কিরণ মজুমদার শ-এর গ্যারেজ থেকেই বায়োকন-এর পথ চলা শুরু।
শুরুটা হয়েছিল ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই কিরণ মজুমদার শ এখন ভারতের অন্যতম এক সেরা ব্যবসায়ী।
মেডিক্যাল পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর, কিরণ পেশাদার ‘ব্রিউমাস্টার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতে একের পর এক বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা যখন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে, তখনই কিরণ সিদ্ধান্ত নেন, নিজের ব্যবসা শুরু করবেন।
৩০ বছর পর, আজ কিরণ ভারতের সবথেকে বড় বায়োটেক কোম্পানি তথা এশিয়ার বৃহত্তম ইনসুলিন উৎপাদনকারী সংস্থা— ‘বায়োকন’-এর সিইও এবং চেয়ারম্যান। বর্তমানে সাত হাজারেরও বেশি কর্মচারী এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ওই সংস্থার লক্ষ্য, নতুন বছরে লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০০ কোটিতে নিয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে জৈব ওষুধ প্রস্তুতকারক সেক্টরেও নিজেদের প্রসার ঘটানো।
শুরুটা ১৯৭৮-এ। কিরণ মজুমদার শ-এর গ্যারেজ থেকেই বায়োকন-এর পথ চলা শুরু। প্রাথমিক ভাবে যে মুনাফা হত, তা দিয়েই ফার্মাসিউটিক্যাল ড্রাগ তৈরি এবং গবেষণার কাজ চলত। ধীরে ধীরে কোম্পানি জেনেরিক ওযুধ তৈরি করতে শুরু করে। মহিলা উদ্যোক্তা হওয়ার দরুণ, প্রথমে ব্যাঙ্ক তাঁকে লোন দিতে চায়নি। কিন্তু, নিজের লক্ষ্যে অটল ছিলেন কিরণ। সংবাদ মাধ্যম বিবিসি-কে দেওযা এক সাক্ষাৎকারে কিরণ বলেছিলেন, ‘‘যে কোনও উদ্যোক্তাকেই প্রাথমিক ভাবে ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সেই ব্যর্থতা সামাল দিতে পারলেই পাওয়া যায় সাফল্যের স্বাদ।’’
বায়োকন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বায়োকনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা গ্রামগুলির মানুষদের ক্লিনিক্যাল কেয়ার, বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও ওষুধের জন্য তিনি ‘মাইক্রো ইনসিওরেন্স’ নামে একটি কমিউনিটি গড়ে তুলেছেন। ক্যানসার আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা আরও সহজ ও সুবিধাজনক করে তুলতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘মজুমদার শ ক্যানসার সেন্টার’। তাঁর মতে, উদ্ভাবন এবং ব্যবসাই সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার, যা পরবর্তী সময়ে কোনও দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও সাহায্য করে।
আরও পড়ুন: একটা সময়ে সাত-আট ঘণ্টা টানা প্র্যাকটিস করতাম
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর জীবন ও সংস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। কোন নতুন ভাবনার ক্ষমতা কতটা, মহিলা হওয়ায় তাঁকে কোন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কী ভাবে তাঁর সবথেকে বড় ব্যর্থতাকে জীবনে সাফল্যের চাবিকাঠি বানালেন, সবই তুলে ধরেছিলেন তাঁর সাক্ষাৎকারে।
আপনার সবথেকে বড় ভাবনাটি কী যা নিয়ে অন্য মানুষ চিন্তা করে না বা সহমত হয় না? কেনই বা সেটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমার ভাবনা হল দুরারোগ্য ব্যধিগুলির জন্য কম খরচায় সহজলভ্য থেরাপির উদ্ভাবন করা। আমি চাই সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ যাতে সহজ ভাবে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে পারে সেই বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে।
চড়া দামের জন্যে বর্তমানে বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই ওষুধ ব্যবহার করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, আমাদের এত প্রচেষ্টা এবং নতুন ভাবনার কারণ কী? যখন সেই সমস্ত মানুষই ওষুধ ব্যবহার করতে পারছে না, যাদের তা সর্বাধিক প্রয়োজন। কোনও গবেষণার ফলাফল তখনই সার্থক হয়, যখন তা সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছয়।
আমার জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল নতুন ভাবনা-চিন্তার এমন একটি মডেল তৈরি করা, যার ফলে মানুষের কাছে সহজ ভাবে ওষুধ পৌঁছে যাবে। আমি পশ্চিম বিশ্বের ফার্মাসিউটিক্যাল মডেলকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। যার ফলে আমি কম খরচে জীবনদায়ী ওষুধের একচেটিয়া বাজার তৈরি করতে পেরেছি। বায়োকন-এ সেই ধরনের ভাবনার উদ্ভাবনের উপর জোর দেওয়া হয়, যাতে এমন ওষুধ তৈরি করা যায়, যা মানুষের কাছে সহজলভ্য।
আরও পড়ুন: সমাজের কঠিন মুখ দেখেও সেখান থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে হবে
আপনার সাফল্যের নেপথ্যে কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব কাজ করে?
