চ করতে হয়। না হলে, মাইনে কাটা যাবে! হ্যাঁ, এই ৭৯ বছর বয়সেও। মাইনে কম বলে যদিও ওভারটাইম দেওয়া হয়।
তিনি সুসান ফিনলে। এই সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বিপজ্জনক গ্রহ বৃহস্পতিকে জয় করার জন্য যাঁর মুখাপেক্ষী হয়েছে নাসা। ভারতীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে বৃহস্পতির কক্ষপথে ঢুকে পড়ে এই প্রথম মানব সভ্যতা গুরুগ্রহের সবচেয়ে কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর মহাকাশযান জুনো প্রথম যে সিগন্যাল বা ‘টোন’টা পাঠিয়েছিল তা দেখা, শোনা ও বোঝার দায়িত্বটা ছিল এই ফিনলে-র কাঁধেই। নাসার কন্ট্রোল রুম থেকে জুনোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘ভাল আছো তো? ঠিক মতো পৌঁছেছো? ঝামেলা হচ্ছে না তো পথে?’ পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির দূরত্বটা তো বড় কম নয়! তাই আমাদের পাঠানো বার্তা জুনোর কাছ যেতে আর তা ডিকোড করে জুনোর পাঠানো পাল্টা বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছতে তো সময় লাগবেই। লেগেওছিল। উত্তেজনা-উত্কণ্ঠায় যখন সেকেন্ড-মিনিট মাপছি আমরা, সেই সময়েই, আজ ভোরে জুনোর সিগন্যাল এসে পৌঁছেছিল আমাদের কাছে— ‘ভাল আছি। ভাল ভাবে পৌঁছেছি। পথে দেরি হয়নি, ঝামেলাও হয়নি কোনও।’ কিন্তু, সেই সিগন্যাল ঠিকঠাক বোঝার মতো দক্ষতা সকলের থাকে না। অন্তত নাসার হাতে আপাতত আর কেউই নেই ৭৯ বছর বয়সের এই ফিনলে ছাড়া। তাই, ফিনলেকেই দেওয়া হয়েছিল জুনো মিশন তদারকির ভার। ২০০৪-এ মঙ্গলে স্পিরিট এবং অপরচুনিটি এই দুটো রোভার মহাকাশযানের পাঠানো সিগন্যালও ডিকোড করেছিলেন এই ফিনলে। ২০১২-য় মঙ্গলে কিউরিওসিটি নেমেও ফিনলেকে প্রথম পাঠিয়েছিল প্রথম বার্তাটা। বেঁচে থাকলে ২০২১-এ মঙ্গলে যে আর একটা রোভার মহাকাশযান পাঠাবে নাসা, তারও পৌঁছ-সংবাদ শোনার দায়িত্বটা পাবে ফিনলে। মঙ্গলবার পাসাডেনার জেপিএল থেকে হোয়াটস্অ্যাপে ফিনলে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘নাসার জন্মের আগে থেকেই আমি মহাকাশ গবেষণায় মেতে আছি। ১৯৫৮-এ আমি প্রথম এসেছিলাম জেপিএল-এ। তখনও নাসার জন্মই হয়নি। কম্পিউটার ইঞ্জিয়নিয়ারিং-এ সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। তার পরেই আমেরিকা মহাকাশে পাঠাল তার প্রথম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার-ওয়ান। তার ছ’মাস পর মার্কিন কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নিল, গড়া হবে নাসা। আমার দুই ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েদের একটু হাতেপায়ে করতে মাঝে ছ’মাসের জন্য নাসা ছেড়ে গিয়েছিলাম। ফিরে আসি ৬৯-এ। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিতে ঢুকেছিলাম কলেজে। কিন্তু, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য নিজের পড়া শেষ করতে পারিনি। ডিগ্রি নেই আমার। তাই বেতনও পাই কম। ওভারটাইম দিয়ে নাসা অবশ্য আমাকে পুষিয়ে দেয়। এখনও কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হয় আর আট ঘণ্টা থাকতে হয়। এটাই শুধু সম্মানে লাগে! কী করব, ডিগ্রি নেই যে আমার!’’
ডিগ্রি নেই বলে, হয়তো লক্ষ্মীর অভাব আছে ফিনলে-র ঘরে! কিন্তু, সেই ফিনলের ভরসাতেই লক্ষ্মীলাভের লক্ষ্যে বৃহস্পতিতে পৌঁছে গেল নাসা। সভ্যতার গুরুগ্রহ বৃহস্পতিকে জয় করল প্রায় অশীতিপর এক বৃদ্ধার হাত ধরেই! এই তরতাজা একুশ শতকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy