ধর্ম আফিম না নিপীড়িতের শেষ আশ্রয়? দু’শো বছর আগে এক জন বলেছিলেন, দুটোই। অবস্থা বিচারে এক এক রূপ ধর্মের। কিন্তু প্রশ্ন যখন ওঠে যে একটি বিশেষ সময়ে ধর্মের কোন রূপটি প্রধান, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয় বইকি। ধর্মের ভিতরে ঢুকে সেই আশ্রয়কে নিজেদের মতো গড়ে নেওয়া না কি এই আফিমকে সুযোগ মতো দূরে ঠেলা? মেয়েরা কি ধর্মের ভিতরে নিজেদের অবস্থানকে আরও সংগঠিত করবেন না কি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবেন তার দমবন্ধ করা দেবালয় থেকে মুক্ত আকাশের ধর্মচর্চায়।
ধর্মস্থানে মেয়েদের প্রবেশ নিয়ে বিধিনিষেধের ব্যাপারটা অনেক দিনের। সব ধর্মেই এই ব্যাধিটি রয়েছে। এই ব্যাধিটি নিরাময়ে মেয়েদের লড়াইও অনেক দিনের। সমান ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে বিতর্ক যে শুধু হিন্দু ধর্মেই আছে তা তো নয়। মক্কা-মদিনায় মেয়েরা মসজিদে প্রার্থনা করতে পারলেও মেয়েরা কাজি কিংবা ইমাম হতে গেলে গেল-গেল রব ওঠে। তা ছাড়া এখানে একসঙ্গে প্রার্থনার অধিকারও নেই, আমরা রেড রোডে যে বিরাট নমাজের ছবিটা দেখে বড় হয়েছি তাতে মেয়েদের কোনও ছবি আজও নেই। খ্রিস্টানদের মধ্যেও রোমান ক্যাথলিক বা একটু গোঁড়া ধারাগুলি মেয়েদের সন্ন্যাসিনী হয়ে ওঠা স্বীকার করলেও ধর্মের প্রবক্তা— প্রিস্ট থেকে বিশপ হয়ে উঠতে দিতে অনেক সময় নিয়েছে। শুধু মেয়ে নয়, পশ্চিমি দেশে কালো মানুষ ধর্মাচরণের দিক থেকে বহু বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমাদের দেশেও শুধু মেয়েরাই নন, নিচু জাতের মানুষ বহু মন্দিরে এখনও প্রবেশের অধিকার পান না, তাঁদের বিগ্রহের পুজো করতে তাঁরা ব্রাহ্মণ পান না। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় উঁচু জাত আর নিচু জাতের মানুষের গির্জা আলাদা।
মেয়েরা বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশে আহমেদনগরের শনি সিংনাপুর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পেলেন, আবার ও দিকে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় শবরীমালার আয়াপ্পার মন্দিরে কেন সব মেয়েরা প্রবেশের অধিকার পাবেন না, সেই ব্যবস্থা তো দেশের সংবিধানের পরিপন্থী— এই প্রশ্ন তুলে শবরীমালা মন্দির পরিচালন সমিতিকে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছে। মেয়েদের প্রবেশের অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তি যে আয়াপ্পার ব্রহ্মচর্যে ব্যাঘাত হতে পারে। কেরলের শবরীমালা মন্দিরে সম্ভাব্য ঋতুমতী মেয়েরা প্রবেশ করতে পারেন না— তাই দশ থেকে পঞ্চাশের মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। ঋতু নিয়ে এই সংস্কার— এই সময় মন্দিরে তো দূরস্থান, বাড়ির ঠাকুরঘরে ঢোকা যাবে না, এটা মেয়েদের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন, কারও চারশো তো কারও বেশি সময় ধরে এটাই ‘চলে’ আসছে। তখন মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতে তো স্ত্রীর একটা প্রতিশব্দ সহধর্মিণী, অর্থাৎ স্বামীর সঙ্গে সমান ভাবে ধর্মাচরণের অধিকারী, তা হলে তো যে ঐতিহ্যকে সাক্ষী মানা হচ্ছে, সেখানে মেয়েদের ধর্মের সমানাধিকার ছিল, এই সব নিষেধাজ্ঞা কবে জারি হল? মুম্বইয়ের বিখ্যাত হাজি আলি দরগার গর্ভগৃহে যেখানে পির হাজি আলি শাহ বুখারির মরদেহ শায়িত আছে সেখানে মেয়েদের যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন ভারতীয় মুসলিম নারী আন্দোলনের (বিএমএমএ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নুরজাহান নিয়াজ। হাজি আলির কবর পর্যন্ত মেয়েরা যেতে পারবেন না, যা নুরজাহান নিজে গিয়েছেন বলে স্পষ্ট মনে করতে পারেন। আর ১৪৩০ সাল নাগাদ এই হাজি আলি দরগা তৈরির পর গত ২০১২ সালের নভেম্বর অবধি মেয়েদের প্রবেশের অধিকার ছিল। এখনও দরগা-সংলগ্ন মসজিদে মেয়েরা প্রার্থনা করতে পারেন, শুধু দরগার তরফ থেকে বলা হয়েছে মেয়েদের ‘সুরক্ষার জন্য’ই প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা— মেয়েরা যদি হঠাৎ ঋতুমতী হয়ে পড়েন, অস্বস্তিতে পড়তে পারেন, ঝুঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পরনের পোশাক বেসামাল হয়ে গেলে লোভী পুরুষদের নজরে পড়তে পারেন ইত্যাদি। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬-র ২৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ ও প্রার্থনা করতে পারবেন। তবে মেয়েদের প্রবেশপথ পৃথক হবে কি না, মেয়েদের প্রবেশের জন্য কোনও পৃথক পরিকাঠামো প্রয়োজন কি না, সে সব বিচার করে হাজি আলি ট্রাস্টকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টকে জানাতে হবে। অবশেষে ২০১৬-র নভেম্বর মাস থেকে মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ করছেন।