আমি বিশ্বাস করি, যতই কঠিন সময় আসুক না কেন, কখনই হাল ছাড়া উচিৎ নয়। আমার মতে, ব্যর্থতা অস্থায়ী কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই সব শেষ।
আমার বয়স, লিঙ্গ এবং সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসায়িক মডেলের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রাথমিক ভাবে যে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেগুলিই আমায় শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এগুলিই আমাকে সাহায্য করেছে বায়োকন-কে সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে।
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য আপনি যদি কোনও পরিবর্তন করতে চান, তবে তা কী হবে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মাতৃত্ব পরবর্তী সময়ে মহিলাদের আরও বেশি করে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। তা হলেই পরিবর্তন সম্ভব। এর জন্য আমাদের কর্মক্ষেত্র, বাড়ি ও পরিবারের বেশ কয়েকটি জিনিসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কাজের জায়গায় কর্মচারীদের শিশু এবং তাদের পরিবারের জন্য ভাল পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলে বিষয়টি আরও সহজ হবে। এমন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে যাতে মাতৃত্বের পরও মহিলারা কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে কোনও রকম দ্বিধাবোধ না করতে পারেন।
সম্প্রতি ভারতে মাতৃত্বকালীন বিলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করা হয়েছে।ঋতুস্রাব চলাকালীন মহিলাদের দু’দিনের বেতনভিত্তিক ছুটি দেওয়া নিয়ে সংসদে আরও একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে। কোম্পানিগুলির অভ্যন্তরীণ বিধিগুলির আওতায় এই সমস্ত বিষয়গুলি সঠিকভাবে নিয়ে এলে পরিবর্তন সম্ভব।
কর্মজীবনের শুরুতে আপনার এমন কোনও বিষয় ছিল, যা আপনার আগে থেকে জানা ছিল। অথবা এমন কিছু, যা আপনি জানতেন না বা বিশ্বাস করতেন না?
১৯৭০-এ আমি ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজে কোনও মহিলাকে ব্যবসা শুরু করার দরুন যে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে হবে, তা আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আমার অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস ছিল যে, জ্ঞান কখনও লিঙ্গভিত্তিক হতে পারে না। কোনও মহিলা যদি সত্যিই মন থেকে কিছু করতে চায়, তবে সে সফল হবেই।
কর্মজীবনের কোন সময়টাতে আপনি সব থেকে বেশি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন? ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপনি কোন পথ বেছে নেন?
১৯৭০ সালে মাস্টার্সের পরে আমি চাকরির খোঁজে ছিলাম। সেই সময়টাই ছিল সবথেকে হতাশজনক। নারী হওয়ার কারণে, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও আমি চাকরি পাইনি। আমাকে বলা হয়েছিল পুরুষশাসিত এই ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলাদের জন্য কোনও স্থান নেই।
যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু হার মানিনি! চাকরি খোঁজা ছেড়ে দিয়ে জৈবপ্রযুক্তি সেক্টরে আমি আমার নিজের কোম্পানি শুরু করি। সেটিই এখন ভারতে বৃহত্তম এনজাইম কোম্পানি তথা এশিয়ার বায়োটেকনোলজি কোম্পানিগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে।
সাফল্যের অন্যতম মূল চাবিকাঠি হল, কর্মক্ষেত্রে পেশাদার সম্পর্ক তৈরি করা। সহকর্মীদের সঙ্গে এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে আপনি কী কী করেছিলেন?
যে কোনও সফল ব্যবসার নেপথ্যেই রয়েছে শক্তিশালী ব্যক্তিগত ও পেশাদার সম্পর্কের ভিত। কখনও কখনও ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি পেশাদার সম্পর্কের রূপ নেয়।
আমি বিশ্বাস করি, সহকর্মীদের ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব যখন তাদের, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়। মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্যই হোক কিংবা কর্মক্ষেত্রে বিশ্বাসের বাঁধন তৈরি করা, এটি একটি দুর্দান্ত উপায়।
আপনার জীবনে কোনও ব্যক্তির কাছে থেকে পাওয়া সেরা উপদেশ কী?
আমার বাবা আমার জীবনের সব থেকে সেরা উপদেশ দিয়েছিলেন। স্কুল শেষের পরে আমি চেয়েছিলাম ডাক্তার হতে। কিন্তু ভাল নম্বর না থাকায় আমি মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার সুযোগ পাই নি। আমি ভেবেছিলাম, আমার অনেক বন্ধুদের মতো আমার বাবাও টাকা দিয়ে আমার জন্য সিট বুক করে রাখবেন। যদিও বাবা তা করেননি। বরং তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমায় পড়াশোনার জন্য সবথেকে সেরা স্কুলে পাঠানো সত্ত্বেও তুমি মেডিক্যাল স্কুলে সুযোগ পাওনি কারণ, তোমার পড়াশোনায় খামতি ছিল। টাকা-পয়সা, অর্থ, অনুকুল পরিস্থিতি বা পক্ষপাতের জন্য নয়, বরং অর্থ হল এমন জিনিস যা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব’’।
সেই দিন আমার জীবনের সব থেকে বড় শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম।
এমন একটি জিনিস যা পুরুষরা করতে পারে মহিলাদের জন্য, সেটা কী বলে আপনার মনে হয়?
আমার মনে হয়, পুরুষদের উচিৎ নারীদের দুর্বল মনে না করা এবং নারীদের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ না রাখা। পুরুষদের কখনওই অনুমান করা উচিৎ নয় যে মহিলারা কিছু কিছু জিনিস কখনওই পেতে পারেন না। বরং তাদের উচিৎ পুরনো সংশয়বাদী ধারণা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা।