হুইলচেয়ার ছেড়ে যোগে জোর হারকিউলিসের

হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতে পারতেন না। এখন নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। শেখাতে চান অন্যকেও। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ডেভিড থেরনার লড়াইয়ের গল্প বললেন আরিফ ইকবাল খানপুরো নাম ডেভিড জারি থেরনা। বয়স ৭৪ বছর। আদতে মেঘালয়ের শিলঙের বাসিন্দা। বহু বছর আগে পাহাড়ি মানুষটা কলকাতায় এসেছিলেন। শিখেছিলেন যোগ এবং শরীরচর্চা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৮ ০১:৫০
Share:

পকেট-হারকিউলিস: সত্তরেও ছুঁতে পারেনি বার্ধ্যক্য। নিজস্ব চিত্র

অনেক রূপ ডেভিডের। স্বল্প উচ্চতার মানুষটিকে হলদিয়ার মানুষজন ‘পকেট হারকিউলিস’ বলে ডাকেন। খাটো উচ্চতার মানুষ। কিন্তু সারা শরীরের পেশিগুলো সুগঠিত। শরীরচর্চার ফল। সুঠাম চেহারার জন্যই এমন নাম। এমন পেশিবহুল মানুষটিই আবার বস্তির ছেলে মেয়েদের কাছে ‘সান্তা ক্লজ’এর মতো। আরেকটি রূপ আছে ডেভিডের। হার না মানা ডেভিড। হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যোগ শেখান তিনি। শেখানোর জন্য বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে বেড়ান।

Advertisement

পুরো নাম ডেভিড জারি থেরনা। বয়স ৭৪ বছর। আদতে মেঘালয়ের শিলঙের বাসিন্দা। বহু বছর আগে পাহাড়ি মানুষটা কলকাতায় এসেছিলেন। শিখেছিলেন যোগ এবং শরীরচর্চা। তারপর একসময়ে শরীরচর্চার কৌশল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন হলদিয়ায়। শরীরচর্চাতেই এসেছিল সাফল্য। ১৯৬২ সালে একটি প্রতিযোগিতায় যোগকুমার হন তিনি। আর ১৯৮০ সালে বডি বিল্ডিংয়ে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ হন। একই সঙ্গে যোগ আর বডি বিল্ডিংয়ে পারদর্শিতার জন্য ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।

কিন্তু ডেভিডের জনপ্রিয়তা শুধু শরীরচর্চার কারণে নয়। তাঁর ‘সান্ত ক্লজ’ রূপের জন্যও। নব্বই এর দশকের দিকে হলদিয়ায় এসেছিলেন এই পাহাড়ি মানুষটি। দুর্গাচকের একটি ক্লাবে দীর্ঘদিন ধরেই জিম প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন। এক সময়ে দুর্গাচকের বস্তির ছেলে মেয়েদের যোগ আর শরীরচর্চা করিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে সেই কাজ। তাঁদের জিমন্যাস্টিক শিখিয়েছেন। কিন্তু জানতেন, খালি পেটে শরীরচর্চা হয় না। তাই নিয়মিত টিফিনের ব্যবস্থা করতেন। ব্যবস্থা করতেন পোশাকেরও। কলকাতা থেকে ঘাড়ে করে বয়ে আনতেন পোশাকও। এখন তাঁর সেই ছাত্র ছাত্রীরা বড় হয়ে গিয়েছেন। ডেভিডের এই মানবিক মুখটি কাছ থেকে দেখেছেন আমির আলি। তিনি বলেন, ‘‘বস্তির ছেলে মেয়েদের শুধু অনুশীলন করালেই হবে না। ওদের পেট ভরে খাওয়ার দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ডেভিড।’’ এখন বস্তির ছেলে মেয়েদের শেখানো হয় না। কিন্তু ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য এখনও তিনি ২৫ ডিসেম্বর ভরা ঝোলা নিয়ে হাজির হন। সেই ঝোলায় থাকে জামা কাপড়। এমনকী দাঁত মাজার ব্রাশ এবং টুথপেস্টও। তাঁর কথায়, ‘‘দাঁত না মাজলে শরীর ভাল থাকবে কী করে!’’ তবে বাচ্চাদের জন্য তাঁর উপহারের বিষয়ে তেমন কিছু বলতে চান না। শুধু বলেন, ‘‘বাচ্চাগুলো আমার কাছে ঈশ্বরের মূর্তি। ওদের মুখে হাসি দেখলেই সব দুঃখ ও যন্ত্রণা ভুলে যাই।’’ একসময়ে সিটি সেন্টার ও দুর্গাচকেও নিজের জিম খুলেছিলেন ডেভিড।