সমান ধর্মাচরণের অধিকার অবশ্যই সমান অধিকারের দিকে, সমান স্বীকৃতির দিকে এগনোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি দাবি। অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ অবশ্য এখনও বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে বিষয়টি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়েছে। শবরীমালা মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ড যদিও সংবাদমাধ্যমে বলেছে, তারা ঋতুযোগ্য মেয়েদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারের পক্ষে, কিন্তু রায় এখনও আসেনি। বরং মামলাকারী ইয়ং লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, মন্দির বোর্ড, কেরল সরকার, সবাইকে পাঁচটি প্রশ্নমালা ধরিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তার উত্তর দিতে বলেছে। প্রশ্নগুলির কয়েকটি এ রকম: একটি লিঙ্গের জৈবিক একটি দিকের উপর ভিত্তি করে এই নিষেধাজ্ঞা কি ‘বৈষম্য’ এবং তা কি ধারা ১৪, ১৫ ও ১৭-র মূল ভাবনার বিরোধী? এটি কি ২৫ ধারা অনুযায়ী একটি ‘আবশ্যক ধর্মীয় আচার’? কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধর্মাচরণের স্বাধীনতার খাতিরে কি এ ধরনের দাবি তুলতে পারে? দেখা যাক, পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ কবে এ নিয়ে রায় দিতে পারে।
সমান ধর্মাচরণের অধিকার অবশ্যই সমান অধিকারের দিকে, সমান স্বীকৃতির দিকে এগনোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি দাবি। কিন্তু ধর্মাচরণের সমানাধিকার আমাদের বাস্তবে কত দূর সমান করতে পারে? দেশে-বিদেশে বহু প্রয়াস হয়েছে, হচ্ছে ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করার। সেই প্রয়াসকে শ্রদ্ধা জানিয়েও প্রশ্ন ওঠে, যা নিজে অসাম্যের ভিত্তি, তা দিয়ে কি আদৌ কখনও অসাম্যকে নিরসন করা যায়? আমরা কি কোনও দিন প্রভুর হাতিয়ার দিয়ে প্রভুর প্রাসাদ চূর্ণ করতে পারি? তা কি আদৌ সম্ভব? বিশেষত মেয়েরা সারা পৃথিবীতেই ধর্মে অনেক বেশি মতি রাখেন, কারণ মেয়েদের পৃথিবী এখনও অনেক বেশি ঘরের চার দেওয়ালকে আঁকড়ে, অর্থ-ক্ষমতা সব কিছুর নিরিখেই পরিবারের পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি অনিশ্চিত একটি পরিমণ্ডলে বাস করেন। ধর্ম হয়ে ওঠে অনেকের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। তাই অনেক মেয়ের কাছেই ধর্মাচরণের সমান অধিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? তাঁদেরকে আমরা তো অন্য কথা ভাবতে বলতে পারি। যদি আমরা মনে করি, ধর্ম বিষয়টার জন্মই হয়েছে সমাজের চলতি অসাম্য আর বিভেদের ভিত্তিকে অসহনীয় করে তোলার জন্যই, যা বলে মেয়েদের স্বর্গ স্বামীর পায়ের তলায় বা যা আমাদের একলব্যের গল্প এমন ভাবে গ্রহণ করতে শেখায় যাতে আমরা মনে করতে পারি যে একটি ব্যাধের ছেলে নিশ্চয়ই অর্জুনকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। তাই দ্রোণাচার্য তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল গুরুদক্ষিণা হিসেবে চাইলে কোনও অন্যায় নেই, অথবা মিশ্র বিবাহে সন্তান শূদ্র হবে— এই সব শিখে জাতপাত, নারী-পুরুষ ভেদ, এ রকম সব বৈষম্যকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করতে শেখায়। এ রকম অনেক পিছিয়ে পড়া চিন্তার আধার ধর্মগুলির মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত না রেখে আমরা নিজেরাই আমাদের পছন্দের স্থানে ঈশ্বরকে বসাই। মন্দির-মসজিদে প্রবেশে সমানাধিকারের জন্য সময় আর শ্রম ব্যয় না করে বরং পূজ্য ঈশ্বরকে পবিত্রতার সেই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বলি, বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও। সেই মুক্ত জগত হোক আমাদের দেবালয়!