ঋতুবন্ধে শেষ নয় যৌবন, সচেতনতার ডাক শহরে

কুঁজো বুড়ির গল্প অনেকেই শুনেছে। কিন্তু বুড়ি কেন কুঁজো হল, তা নিয়ে আর কে-ই বা ভাবে! 

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৮
Share:

কুঁজো বুড়ির গল্প অনেকেই শুনেছে। কিন্তু বুড়ি কেন কুঁজো হল, তা নিয়ে আর কে-ই বা ভাবে!

Advertisement

ঋতুবন্ধের পরে মাত্রাতিরিক্ত হাড় ক্ষয়ে যায় বহু মহিলার। পঞ্চাশ পেরোতে না পেরোতেই অস্টিওআর্থারাইটিসে পঙ্গু হয়ে যান অনেকে। অনেকে দুলে দুলে হাঁটতে বাধ্য হন আর অনেকের দেহ বেঁকে যেতে থাকে ধনুকের মতো। আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। কাজের গতিরোধ হয়। তবু নারীস্বাস্থ্যের ব্যাপারে চিরকালীন সামাজিক ঔদাসীন্য বহাল। ঋতুবন্ধ হওয়া প্রজনন-অক্ষম, গতযৌবনা নারীতে আরও অপাংক্তেয়।

অতএব, ‘মেনোপজ’ বা ঋতুবন্ধের পরে যেমন শারীরিক সমস্যায় নারী জর্জরিত হন, তেমনই পারিবারিক-সামাজিক অবহেলা, অমনোযোগ, অশ্রদ্ধা তাঁকে মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত করে। এ দেশে যতটুকু সচেতনতা বা প্রচার ঋতুকালীন সমস্যা নিয়ে রয়েছে, তার প্রায় কিছুই ঋতুবন্ধের সমস্যা নিয়ে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতেও পরিস্থিতি যে খুব ভাল নয়, সে কথা উঠে এসেছিল সম্প্রতি এ শহরে ‘ভারতীয় মেনোপজ সোসাইটি’ আয়োজিত আলোচনাসভায়। ভারত-সহ মোট ছ’টি অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরাই স্বীকার করেছেন, নারী ঋতুমতী হওয়া মানে যৌবনবতী হওয়া। তাঁর তখন সৌন্দর্য রয়েছে ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে সমাজে তিনি ‘মূল্যবান’। ভারতের একাধিক প্রদেশে মেয়েরা প্রথম ঋতুমতী হলে প্রায় বিয়ের মতো উৎসব হয়। ঋতুবন্ধ মানে নারীর দর কমে যাওয়া! ‘‘এই আজন্মলালিত বিশ্বাস বহু নারীর ভিতরেই এমন ভাবে প্রোথিত যে, মেনোপজের পরে অনেকে বলেন, ‘নিজেকে অদৃশ্য মনে হয়। আগের মতো কেউ তারিফের চোখে তাকায় না।’ এঁদের নিরাপত্তাহীনতার মাত্রাটা ভেবে দেখুন,’’ বলছিলেন আন্তর্জাতিক মেনোপজ সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল, ইংল্যান্ডের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নিকোলাস প্যানি। তিনি বলেন, ‘‘ইংল্যান্ডেও মেনোপজ নিয়ে বিস্তর ‘ট্যাবু’ রয়েছে। মেনোপজের সঙ্গে বয়স হয়ে যাওয়া, দেখতে খারাপ হয়ে যাওয়া, সঙ্গীর কাছে আকর্ষণ হারানোর মতো দুশ্চিন্তা বহু মহিলাকে চূড়ান্ত অবসাদ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলছে। তাঁরা বাড়াবাড়ি রকম হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ট্যাবলেট বা নেশার দ্বারস্থ হচ্ছেন। চিকিৎসকেরা অনেকেই ঋতুবন্ধ হওয়া মহিলার শারীরিক সমস্যার ঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে সচেতন নন।’’

Advertisement

বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন প্রবীণ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শাহলা খাতুন। তিনি জানালেন, নব্বইয়ের দশকে যখন কিছু অনুষ্ঠানে মেনোপজ নিয়ে আলোচনা করতেন, তখন অনেকে চোখ কপালে তুলে বলতেন, ‘‘এই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে কী করে!’’ জানালেন, এখনও তাঁর দেশে, প্রধানত গ্রামীণ এলাকায় অনেক মেয়েই স্বামীর কাছে কদর কমে যাওয়ার ভয়ে ঋতুবন্ধের কথা লুকোন।

শ্রীলঙ্কার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মঙ্গল দেশনায়কে বলেন, ‘‘ঋতুবন্ধের আগে ও পরে মেয়েদের শ্বাসকষ্ট, গরম লাগা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, যোনি শুষ্ক হওয়া, হাড় ভঙ্গুর হওয়ার সমস্যা হয়। ঋতুবন্ধের বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে শ্রীলঙ্কার অনেকে কষ্টের কথা বলেন না। ডাক্তার দেখান না। স্বামীকেও বলেন না।’’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ স্টিভেন গোল্ডস্টেইন আন্তর্জাতিক মেনোপজ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বহু মহিলার কাছে মেনোপজ মানে নিজের ‘মূল্য’ হারিয়ে যাওয়া। এটি মেয়েদের যৌবন শুরু ও শেষ হওয়ার একটি চাক্ষুষ চিহ্ন। যেটা পুরুষের নেই। তাই মেনোপজের সঙ্গে বুড়ো হওয়ার ধারণাটা মেয়েদের মানসিক ভাবে ধাক্কা দেয়। এই সময়ে তাঁদের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার যে ব্যবস্থা সরকারি ভাবে হওয়ার কথা, তা আমেরিকায় হয় না।’’

ভারতবর্ষেও অবস্থাটা আশাপ্রদ নয়। ভারতীয় মেনোপজ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট রত্নাবলী চক্রবর্তী জানান, সংসার, কাজকর্ম, ছেলেমেয়ের অজস্র ঝড়ঝাপ্টা সামলে জীবনের মধ্যপর্বে এসে মেয়েদের একটু দম ফেলে থিতু হওয়ার কথা। তখন সে অনেক পরিণত, পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। অনেকেই তাঁর উপরে নির্ভরশীল। ঠিক তখনই মেনোপজ নতুন সঙ্কট আনে। আত্মবিশ্বাস টলিয়ে দেয়। তাঁর কথায়, ‘‘চল্লিশের পরেই ঠিক খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম, জীবনযাত্রা ও কাউন্সেলিং মেনোপজ-জনিত শারীরিক ও মানসিক সমস্যা অনেক নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে না আছে সচেতনতা, না ছিল সরকারি কর্মসূচি।’’ সম্প্রতি কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রক কিছুটা এগিয়ে এসেছে। চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের নিয়ে কলকাতা-সহ বিভিন্ন শহরে নিখরচায় যোগ শিবির আয়োজন করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও আলাদা মেনোপজ ক্লিনিক নেই।

এই দেশেরই রাজস্থানে একটি জনজাতির মধ্যে ঋতুবন্ধ হওয়া নারী হন পরিবারের প্রধান। একাধিক গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, প্রাণিজগতে মেয়ে কিলার হোয়েলের মেনোপজ হয় এবং তারাই হয় দলের প্রধান পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকর্তা। আলোচনাসভা বার্তা দিল, ‘মিডল ইউথ’-এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে মেনোপজের মোকাবিলায় দুনিয়ার মহিলারা এক হোন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন