এভাবেই একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছে দুই কৃষ্ণগহ্বর। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দু’টি কৃষ্ণগহ্বর (ব্ল্যাকহোল) একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছে। এই প্রথম সেই ছবি ধরলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। গত কয়েক দশক ধরেই এই বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু তারা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এ বার দু’টি কৃষ্ণগহ্বরের একে অপরকে প্রদক্ষিণ করার ছবি তাঁদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, যারা পৃথিবী থেকে কয়েকশো কোটি আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই ছবি পাওয়ার ফলে গবেষণার ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা হবে।
কৃষ্ণগহ্বর আজও মানুষের কাছে রহস্যময়। তা নিয়ে দারুণ আগ্রহ বিজ্ঞানীদের। কল্পবিজ্ঞানে বার বার উঠে এসেছে এই কৃষ্ণগহ্বরের কথা। তা নিয়ে একাংশের মনে রয়েছে উদ্বেগও। কারণ, এই কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণ খুব বেশি। তাদের দিগন্ত দিয়ে কিছু গেলে তাকে গিলে খায় সেটি। এমনকি আলোকেও অনায়াসে খেয়ে ফেলতে পারে। আর সে কারণে কৃষ্ণগহ্বরকে কখনও দেখা যায় না। যদিও বিজ্ঞানীরা ঠিক তাকে ধরে ফেলেছেন। তার ছবিও তুলেছেন। এ বার প্রথম দু’টি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করার ছবিও তুললেন বিজ্ঞানীরা। আর তা সম্ভব হয়েছে উন্নত মানের প্রযুক্তির সাহায্যে। মনে করা হচ্ছে, দু’টি কৃষ্ণগহ্বর কী ভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, তা নিয়ে নতুন তথ্য পেতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। দু’টি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেলে প্রচুর শক্তি নির্গত হবে বলেও মনে করছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।
বিজ্ঞানীরা ছবিতে দেখেছেন, দু’টি কৃষ্ণগহ্বর ‘মহাজাগতিক নৃত্য’ (কসমিক ডান্স) করছে। উজ্জ্বল এক কোয়েজারের মধ্যে রয়েছে সেই কৃষ্ণগহ্বর, যার নাম ‘ওজে২৮৭’। কী এই কোয়েজার? আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডের একটি মহাজাগতিক বস্তু হল কোয়েজার। যখন ব্রহ্মাণ্ডে আলো ফোটেনি, তখনও ছিল সে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই বস্তু ‘থুতু’র মতো মহাকাশে ছেটাচ্ছে রাশি রাশি কণা। সেই কণাগুলি বেরিয়ে আসছে প্রায় আলোর গতিবেগে। জন্ম দিচ্ছে শক্তিশালী রেডিয়ো তরঙ্গের। এই কোয়েজার তৈরি হয় সাধারণত কোনও গ্যালাক্সি (ছায়াপথ)-এর কেন্দ্রে। আদতে যা দানবাকৃতি কৃষ্ণগহ্বর।
এ রকমই এক কোয়েজারের মধ্যে রয়েছে সেই দুই কৃষ্ণগহ্বর। ‘ওজে২৮৭’ কোয়েজারটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৫০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। ফিনল্যান্ডের টুর্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মওরি ভাল্টোনেন বলেন, ‘‘কোয়েজার ‘ওজে২৮৭’ এতটাই উজ্জ্বল যে, কোনও নবীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিজের টেলিস্কোপ নিয়েও একে দেখতে পাবেন।’’
এর আগে, আমাদের পৃথিবী যে ছায়াপথে রয়েছে, সেখানে একটি কৃষ্ণগহ্বর দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। মেসিয়ের ৮৭-এও একটি কৃষ্ণগহ্বরের হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু একে অপরকে এ ভাবে প্রদক্ষিণ করছে, এমন মহাজাগতিক দৃশ্য তাঁরা দেখতে পাননি। বিজ্ঞানী ভাল্টোনেন বিবৃতিতে বলেন, ‘‘ছবিতে স্পষ্ট ভাবে দু’টি কৃষ্ণগহ্বর দেখা যাচ্ছে, যেখানে তাদের অবস্থান আসলে প্রত্যাশিত ছিল।’’ তিনি আরও জানান, কৃষ্ণগহ্বর পুরোপুরি কালো বলে তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার চারপাশে উজ্জ্বল গ্যাস থাকলে তবেই তাকে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। ছবিতে আরও দেখা গিয়েছে, দু’টি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে যেটি ছোট, তার উৎসমুখটি (জেট) একটু মোচড়ানো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একে অনেকটা মহাজাগতির পুচ্ছের মতো দেখতে।
কৃষ্ণগহ্বর কী
খুব বেশি ভরের নক্ষত্রের ‘মৃত্যু’ হলে সেগুলি থেকে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হল নক্ষত্রগুলির ভর একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হতে হবে। বিজ্ঞানীদের মতে, যদি কোনও নক্ষত্রের ভর আমাদের সূর্যের ভরের ২০ গুণ বা তার বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে নক্ষত্রটির ‘মৃত্যু’ হলে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে। এই ধরনের নক্ষত্রের মৃত্যুর পরে সেটি ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে হতে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে। কৃষ্ণগহ্বরগুলিতে মহাকর্ষ বল এতটাই শক্তিশালী যে, এর মধ্যে দিয়ে আলোও বেরোতে পারে না। আলো বিচ্ছুরিত না-হওয়ার ফলে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের অত্যাধুনিক টেলিস্কোপেও এর ভিতরের বস্তু বিশেষ ধরা পড়ে না।