পথে নামার অপেক্ষায়। — নিজস্ব চিত্র।
এক মাসও চালাতে পারবি না!
আর ক’দিন যাক, ভিক্ষে করে খেতে হবে!
বিদ্রুপ শুনে ওঁরা পিছিয়ে যাননি। বরং একবগ্গা হয়ে বলছেন, আমরা পারব।
আপাতত ন’জন। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে যাঁরা খুঁজে পেয়েছেন নতুন আত্মবিশ্বাস। আর কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতার পথে মহিলা সওয়ারি নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন স্মৃতি-সুনীতা-অর্চনা-রীতারা। মহিলা যাত্রীদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে মহিলাচালিত ট্যাক্সি বা অটোর কথা শোনা গিয়েছিল আগেই। কলকাতা শহরে এমনটা হতে চলেছে এই প্রথম। আপাতত ওঁরা মহিলাদের জন্য মহিলা শোফার হয়ে কাজ শুরু করছেন। ক্রমশ বাণিজ্যিক ভাবে ট্যাক্সি পরিষেবার কাজেও যুক্ত হবেন।
ওঁদের সঙ্গে আছেন আরও ১৩ জন। ধাপে ধাপে ট্রেনিং শেষে রাস্তা দাপাবেন ওঁরাও। বয়স ২০-৩৫। বেশির ভাগেরই দোহারা চেহারা। ছোটখাটো গড়ন। প্রথমে দেখে একটু অবাকই লাগে। কিন্তু কথা বলতেই ভুল ভাঙে। গত বছরের জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল প্রশিক্ষণ। শুধু গাড়ি চালানো শিখলেই তো হবে না। পথে নামার ঝুঁকি হাজারো। তাই আত্মরক্ষার ট্রেনিং থেকে শুরু করে ফার্স্ট এড-এর প্রশিক্ষণ— ওঁরা শিখছেন সবই।
কলকাতার আঁতিপাতি চেনা? দমদমের সুনীতা মুন্ডার সাফ জবাব: ‘‘সব চিনি না। চালাতে চালাতে চিনে নেব।’’
সুনীতার থেকে বয়সে কিছুটা বড় অর্চনা মণ্ডলের গলাতেও এক সুর। বিবাহিতা, সন্তানও রয়েছে। সে সব ছেড়ে এই রকম একটা পেশায় এলেন? বর আপত্তি করেননি? শান্ত চোখে অর্চনা বলেন, ‘‘প্রথমে করেছিল। বুঝিয়েছি অনেক। ছ’মাসের উপর হয়ে গেল শিখছি।’’
জয়নগরের রীতা সর্দারের আবার প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল গাড়ি চালানো শেখার। কিন্তু ভয় করত। সেই মেয়ে এখন বলেন, ‘‘ভয় পেলে এগোব কী করে? প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও মা ভরসা দিত।’’ স্বামী নেই। ছেলের বয়স তিন। ‘‘ছেলে যেন বলতে পারে, মা সম্মানের সঙ্গে কাজ করে। সাহস সেখান থেকেই জোটে,’’ চটপট বলে যান বছর ছাব্বিশের রীতা।
কিন্তু রাস্তায় নামলে আরও যে সব ভয়? নিজেকে বাঁচাবেন কী ভাবে?
রীতার বোন জ্যোৎস্নাও নিচ্ছেন এই প্রশিক্ষণ। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ছেলেরা পারলে মেয়েরা পারবে না কেন? মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের কাজটা করে যেতে পারলেই হল।’’ দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মায়ের সঙ্গে রাজারহাটে একাই থাকেন। নিজের পায়ে দাঁড়ালে মায়ের থেকে খুশি আর কেউ হবেন না।
কিন্তু রাস্তায় পুরুষচালকরা উত্যক্ত করলে?
সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে— বিপদে পড়লে কী ভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘‘পুরুষ চালকদের কু-মন্তব্যে কান দেওয়ার দরকার কী! হাসিমুখে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে সব চেয়ে ভাল পথ,’’ বলছেন ওঁরা। ‘‘নিজেকেই বুঝতে হবে কোন মানুষ কেমন। সুবিধের নয় মনে হলে কথা বাড়ানো একদম চলবে না,’’ বুঝিয়ে দিলেন জ্যোৎস্না। কিন্তু পরিস্থিতি অত সহজ যদি না হয়? তার জন্য শারীরিক প্রশিক্ষণও চলছে জোর কদমে। মার্শাল আর্ট-নাচ যেমন রয়েছে, তেমনই স্পোকেন ইংলিশ, রাস্তার ম্যাপ বুঝিয়ে বাড়ানো হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। ‘‘গাড়ি চালাতে চালাতে যে সব অভিজ্ঞতা হবে, সেগুলো থেকে শিখে নেব আরও কিছু,’’ বললেন নবনীতা পাল। বয়স বাকিদের তুলনায় কিছুটা কম। কিন্তু উদ্যমে ফুটতে ফুটতে লেক গার্ডেন্সের মেয়ে বলছেন, ‘‘সবাই চিনবে। আলাদা একটা পরিচয় হবে।’’ বাবার মুদি দোকান। ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে। বাড়িতে মানবে? ‘‘প্রথমে ভয় পেয়েছিল বাবা। আমি যখন প্রথম রাস্তায় একা হাঁটা শুরু করলাম, তখনও তো ভয় পেত। এখন কি পায়?’’
কিন্তু সকলের রাস্তা এত মসৃণ নয়। ওঁদের পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আজাদ ফাউন্ডেশন। সংস্থার তরফে দোলন গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বাড়ি
বাড়ি গিয়ে বোঝাতে হয়েছে। কোথাও মা রাজি তো বাবা নন। কোথাও মা-বাবা রাজি তো বেঁকে বসলেন প্রেমিক! অনেকে প্রশিক্ষণ শুরু করেও বন্ধ করে দিলেন।’’
তবু যে শেষ অবধি মহিলা চালকরা শহরের রাস্তায় নামছেন, সেটাই অবশ্য আশার কথা। বাণিজ্যিক ভাবে লাইসেন্স পেতে আরও এক বছর সময় লাগবে। তার আগের এই সময়টা ওঁরা কোনও মহিলার ব্যক্তিগত চালক বা সংস্থার হয়ে চালাবেন। পরবর্তীকালে কাজে নিযুক্ত হতে ওঁদের সাহায্য করবে সখা সার্ভিসেস (বিভিন্ন শহরে মহিলাচালিত ট্যাক্সি পরিষেবা দিয়ে থাকে এই সংস্থা)।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি এই উদ্যোগের নাম দিয়েছে ‘উইমেন অন হুইলস’ বা সংক্ষেপে ‘ওয়াও।’ এ বার শুধু এগিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।