চিপকের রং বদল। হগের টাইট বোলিংয়ে আটক সিএসকে। দলকে ভাল শুরু দিতে ব্যর্থ গম্ভীর। শেষ হাসি চেন্নাইয়ের। ছবি: বিসিসিআই।
রাত বারোটার এম এ চিদম্বরম স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স রুমে কোনও কেকেআর সমর্থক থাকলে, কান নিঃসন্দেহে অপমানে ঝাঁ-ঝাঁ করত! দুলকি চালের ডোয়েন ব্র্যাভোকে যে ঢুকতে দেখা যাবে, প্রত্যাশিত ছিল। তিনটে উইকেট নিয়েছেন। একটা দুর্ধর্ষ ক্যাচ। কেকেআর ব্যাটিংয়ের ‘মৃত্যুতে’ কোনও না কোনও ভাবে ভূমিকা থেকে গিয়েছে তাঁর হাতের, ম্যাচের সেরাও তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবা যায়নি। তিনি আসবেন না তো আর কে আসবেন? কিন্তু ‘সিএসকে খুব বিনয়ী টিম’ বলে-টলে যে মন্তব্যটা করে বসলেন, বেশ অপ্রত্যাশিত। “কেকেআর বোলিংটা খুব ভাল। কিন্তু ব্যাটিংয়ের কী দশা, আমরা আজ ভাল করে বুঝিয়ে দিলাম!”
তর্ক উঠতে পারে, একটা আইপিএল চ্যাম্পিয়ন টিমের ব্যাটিং সর্ম্পকে এমন মন্তব্য কোন সাহসে করা যেতে পারে। ব্যাটিংয়ের আচমকা ভরাডুবি গম্ভীরের কেকেআরে নতুন কিছু নয়। আর সাত ম্যাচে তিন জয়ের বিপদসঙ্কুল প্রেক্ষাপটও যথেষ্ট চেনা। গত বারও এমন অতলস্পর্শী খাদে পড়তে পড়তে স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে কেকেআর টানা ন’টা ম্যাচ জিতে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মণীশ পাণ্ডে-ইউসুফ পাঠান-রবিন উথাপ্পা-গৌতম গম্ভীর সমৃদ্ধ কেকেআর ব্যাটিং এক বছর আগে সমস্ত বোলিংকে একটা সময়ের পর ছিন্নভিন্ন করে ছেড়েছে। দু’শো করেও প্রতিপক্ষ দেখেছে, ম্যাচ নিয়ে যাচ্ছে কেকেআর। তা হলে?
মুশকিল হল, ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডারের মন্তব্যকে নখদাঁত বার করে আক্রমণ করাও যাবে না। একশো কুড়ি বলে যদি কেউ ১৩৫ তুলতে না পারে, পাঁচ ওভারে ৫২ রেখেও যদি ম্যাচ হারে দু’রানে, প্রতিপক্ষ তো তড়পাবেই। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটেও দেবে। একশো বার দেবে।
এবং সেটা সহ্যও করতে হবে।
লং অফ বাউন্ডারি দিয়ে ম্যাচের শেষ বলটা পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও দেখা গেল পিচের উপর বসে পড়লেন রায়ান টেন দুশখাতে। দরকার ছিল ছয়। এসেছে চার। তিন বলে সতেরো চাই, সেখান থেকে যদি কেউ দু’রানে হারে তার পিঠ চাপড়ানিই পাওয়া উচিত। কিন্তু টার্গেট যদি কুড়ি ওভারে দু’শো থাকে, তা হলে পাওয়া উচিত। সহজ ম্যাচ কঠিন করে ম্যাচ হারলে সেটা প্রাপ্য নয়। দুশখাতেকেও তাই দেওয়া যাচ্ছে না। শেষ দিকে তেড়েফুঁড়ে উঠেছিলেন বলে ব্যবধানটা কমল, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু যে কেকেআর আদায় করতে পারবে না সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ব্র্যাভো শেষ বলটা করতে যাওয়ার আগে থেকেই যাচ্ছিল।
১৩৫ টার্গেটে শেষ দু’ওভারে তিরিশের দরকার পড়বে কেন? ৫২-১ থেকে ওটা ১১৬-৯ হবে কেন? কোনও মিচেল স্টার্ক নেই চেন্নাই বোলিংয়ে। কোনও ইমরান তাহিরও নেই। তা হলে? কোন যুক্তিতে?
এক কথায়, ব্যাখ্যাতীত ব্যাটিং। কেকেআর সমর্থকরা উইকেটকে দোষ দিতে পারেন। বলতে পারেন, এমন উইকেট টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পরিপন্থী। কিন্তু সেটাও সর্বাত্মক ভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হবে না। বাকি সব ছেড়ে দিন। ব্র্যাড হগ নিজে এসে বলে গেলেন, উইকেট ভাল ছিল। উইকেটকে দুষে লাভ কী?
তর্কের খাতিরে চিপক পিচকে কেকেআরের অসফল রান তাড়ার একটা কারণ ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত নয়। কিউরেটর কে পার্থসারথি যে বাইশ গজ বরাদ্দ রেখেছিলেন টিম গম্ভীরের জন্য, সেটা সাধারণত কেকেআরকে ইডেনে রাখতে দেখা যেত। লো। স্লো। বল পড়ে থমকে আসবে। স্ট্রোকপ্লেয়ারদের বধ্যভূমি এবং স্পিনারদের স্বর্গসুখ। যত সময় যাবে তত আরও কঠিন হবে স্ট্রোক খেলা। সেটা হয়েওছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই উইকেটে রবিন উথাপ্পাও তো ব্যাট করে গেলেন। স্ট্রাইক রেট দু’শো পঁচিশ রেখে!
সবচেয়ে দুঃখের হচ্ছে, কেকেআর ম্যাচটা হারল সিএসকের ক্রিকেট-গর্বকে আকাশ থেকে মাটিতে টেনে নামানোর পরেও। চেন্নাইকে তাদের ঘরের মাঠে ১৩৪ রানে আটকে রেখে দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া যাবে, টস করতে যাওয়ার আগে কি ভাবতে পেরেছিলেন গৌতম গম্ভীর? ভাবতে পেরেছিলেন, নিজেদের ব্যাটিং শুরুর দশ ওভারের মধ্যে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ডাগআউটে চলে যেতে দেখবেন রক্তাক্ত স্পিনিং ফিঙ্গার নিয়ে? অশ্বিন কিন্তু তখন দু’ওভারে পাঁচ দিয়ে দু’টো নিয়ে বসে আছেন। এবং আরও গোটাকয়েক তোলার আশঙ্কা তৈরি করছেন। আর অশ্বিন মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে কেকেআরের সাতটা উইকেট হাতে। স্রেফ উইকেট বাঁচিয়ে রাখলেও জয় অনায়াসে আসে।
বদলে কী দেখতে হল?
দেখতে হল, আশ্চর্য ভাবে টি-টোয়েন্টি ছেড়ে টেস্ট ক্রিকেটে পর্যবসিত কেকেআর মিডল অর্ডার! দশ-দশটা ওভার হয়ে যাচ্ছে, অথচ একটা বাউন্ডারি বার করা যাচ্ছে না! পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে স্ট্রাইকরেট ঘোরাফেরা করছে কেকেআর ব্যাটসম্যানদের। টি-টোয়েন্টির দুঁদে ব্যাটসম্যানরা চিপকের স্লো পিচ আর সিএসকের স্লো বোলিংয়ের ফাঁসে পড়ে ছটফট করছে। ইউসুফ পাঠান পুল করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, ব্যাটের কানা লেগে স্টাম্পটা ছিটকে গেল। কেকেআর সহ-অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব পায়ের গোড়ায় পেলেন না আর মিসটাইমড পুলটা আকাশে উঠে গেল। ডোয়েন ব্র্যাভো লং অন থেকে দৌড়ে এসে যে ক্যাচটা ঝাঁপিয়ে বাঁ হাতে নিলেন, ওটা নিঃসন্দেহে ‘মোমেন্ট অব দ্য ম্যাচ’। রায়ান টেন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
সোজাসুজি বললে, তিনটে জিনিেস কেকেআরকে এমএসডির টিম এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে গেল। ঢিমে পিচ। তুখোড় স্পিন বোলিং। এবং ক্রমাগত স্লোয়ার।
ব্র্যাভোর অবিশ্বাস্য ক্যাচ।
ভুল। চারটে জিনিসে। চতুর্থটার নাম এমএসডি। তাঁর অধিনায়কত্ব। রায়নাকে দিয়ে চারটে ওভার করানো হোক, বারবার ফিল্ড পাল্টে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া হোক, অশ্বিনের অভাব মিডিয়াম পেসারদের দিয়ে স্লো বোলিং করিয়ে হোক, ধোনি বাজিমাত করে বেরিয়ে গেলেন। শোনা গেল, কেকেআর ইনিংস শুরুর আগে টিমমেটদের ধোনি বলে দিয়েছিলেন, যা উইকেট তাতে ভাল বল করলে একশো পঁচিশেও ম্যাচ আছে। কেকেআরের স্কোর একশো পঁচিশ পেরোলেও লক্ষ্য টপকাতে পারেনি। অথচ সিএসকের দৈত্যাকৃতি ব্যাটিংকেও সাফল্যের স্বর্গ থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মর্ত্যে নামানো গিয়েছিল। ঘরের মাঠে ধোনিদেরই ফেলা সম্ভব হয়েছিল অচেনা একটা সমীকরণের সামনে— কেকেআর ৭০ : সিএসকে ৩০। কয়েকটা বড় ওভার মানে ম্যাচ শেষ। ধোনির অধিনায়কত্ব সেটা হতে দেয়নি। এমএসডি বরং মঙ্গলবার দেখিয়ে গেলেন, ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব জীবনের আটটা বছর কাটিয়ে ফেলার পরে তাঁর চুলে সাদার আধিক্য থাকতে পারে। কিন্তু সীমিত ফর্ম্যাটে বিশ্লেষণী শক্তি আজও ‘প্রৌঢ়ত্বে’ পৌঁছয়নি।
পরে গম্ভীর আক্ষেপ করছিলেন, স্ট্রাইক রোটেট করে গেলে এ ভাবে হারতে হত না। টপ অর্ডারের কেউ পনেরো ওভার পর্যন্ত থেকে গেলেও না। বলে গেলেন, আরও স্মার্ট ক্রিকেট খেলা দরকার। কিন্তু পরপর দু’টো বছর সেটা সম্ভব তো? গত বছর সুনীল নারিন বলে একজন ছিলেন। যিনি এখনও টিমে, কিন্তু নামানো যাচ্ছে না। কারণ অ্যাকশন পরীক্ষার রিপোর্ট আসেনি এখনও। চুয়াল্লিশের ব্র্যাড হগ তাঁর জায়গায় নেমে ভালই করলেন। কিন্তু তার পিছনে কতটা নিজ-গুণ আর কতটা উইকেট-চরিত্র, সংশয়টা গেল না।
অতএব? অতএব, দু’দিনের মধ্যে আবার দেখা হচ্ছে সিএসকের সঙ্গে। এ বার ঘরের মাঠে, ইডেনে। তার আগে নাইটদের পক্ষে একটাই যা ভাল খবর।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হাতে স্টিচ হয়েছে। তাঁর পক্ষে পরশুর ইডেনে নামা সম্ভব হচ্ছে না।