Advertisement

কিন্তু কর্মঠ এই মানুষটিই একসময়ে হুইলচেয়ারে বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন। একাধিকবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেভিড। চলতে ফিরতে পারতেন না। ২০১৬ সালে কলকাতার বিভিন্ন স্নায়ুরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি থাকতে হয়েছিল। সেই সময় সকলে ভেবে নিয়েছিলেন ডেভিড আর দাঁড়াতে পারবেন না। সেখান থেকেই পাহাড়ি মানুষটা জেদ আর হার না মানা মানসিকতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এখন মোটর বাইক চালাতে পারেন। স্কুলে স্কুলে যাচ্ছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দেন, যোগ শেখাবেন তিনি। স্কুল ব্যবস্থা করলে তিনি বাড়ি থেকে ম্যাট এনেও শেখাবেন। এর জন্য কোনও অর্থ নেবেন না। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে শুধু স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোই তাঁর লক্ষ্য। আর ছাত্র ছাত্রীদের বলেন, ‘‘সব কাজ ফেলে শরীরটা দেখো। শারীরিক পরিশ্রম করো। এক্ষেত্রে যোগ সবচেয়ে ভাল অভ্যাস।’’

এমনই যোগ দিবসের আগে হলদিয়ার একটি স্কুলে হাজির হয়েছিলেন ডেভিড। ওই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক সঞ্জয় শোভন মান্না ডেভিডের মনের জোর দেখে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ডেভিড স্যরকে দেখে অনুপ্রাণিত। গরমের ছুটির কারণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি। পরে যোগের ব্যবস্থা করা হবে। এমন একজন মানুষকে কাছ থেকে ছেলে মেয়েরা অনুপ্রাণিত হতে পারবে।’’

ডেভিড বর্তমানে হলদিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জিম ইনস্ট্রাক্টর। কলেজের পরিচালন কমিটির সম্পাদক আশিস লাহিড়ী বলেন, ‘‘ডেভিড এই বয়সেও যে প্রাণশক্তি ধরেন তা দৃষ্টান্তমূলক। শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার পর উনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। উনি আবার নতুন করে ফিরে এসেছেন। তাই আমরা আবার এই বয়সেও তাঁকেই চাকরি ফিরিয়ে দিয়েছি।’’ আশিসবাবু আরও জানিয়েছেন, পূর্ব মেদিনীপুরে তাঁরাই প্রথম মাল্টিজিম করেন। সেই জিম তৈরি করা থেকে নানা সাহায্য পেয়েছেন এই গুণী মানুষটির কাছ থেকে। এই মুহূর্তে ২৫০ ছেলে মেয়ে এই জিমে ডেভিডের কাছে প্রশিক্ষণ নেন বলে আশিস জানালেন।

ডেভিড দুর্গাচকের একটি ভাড়া বাড়িতে একাই থাকেন। বড় মেয়ে মার্গারেট ভিনসেন্ট থাকেন নিউজিলান্ডে। ছোট মেরি থেরনা থাকেন বেঙ্গালুরুতে। বর্তমানে তাঁর দু’টি জিম বন্ধ। ডেভিড বলেন, ‘‘আগে কত ছেলে মেয়ে আসত। এখন আর তাদের শরীরচর্চায় মন নেই। স্মার্ট ফোন আর প্রচুর পড়ার চাপের কারণেই তারা সময় পাচ্ছে না।’’ হৃদ্‌রোগের পর কথা মাঝে মাঝে জড়িয়ে যায়। আর কিছু সমস্যা নেই ডেভিডের। এখনও দিনে ৬-৭ ঘণ্টা ব্যায়াম করেন। ডেভিড জানান, তিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে বলেছেন পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পরও কেমন ভাবে ফিরে এসেছেন। যোগ করলে কাজে দেবে। ঝরঝরে বাংলা বলতে পারেন ডেভিড। বলেন, ‘‘প্রতি বছর বড়দিনে মনে হয় ফিরে যাই খাসি পাহাড়ে আমার জন্মস্থানে। কিন্তু আর ফেরা হয় না। এই মাটিকে ভালবেসে ফেলেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন